ঢাকা, সোমবার, ৯ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৫ নভেম্বর ২০২৪, ২৩ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

জাতীয়

পোশাক শ্রমিকদের আন্দোলন

অন্ধকারে কালো বেড়াল খোঁজার পথের সন্ধান!

জাহিদুর রহমান, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৪৫৭ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ২১, ২০১৬
অন্ধকারে কালো বেড়াল খোঁজার পথের সন্ধান! আশুলিয়ায় আইন শৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে অবস্থান নিয়েছে পুলিশের রায়টকার। ছবি: ইমন দেওয়ান

আশুলিয়া শিল্পাঞ্চলে অঘোষিত কারফিউ। শ্রমিক জটলা দেখা মাত্রই সেখানে পৌঁছে যাচ্ছেন আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা। তাদের জটলা ভেঙ্গে দেয়া হচ্ছে। ভাঙ্গছে না কেবল জটিলতা।

ঢাকা: আশুলিয়া শিল্পাঞ্চলে অঘোষিত কারফিউ। শ্রমিক জটলা দেখা মাত্রই সেখানে পৌঁছে যাচ্ছেন আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা।

তাদের জটলা ভেঙ্গে দেয়া হচ্ছে। ভাঙ্গছে না কেবল জটিলতা।

শ্রমিকরা বলছেন,তাদের মজুরি বাড়াতে হবে। মানতে হবে অন্যান্য দাবি দাওয়া। বিপরীতে মালিকরা বলছেন,মজুরি ঠিকই আছে। বিভিন্ন দেশের তুলনায় দক্ষতার মাপকাঠিতে শ্রমিকদের মজুরি বাড়ানোর মতো পরিস্থিতি হয়নি। মুদ্রাস্ফীতির তুলনায় মজুরি ও বছর শেষে ইনক্রিমেন্ট দিয়ে শ্রমিকরা এখন মাস শেষে উল্টো কিছু সঞ্চয়-ও করতে পারেন।

সবকিছুর নেপথ্যে ষড়যন্ত্র আর নাশকতাকেই দায়ী করছেন তারা। তাহলে কারা এই নাশকতা আর ষড়যন্ত্রকারী?

বুধবার ( ডিসেম্বর ২১) ভোরে ঘুম ভাঙিয়ে এই প্রশ্নটাই করেছিলাম বিজিএমইএ’র সভাপতি সিদ্দিকুর রহমানকে। আড়মোড়া ভেঙ্গে এক কথায় বললেন,অবশ্যই ষড়যন্ত্র। দেশ থেকে এই শিল্পকে অন্যদেশে সরিয়ে নেবার ষড়যন্ত্র।

আশুলিয়া কেন্দ্রিক গড়ে ওঠা বিভিন্ন শ্রমিক সংগঠনের তৎপরতার দিকেই অভিযোগের আঙ্গুল তোলেন তিনি।
যেখানে বাংলাদেশকে চায়না প্লাস ভাবা হতো। সেখানে এই অসন্তোষ আর ষড়যন্ত্র  অগ্রসরমান এই শিল্পখাতের অগ্রযাত্রাকে নিঃসন্দেহে বাধাগ্রস্ত করবে।

শিল্প চলে যাবে অন্য দেশে। ভিনদেশি ক্রেতারা বিরক্ত, হতাশাগ্রস্ত। এভাবে তো বছর বছর চলতে পারে না। সবার প্রত্যাশা স্থিতিশীলতা।

মালিকরা সংখ্যায় আড়াই হাজার হলেও শ্রমিক ৪০ লাখ। খেয়েপরে মালিকদের দিন চলে যাবে তবে মারাত্মক সমস্যায় পড়বে শ্রমিকরা। ক্ষতিগ্রস্ত হবে বাংলাদেশ।

চলতি পরিস্থিতির পেছনে নাশকতা উস্কানি আর ষড়যন্ত্রকেই দায়ী করেন তিনি। শ্রমিকরা বরাবরই বলছেন, তাদের ‘ন্যায্য’ দাবি দাওয়ার কথা। বিপরীতে মালিকরা বলে আসছেন ষড়যন্ত্র আর নাশকতার কথা।
এর মাঝেই তৈরি হচ্ছে অস্থিতিশীলতার বিষবাষ্প। যে বাতাস ছড়িয়ে বিষাক্ত করছে অন্যান্য এলাকার শিল্পাঞ্চলের বাতাস।

