পশ্চিম পাকিস্তানের লায়েলপুর মিয়াওয়ালি জেলখানায় বঙ্গবন্ধুকে আঙুলের দুই কড় সমান পোকাযুক্ত ভাত খেতে দেওয়া হতো। ওই জেলখানার একমাত্র বাঙালি বন্দি ছিলেন আব্দুল মালেক।
তিনি বঙ্গবন্ধুকে দেওয়া ভাতের থালায় একটা একটা করে পোকা বেছে দিতেন। গোসল ও কাপড় কাচতে বঙ্গবন্ধুকে দেওয়া হয়েছিল একটি উট মার্কা বল সাবান। আব্দুল মালেক তাঁর অ্যালাউন্সের টাকা দিয়ে তিনটি ইম্পেরিয়াল লেদার সাবান জেলের বাইরে থেকে একজনকে দিয়ে কিনে আনিয়ে ছিলেন। এরপর গোপনে বঙ্গবন্ধুকে দিয়েছিলেন। সেই সাবান হাতে নিয়ে বঙ্গবন্ধু গারদের শিকের মধ্যে মুখ গলিয়ে আব্দুল মালেককে চুমু খেয়েছিলেন।
১৯৭১ সালে পাকিস্তানের ওই কারাগারে আটক সেনাবাহিনীর মেডিক্যাল কোরের সদস্য আব্দুল মালেক। বঙ্গবন্ধুকে খুব কাছ থেকে দেখেছেন। তাঁর স্নেহধন্য হয়েছেন। বঙ্গবন্ধুর জন্য কোরআন শরিফ খতম করে আল্লাহর দরবারে হাত তুলে দোয়া করেছেন, চোখের পানিতে বুক ভাসিয়েছেন।
ভোলার চরকুমারীয়া গ্রামের ৭১ বছর বয়সী আব্দুল মালেক। বঙ্গবন্ধুকে ঘিরে মিয়াওয়ালি জেলখানার ৯ মাসের অনেক অজানা কথা শোনালেন। তিনি বলেন, “বঙ্গবন্ধুর কারণেই আমি জেল খেটেছি। কিন্তু জেলে গিয়ে বঙ্গবন্ধুকে সেই কথা বলিনি। সেদিন ছিল ১৯৭১ সালের ১ এপ্রিল। আমি পশ্চিম পাকিস্তানের অ্যাবোটাবাদ ক্যান্টনমেন্টের ডিউটি কম্পানিতে সৈনিক পদে কর্মরত ছিলাম। প্যারেড কম্পিটিশনে ৩৫ জন পাঞ্জাবি, বেলুচ, পাঠান সৈনিকের মধ্যে একমাত্র আমিই বাঙালি। প্যারেড মহড়া শেষে গাছতলায় বসে আছি। তখন সেনা সদস্য কাশ্মীরি সাদেক বঙ্গবন্ধুকে মা-বাবা তুলে গালি দেয়। সে বলে, ‘বাঙালিরা নাকি ভুট্টোর ছবি ভেঙেছে। বঙ্গবন্ধুর জন্যই এসব হচ্ছে। ’ আমি সঙ্গে সঙ্গে উঠে দাঁড়িয়ে এর প্রতিবাদ করি। সাদেকের সঙ্গে আমার হাতাহাতি হয়। তখন হাবিলদার বোস্তান খান এসে আমাকে অ্যারেস্ট করে। কমান্ডার ব্রিগেডিয়ার আসমান এয়ার খানকে রিপোর্ট করে। সে আমাকে বড় শাস্তির অর্ডার দেয়। হেভারসেক ওরা ১০টি ইট ভরে আমাকে মার্চ করায়। জ্যাম্প করায়। ১১টা থেকে বেলা ২টা পর্যন্ত এসবের পাশাপাশি সাইড রুলিং, ডাবলিং করানোর ফলে আমি অজ্ঞান হয়ে যাই। তখন ওরা আমার পেটে বুট দিয়ে পাড়ায়। সন্ধ্যায় আমাকে কোয়ার্টার গার্ডে নিয়ে আটক করে। এখান থেকে ১৪-১৫ দিন পর আমাকে মিয়াওয়ালি জেলখানায় নিয়ে যায়। এই জেলখানার সাধারণ ওয়ার্ডে আমার স্থান হয়। জেলখানায় ঢুকে প্রথম দিনেই আমার সঙ্গে দেখা হয় জেলখানার মুন্সি ও আমার রিক্রুট সঙ্গী পাঞ্জাবি আশরাফ খানের সঙ্গে। সে আমাকে জানায়, অফিসারের মেয়েকে নিয়ে পালিয়ে যাওয়ায় তার সাত বছরের জেল হয়েছে। লেখাপড়া জানে বলে জেল কর্তৃপক্ষ তাকে মুন্সির দায়িত্ব দিয়েছে। আশরাফ আমাকে বলে, ‘তোদের নেতা শেখ মুজিবুর রহমান এই জেলে বন্দি আছে। ’ আমি এ কথা শুনে হতভম্ব হয়ে যাই। আশরাফকে বলি, ভাই, তুমি আমাকে আমাদের নেতার কাছে নিয়ে চলো। পরদিন সে ভাত নিয়ে যাওয়ার সময় আমাকে বঙ্গবন্ধুর সেলে নিয়ে যায়। কর্মচারীদের একটি থাকার ঘরে সেল বানানো হয়েছে। টিনের চালের এক রুম ছোট্ট বারান্দা। বারান্দা লাগোয়া একটি টিউবওয়েল। সব কিছু লোহার শিক দিয়ে ঘেরা। আশরাফ নেতাকে বলে, ‘এ বাঙালি। ’ বঙ্গবন্ধুকে আমি সালাম দিই। তিনি আমার বাড়ি কোথায় জানতে চান। কেন জেলখানায় এসেছি তা জানতে চান। আমি দেখতে পাই কলপাড়ে চার-পাঁচ হাত জায়গায় সবুজ যবগাছ। নেতাকে বলি, স্যার, এই