ঢাকা, মঙ্গলবার, ১১ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৬ নভেম্বর ২০২৪, ২৪ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

জাতীয়

যুদ্ধ শেষে গুলি ছুড়তে ছুড়েতে কুড়িগ্রাম ছাড়ে পাকবাহিনী

ফজলে ইলাহী স্বপন, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ২১৪৮ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ৫, ২০১৭
যুদ্ধ শেষে গুলি ছুড়তে ছুড়েতে কুড়িগ্রাম ছাড়ে পাকবাহিনী কুড়িগ্রাম বিজয় স্তম্ভ

কুড়িগ্রাম: ১৯৭১ সালের মহান স্বাধীনতাযুদ্ধে বীর মুক্তিযোদ্ধাগণ বীরদর্পে দীর্ঘ ২৩০ দিন ধরে পাকবাহিনীর সাথে সশস্ত্র সংগ্রাম চালিয়ে গেছেন। অবশেষে হানাদার পাকিস্তানি বাহিনী ও তাদের এদেশীয় দোসর রাজাকার-আল বদরদের হটিয়ে, পরাজিত করে ৬ ডিসেম্বর অবরুদ্ধ কুড়িগ্রামকে শত্রুমুক্ত করতে সক্ষম হয় তারা। 

পাকবাহিনী গুলি ছুঁড়তে ছুঁড়তে ট্রেনযোগে কুড়িগ্রাম শহর ছেড়ে রংপুরের দিকে চলে গেলে শত্রুমুক্ত হয় কুড়িগ্রাম। ঐ দিনই কোম্পানি কমান্ডার আব্দুল হাই সরকারের নেতৃত্বে ৩৩৫ জন মুক্তিযোদ্ধার একটি দল শহরে প্রবেশ করে।

বিকেল সাড়ে ৩টায় নতুন শহরস্থ ওভারহেড পানির ট্যাংকের উপর স্বাধীন বাংলার পতাকা উত্তোলন করে তারা।

২৩০ দিনে যেভাবে মুক্ত হলো কুড়িগ্রাম
১৯৭১ সালের ৯ মার্চ অত্র এলাকার সর্বস্তরের মানুষ কুড়িগ্রাম পুরাতন ডাকঘরের লিচুতলায় একটি জনসভায় মিলিত হয় এবং ১০ মার্চ জেলার বিশিষ্ট ব্যক্তি প্রয়াত আহম্মদ হোসেন সরকার ও আহাম্মদ আলী বকসীকে যুগ্ম আহবায়ক করে মহুকুমা সংগ্রাম কমিটির আত্মপ্রকাশ ঘটে।

১৭ মার্চ ছাত্রলীগের স্থানীয় নেতাদের যৌথ উদ্যোগে কুড়িগ্রামের সবুজপাড়াস্থ চিলড্রেন পার্কে তৎকালীন ডিএসবি দারোগার ছেলে তুষার নামের একটি শিশুকে দিয়ে প্রথম বাংলাদেশের মানচিত্র খচিত স্বাধীন বাংলার পতাকা আনুষ্ঠানিকভাবে উত্তোলন করা হয। এসময় উপস্থিত ছিলেন তৎকালীন ছাত্রনেতা শুভ্রাংশু চক্রবর্তী, আমিনুল ইসলাম, রওশন বারী ও রুকুনুদ্দৌলা মণ্ডল প্রমুখ।

১৮ মার্চ তৎকালীন মহকুমা প্রশাসকের কার্যালয়ে উড্ডীয়মান পাকিস্থানি পতাকা পোড়াতে গিয়ে গ্রেফতার হন সৈয়দ মনসুর আলী টুংকু, জোবেদ আলী সরকার, আবআস আলী, সুজাম ও খোকন ঘোষ।  