বাংলানিউজকে এমনটিই বলছিলেন আশুলিয়া শ্রমিক অসন্তোষ নিয়ে কাজ করা পুলিশের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে তিনি বলেন,এই শিল্পাঞ্চল যেমন সম্ভাবনার তেমনি এটা নিয়ে ষড়যন্ত্রকারীদের অভাব নেই। তেমনি অভাব নেই আগুনে আলো পোড়া খাবার লোকের।

তার মতে,কিছু একটা হলেই মালিকরা চেয়ে থাকেন আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর পদক্ষেপের দিকে। তারা অনেক সময়ই এটা বুঝতে চান না যে কারখানার ভেতরের সমস্যা বাইরের আইনশৃঙ্খলা বাহিনী দিয়ে মোকাবেলা করা যথার্থ নয়। বরং এতে অনেক সময়ই ঘটনার পিঠে নতুন ঘটনার জন্ম হয়। নতুন সংকট পঞ্জীভূত ক্ষোভকে আরো উস্কে দেয়।

বেতনের দাবি নিয়ে সংকট। এটা শ্রমিক-মালিকদেরই বসে ঠিক করতে হবে। টিয়ার শেল বা লাঠিচার্জ দিয়ে সমাধান হবে না। মাত্র দশ দিন আগে উদ্ভব এই সংকটের। বরাবরের মতো আশুলিয়া শিল্পাঞ্চল থেকেই উৎপত্তি অসন্তোষ নামের এই ভূমিকম্পের। যা আপাত পরিস্থিতিতে ভয়াবহ মাত্রার ক্ষয়ক্ষতির দিকেই এগুচ্ছে । সংকটকে ক্রমশ আরো ঘনীভূতই করছে।  
আশুলিয়া শিল্পাঞ্চলে মোতায়েন করা হয়েছে অতিরিক্ত পুলিশ।  ছবি: ইমন দেওয়ানবেশ কয়েকজন শ্রমিকদের বাড়িতে গিয়ে মুখোমুখি হলাম। অজানা ভয় আর আতংকে  নিজেদের নামটিও প্রকাশ করতে চাইলেন না শ্রমিকরা। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এসব শ্রমিক বলছেন, দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি, বাড়ি ভাড়াসহ তাদের পারিবারিক ব্যয়ভার বেড়ে যাওয়ায় সরকারের কাছে ন্যূনতম মজুরি ১৫ হাজার টাকা নির্ধারণের দাবি তুলছেন। এজন্য তারা কর্মবিরতির মতো শান্তিপূর্ণ আন্দোলনের পথ বেছে নিয়েছেন।
একাধিক নারী শ্রমিক বলছেন, বর্তমান বাজার দরের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে ন্যূনতম মজুরি ১৫ হাজার টাকা নির্ধারণ, গণতান্ত্রিক শ্রম আইন প্রণয়ন, শ্রম আইনের ২৭-এর ৩(ক), ১৩(১) ধারা বাতিল, কারখানার নিরাপত্তা নিশ্চিত করা, কর্মস্থলের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা, হাজিরা বোনাস বৃদ্ধি, দৈনিক লাঞ্চ ভাতা বৃদ্ধি, যাতায়াত ভাতা বৃদ্ধি, শুক্রবারের কাজের জন্য দ্বিগুণ ওভারটাইমের বিল বৃদ্ধি, যখন তখন শ্রমিক ছাঁটাই বন্ধ, কর্মক্ষেত্রে মৃত হলে আজীবন আয়ের ক্ষতিপূরণ দেওয়া, রানা প্লাজা, তাজরীন ফ্যাশন, টাম্পাকো, কালার ম্যাক্স বিডি লিমিটেডসহ সব দুর্ঘটনার জন্য দায়ীদের শাস্তি নিশ্চিত, শিল্পাঞ্চলে সরকারি হাসপাতাল, স্কুল ও কলেজ নির্মাণ, মহিলা শ্রমিকদের মাতৃত্বকালীন সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করা, শ্রমিকদের আবাস, পরিবহন সুবিধা ও রেশনিং ব্যবস্থা চালুর দাবিগুলোকেও সামনে আনছেন তারা।
 
তবে মালিকরা বলছেন,শ্রমিকদের বিপরীতে তাদের-ও অবস্থান সুস্পষ্ট। যারা এই বেতনে কাজ করবে না। তাদের কারখানায় আসার দরকার নেই। আইন যেমন শ্রমিকদের রয়েছে। আবার তাদের-ও রয়েছে। যে কারণে শ্রম আইন-২০১৩ এর ধারা-১ অনুযায়ী তারা কারখানা বন্ধের ঘোষণা দিয়েছেন। যার ফলে যতদিন কারখানা মালিকপক্ষ বন্ধ রাখবেন, ততদিন শ্রমিকরা তাদের মজুরি পাবেন না।
 