যব কে লাগিয়েছে? তিনি বলেন, ‘আমিই লাগিয়েছি। এখানে কোনো সবুজ নেই। কিছুই দেখা যায় না। চোখের জ্যোতি নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। তাই একজনের কাছ থেকে বীজ সংগ্রহ করে লাগিয়েছি। ’ বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে দেখা করার সময় আশরাফ তাঁকে ভাত দেন। দেখি ভাতে বড় বড় পোকা। পোকার মাথা কালো। আমি আশরাফকে বলি, স্যারকে পোকাযুক্ত ভাত দিচ্ছ। আমি পোকা বেছে দেব। ভাত দেওয়ার আগে প্রতিদিনই আমি পোকা বেছে দিতাম। ভাত ঠাণ্ডা হয়ে গেলে কয়লার তাপে প্লেট ধরে গরম করে দিতাম। সেই ভাত আশরাফ বঙ্গবন্ধুর সেলে দিয়ে আসত।
একদিন দুপুরে গিয়ে দেখি স্যার উট মার্কা বল সাবান দিয়ে গোসল করছেন। তিনি আমাকে বলেন, ‘অর্ধেক বল সাবান দিয়েই আমাকে সব করতে হয়। আমার খুব খারাপ লাগে। ’ আমি পরদিন আমার অ্যালাউন্সের ৪৮ টাকা দিয়ে ইংল্যান্ডের তিনটি ইম্পেরিয়াল লেদার সাবান বাইরে থেকে একজনকে দিয়ে কিনিয়ে আনি। এরপর গোপনে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে দেখা করতে গিয়ে তাঁকে দিই। তিনি সাবান পেয়ে কেঁদে ফেলেন। শিকের মধ্যে মাথা ঢুকিয়ে আমার গালে চুমু খেয়ে বলেন, ‘কত দিন ছেলেমেয়েদের মুখ দেখিনি। বাংলা কথা শুনিনি। একজন বাঙালিও দেখিনি। তোমাকে দেখে ওদের কথা খুব মনে হচ্ছে। আমি যদি এখান থেকে বেঁচে দেশে ফিরি, তুমি আমার সঙ্গে দেখা করবা। ’”
স্মৃতিচারণা করে আব্দুল মালেক আরো বলেন, ‘পোকাযুক্ত ভাত স্যার খেতেই পারতেন না। ভাতের জন্য তিনি বিদ্রোহ করেন। জেল কর্তৃপক্ষকে জানান ভাত খাবেন না। তাকে রুটি দিতে হবে। তখন একজন আর্মি অফিসার জেলখানায় আসে। সে বঙ্গবন্ধুকে বলে, তুমি ভাত খাওয়ার জন্য দেশকে টুকরো টুকরো করেছ। তোমাকে পোকাওয়ালা ভাতই খেতে হবে। রুটি আমাদের খাবার, আমরা রুটি খাব। বঙ্গবন্ধুর বিচারের জন্য হেলিকপ্টারে করে আর্মি অফিসাররা আসত। সবাই ফ্লাগ স্টাফ অফিসার। ৫০টার মতো গাড়িতে এসে ওরা সপ্তাহের পাঁচ-ছয় দিন জেলখানার একটি এক তলা বিল্ডিংয়ে ট্রাইব্যুনাল বসিয়ে বিচারকাজ করত। বিচারে যেন শাস্তি না হয় এ জন্য কোরআন খতম করেছি। আল্লাহর কাছে দুই হাত তুলে কেঁদে বলেছি তুমি স্যারকে সম্মানের সঙ্গে দেশে নিয়ে যাও। ১৯৭৩ সাল পর্যন্ত আমি ওই জেলে বন্দি ছিলাম। পরে দেশে এসে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীতে যোগ দিই। দুই দিন বঙ্গবন্ধুর ধানমণ্ডির বাড়িতে গিয়ে তাঁর সঙ্গে দেখা করতে পারিনি। ১৯৭৫ সালের আগস্ট মাসে আমি যশোর ক্যান্টনমেন্টে কর্মরত ছিলাম। ’
মালেক বলেন, ‘ওষুধ নেওয়ার জন্য ফিল্ড অ্যাম্বুল্যান্সে ঢাকায় গিয়ে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে দেখা করার চেষ্টা করি। ক্যান্টনমেন্টে ছিলাম। ১৬ আগস্ট সকালে একজন সিকিউরিটি অফিসার আমাকে জানান, বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যা করা হয়েছে। আমার আফসোস আমি স্বাধীন দেশে আমার প্রিয় নেতার সঙ্গে দেখা করতে পারলাম না। তবে আমার সৌভাগ্য তিনি আমাকে চুমু খেয়েছেন। ’
বর্তমানে আব্দুল মালেক গ্রামের বাড়িতে বসবাস করছেন। তাঁর ছেলে নাসিরউদ্দিন যশোরের ভেকুটিয়া গ্রামে থাকেন। ছেলের বাড়ি বেড়াতে এসে তিনি কারাবন্দি বঙ্গবন্ধুর এই অজানা কাহিনী শুনিয়েছেন। আর তাঁর জন্য কেঁদেছেন। সৌজন্যে: কালের কন্ঠ
বাংলাদেশ সময়: ০৯২৫ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ০৬, ২০১৬