২৩ মার্চ পাকিস্তান দিবসে বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে সারাদেশের মতো কুড়িগ্রাম মহুকুমার সকল অফিস-আদালত ও বাসভবনে বাংলাদেশের মানচিত্র খচিত পতাকা উত্তোলন করা হয়। সেসময় কুড়িগ্রাম মহুকুমা প্রশাসক মামুনুর রশীদ (সিএসপি), দ্বিতীয় কর্মকর্তা আব্দুল হালীম ও তৃতীয় কর্মকর্তা আব্দুল লতিফ স্বাধীনতাযুদ্ধে সক্রিয়ভাবে অংশ নেন।

২৮ মার্চ কুড়িগ্রাম সংগ্রাম কমিটির নেতৃত্বে স্থানীয় গওহর পার্ক মাঠের জনসমাবেশে আহাম্মদ আলী বকসী, অধ্যাপক হায়দার আলী, তাছাদ্দুক হোসেন, আমিনুল ইসলাম মন্ডল, আক্তারুজ্জামান মণ্ডল, রওশনুল বারী, প্রফেসর হায়দার আলী এবং বর্তমানে প্রয়াত আব্দুস সামাদ ও এটিএম আফজাল হোসেন দুলালকে নিয়ে একটি বেসরকারী হাই কমান্ড গঠন করা হয়।

৩০ মার্চ রংপুরের ইপিআর উইং এর সহকর্মী অধিনায়ক ক্যাপ্টেন নওয়াজেস উদ্দিন কুড়িগ্রামে আসেন। তার নির্দেশেই রংপুরের ইপিআর উইং এর অধিনস্থ অধিনায়ক নায়েক সুবেদার বোরহান উদ্দিন তাদের সহযোদ্ধা ইপিআরদের নিয়ে কুড়িগ্রামে আসেন এবং অবস্থান নেন।  

৩১ মার্চ কুড়িগ্রামে সমবেত হয়ে এখানকার স্থানীয় পুলিশ, আনসার, মুজাহিদ, ছাত্র-জনতা এবং ইপিআরদের নিয়ে একটি সম্মিলিত বাহিনী গড়ে তোলা হয়। সেসময় আহম্মদ আলী বকসীর গোডাউনকে কন্ট্রোল রুম করে টোগরাই হাটের আওয়ামী লীগ নেতা আহম্মদ হোসেন সরকারের বাড়িতে মুক্তিযোদ্ধাদের হেড কোয়ার্টার স্থাপন করা হয়।

৫ এপ্রিল কুড়িগ্রাম চিলড্রেন পার্কের জনসভায় মুক্তিযোদ্ধারা সাধারণ মানুষজনকে নিরাপদ আশ্রয়ে চলে যাবার আহ্বান জানালে শহর জনশুন্য হয়ে পড়ে। এদিনই মুক্তিযোদ্ধাদের হেডকোর্য়াটার নাগেশ্বরীতে সরিয়ে নেয়া হয়।

৭ এপ্রিল পাকবাহিনী সাঁজোয়া বহর নিয়ে লালমনিরহাট ও রংপুর থেকে একযোগে গুলি ছুড়তে ছুড়তে বিকেলের দিকে কুড়িগ্রাম শহরে প্রবেশ করে ভারী গোলাবর্ষণ শুরু করে। এসময় কুড়িগ্রাম জেলখানার কর্তব্যরত ইনচার্জ ও ৫ জন সিপাহীকে পাকিস্তানি সেনারা সারিবদ্ধভাবে দাঁড় করিয়ে বার্স্ট ফায়ার করে। সেখানেই শহীদ হন লাল মোহাম্মদ, আনসার আলী, সাজ্জাদ আলী ও জহির উদ্দিন।  

১৪ এপ্রিল মুক্তিযোদ্ধাদের প্রবল প্রতিরোধের মুখে পাক হানাদার বাহিনী কুড়িগ্রাম আক্রমণের চেষ্টা করে দখলে নিতে ব্যর্থ হয়।  

১৫ এপ্রিল সকালে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি নিয়ে রেলপথ ধরে পাকবাহিনী তিস্তার দিকে পিছু হটে। এসময় তারা  রেললাইনের দু’ধারের বাড়িঘরে অগ্নিসংযোগ করে যেতে থাকে এবং নির্বিচার ধ্বংসযজ্ঞ চালায়।