শ্রমিকরা বলছেন,কিছু পেলে কিছু ছাড় দিতেই হয়। তারা নিশ্চিত যেহেতু প্রধানমন্ত্রীর গোচরে বিষয়টি তারা আনতে পেরেছেন। একটা কিছু হবেই। আগের উদাহরণ টেনে তারা বলেছেন, আগেও মালিকরা মজুরি বাড়ানোর দাবিকে উপেক্ষা করেছেন। তখনো ষড়যন্ত্র বলেছেন। শ্রমিক নেতা আমিনুল গুম হয়েছে। পরে তার লাশ-ও মিলেছে অন্যত্র। যেটা নিয়ে সরকারকেও অনেক বেকায়দায় পড়তে হয়েছে।

সুতরাং আমরা কোন জ্বালাও পোড়াও নীতিতে বিশ্বাস করি না। আমরা শান্তিপূর্ণভাবে দাবি আদায়ে কর্মবিরতিই করেছিলাম। মালিকদের আজ না হয় কাল কারখানা খুলতেই হবে। মাঝে যে যত কথাই বলুক না কেন। আমাদের সাথে বসেই সংকট নিরসন করতে হবে।

তবে শ্রমিকদের আন্দোলনকে সম্পূর্ণভাবেই অযৌক্তিক বলছেন বিজিএমইএ’র সভাপতি সিদ্দিকুর রহমানকে।
তার মতে, তিন বছরও হয়নি তাদের মজুরি বৃদ্ধি করা হয়েছে। আবার বছরান্তে ৫ ভাগ করে ইনক্রিমেন্ট দেয়া হয়েছে। বেতন বৃদ্ধির হার ২২৩ শতাংশ। কোনো অবস্থাতেই নতুন করে মজুরি বাড়ানোর সুযোগ নেই। গত ১০দিন ধরে শ্রমিকরা কারখানায় যায়। হাজিরা পাঞ্চ করে কাজ না করে বসে থাকে। এগুলো তো মেনে নেবার মতো না। তারা কাজ-ও করতো। দাবিদাওয়া লিখিত ভাবে জানিয়ে। তখন না হয় বসা যেতো। এভাবেই মাসের এক তৃতীয়াংশ সময় চলে গেছে। যে কারণে এখন বাধ্য হয়েই  অর্ধশতাধিক কারখানার বন্ধের ঘোষণা দিতে হয়েছে।

শ্রম গবেষণা সংস্থা বিলসের কর্মকর্তা সুলতান উদ্দিন আহমেদ বলছেন,একযোগে ৫৫ টি কারখানা বন্ধের ঘোষণা সংকটকে আরো ঘনীভূত করবে। কারণ এখন এসব কারখানার লক্ষাধিক শ্রমিক একত্র হবার সুযোগ পাবে।

৫ বছরে শ্রমিকদের বেতন বাড়ানোর কোন সুযোগ নেই- বিজিএমইএর এমন ঘোষণার প্রেক্ষিতে তিনি বলেন,৫ বছর পর পর বেতনের বিষয়টি পর্যলোচনার কথা বলা হয়েছিলো। তবে আলাপ আলোচনার মাধ্যমেই এই সংকট থেকে বের হবার কোন বিকল্প নেই বলেও মনে করেন তিনি।

একদিকে শ্রমিকদের মজুরি বাড়ানো দাবিতে কর্মবিরতি। অন্যদিকে কারখানা বন্ধ করে মালিকদের কড়া অবস্থান। মাঝে নাশকতা আর ষড়যন্ত্রকে দায়ী করা। সব মিলিয়ে পোশাক শিল্পের অব্যাহত সংকট। তার থেকে বেরিয়ে আসার পথটাই আপাতত অন্ধকারে। সমাধানের জন্যে অনেকেই আবার অন্ধকারে কালো বেড়াল খোঁজার মতো‘উত্তম পথের-ও সন্ধান করছেন - আশুলিয়া শিল্পাঞ্চল নিয়ে এমনটিই বলছিলেন শ্রম গবেষণা সংস্থায় কর্মরত একজন কর্মকর্তা।  

বাংলাদেশ সময়: ১০৫১ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ২১, ২০১৬
আরআই

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।