২২ এপ্রিল ভোরবেলা প্রতিরক্ষার স্বার্থে মুক্তিযোদ্ধারা নাগেশ্বরীর রায়গঞ্জ ব্রিজটি ৩০০ গান কটন সেট করে উড়িয়ে দেয় এবং ধরলা নদীর পূর্বপাড়ে বিশাল এলাকা নিয়ে দৃঢ় প্রতিরক্ষা ব্যুহ গড়ে তোলে।

২৭ মে একটি জিপ ও একটি ট্রাক ১৯ জন মুক্তিযোদ্ধাসহ ধরলা নদীর দিকে এগুলে পাকসেনারা প্রচণ্ড গোলাবর্ষণ শুরু করে। হানাদারদের গোলার আঘাতে ঘটনাস্থলেই শহীদ হন চালক রব্বানীসহ ১৬ জন মুক্তিযোদ্ধা।

১লা আগস্ট রৌমারীর আলতাফ বাহিনী চিলমারী রেইড চালিয়ে পাকবাহিনীকে পরাজিত করে বালাবাড়ী পর্যন্ত দখলে নেয়।

৪ আগস্ট পাকবাহিনী নৌপথে তিনটি গানবোট ও দুটি লঞ্চ নিয়ে চিলমারী ঘাটে পৌঁছে পরবর্তী সময়ে নদীপথে রৌমারীর ছালিপাড়া ও কোদালকাটি দখল করে নেয়। তবে বাদবাকি অংশ ছিলো পুরোপুরি মুক্তাঞ্চল। ওই সেক্টরের আওতায় বীরপ্রতীক তারামন বিবি সম্মুখযুদ্ধে অংশ নেন।

১লা আগস্ট সংঘটিত আন্ধারী ঝাড় অপারেশনে ৭০ জন মুক্তিযোদ্ধা অ্যামবুশ করে পাকবাহিনীর একজন ক্যাপ্টেন সহ ১১ জন সৈন্যকে হত্যা করে।  

৫ আগস্ট মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক ও বামনহাট যুব শিবির প্রধান অধ্যাপক আব্দুল ওহাব তালুকদার দুইজন সঙ্গীসহ শিংঝাড় এলাকায় পাকবাহিনীর অতর্কিত আক্রমণে শহীদ হন।

আগস্ট মাসব্যাপী মুক্তিযোদ্ধারা পাকবাহিনী ও তাদের এদেশীয় দালাল ও দোসরদের বিরুদ্ধে গেরিলা কায়দায় সম্মুখযুদ্ধকে জোরদার করে। সে সময়ে ঘটা বিভিন্ন ঘটনার মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল ১ আগস্ট চিলমারী ও আন্ধাড়ী ঝাড় অপারেশন, ১৪ আগস্ট সোনাহাট ব্রিজে সম্মুখযুদ্ধ, দুর্গাপুর অপারেশন, গাগলা অভিযান, পাঁচগাছিতে রাজাকার আটক অভিযান, রায়গঞ্জে অপারেশন সহ মুক্তিযোদ্ধাদের বেশ কিছু সাঁড়াশি আক্রমণের ঘটনা।  

এসময় পাকবাহিনী কুড়িগ্রাম জেলার বিভিন্ন স্থানে বাঙ্গালী নারীদের ধর্ষণযজ্ঞ চালায়। তারা স্বাধীনতাকামী মানুষকে শায়েস্তা করার জন্য নির্যাতন শিবির গড়ে তোলে। উলিপুরের হাতিয়া, কুড়িগ্রাম সদরের কাঁঠালবাড়িতে হানাদার পাকবাহিনীর নৃশংসতম গণহত্যাযজ্ঞ চালায়।  
১৩ নভেম্বর উলিপুরের হাতিয়ায় নিরীহ ঘুমন্ত মানুষের উপর নির্বিচারে গুলি করে, পুড়িয়ে নৃশংসভাবে হত্যা করে ৬৯৭ জন নারী-পুরুষ-শিশুকে।

২০ নভেম্বর রাতে সম্মুখযুদ্ধ চলাকালীন লে: সামাদ মাথায় গুলিবিদ্ধ হয়ে শহীদ হন এবং যুদ্ধ চলতে থাকে।  
মুক্তিযোদ্ধারা ব্রিগেডিয়ার যোশীর নেতৃত্বাধীন ভারতীয় সেনাবাহিনীর ষষ্ঠ মাউন্টেন ডিভিশনের সহযোগিতায় পাকবাহিনীর উপর পাল্টা আক্রমণ চালিয়ে ১৪ নভেম্বর ভুরুঙ্গামারী, ২৮ নভেম্বর নাগেশ্বরী এবং ৩০ নভেম্বর গোটা উত্তর ধরলা হানাদারমুক্ত করে।

১লা ডিসেম্বর থেকে ৫ ডিসেম্বর পর্যন্ত মুক্তিবাহিনী ধরলা নদী পাড়ি দিয়ে কুড়িগ্রাম শহরে অবস্থানরত পাকবাহিনীর উপর অব্যাহত গেরিলা হামলা চালায়। পাশাপাশি পরপর দুদিন চলে ভারতীয় বিমান হামলা।

৬ ডিসেম্বর বিকাল ৩টার দিকে পাকবাহিনী গুলি করতে করতে ট্রেনযোগে কুড়িগ্রাম শহর ছেড়ে রংপুরের দিকে চলে গেলে কুড়িগ্রাম চূড়ান্তভাবে শত্রুমুক্ত হয়। ঐ দিনই কোম্পানি কমান্ডার আব্দুল হাই সরকারের নেতৃত্বে ৩৩৫ জন মুক্তিযোদ্ধার একটি দল শহরে প্রবেশ করে। বিকেল সাড়ে ৩টায় নতুন শহরস্থ ওভারহেড পানির ট্যাংকের উপর তারা স্বাধীন বাংলার পতাকা ওড়ায়।

সাবেক মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার সিরাজুল ইসলাম টুকু বাংলানিউজকে জানান, প্রাপ্ত তথ্যমতে কুড়িগ্রাম জেলায় শহীদ মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যা ৯৯ জন। খেতাবপ্রাপ্তর তালিকায় রয়েছেন ১ জন বীরউত্তম, ২ জন বীরবিক্রম ও একজন নারীসহ ৪ জন বীরপ্রতীক।  

যুদ্ধকালে এই অঞ্চলে কোম্পানি কমান্ডারের দায়িত্ব পালন করেন আব্দুল কুদ্দুস নান্নু, রওশন বারী রঞ্জু, আব্দুল হাই সরকার, কেএম আকরাম হোসেন, সুবেদার মেজর আরব আলী, সুবেদার বোরহান উদ্দিন, সুবেদার মাজহারুল হক, সুবেদার আব্দুল ওয়াহাব, সুবেদার আলতাফ, বদরুজ্জামান, শওকত আলী ও আবুল কাশেম চাঁদ।

মুক্তিযুদ্ধে অসাধারণ অবদান রাখার জন্য খেতাব প্রাপ্ত হয়েছেন লেঃ আবু মঈন মোঃ আসফাকুস সামাদ বীর উত্তম (মরণোত্তর), শওকত আলী (বীর বিক্রম), সৈয়দ মনছুর আলী টুংকু (বীর বিক্রম), বদরুজ্জামান (বীর প্রতীক), আব্দুল হাই সরকার (বীর প্রতীক), আব্দুল আজিজ (বীর প্রতীক) এবং একমাত্র নারী মুক্তিযোদ্ধা তারামন বিবি (বীর প্রতীক)।

বাংলাদেশ সময়: ০৩৪১ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ০৬, ২০১৭
এফইএস/জেএম
 

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।