তবে ফরহাদ মজহারের দাবি, ‘নিশ্চিত থাকতে পারেন, সাজানো নাটক নয়’।
উদ্ধার হওয়ার পরদিন ‘অপহৃত’ হওয়ার দাবি করে আদালতে দেওয়া জবানবন্দি প্রসঙ্গে তার অভিযোগ, উল্টো মামলা ও সামাজিকভাবে হেনস্থার ভয়ে পুলিশের লিখে দেওয়া বক্তব্যকেই তিনি আদালতে দাখিল করতে বাধ্য হয়েছেন।
শনিবার (০৯ ডিসেম্বর) সন্ধ্যায় রাজধানীর শ্যামলীর নিজ বাসায় সংবাদ সম্মেলনে এসব কথা বলেন তিনি।
তদন্তের পর ফরহাদ মজহার অপহরণের নামে ‘সাজানো নাটক করেছেন’ বলে আদালতে চূড়ান্ত প্রতিবেদন দাখিল করে পুলিশ। তবে ঘটনার দীর্ঘ পাঁচমাস পর গণমাধ্যমের সামনে এসে ‘অপহৃত হয়েছিলেন’ বলেই ফের দাবি করেন মজহার। সুষ্ঠু তদন্তের স্বার্থে এবং পুলিশের নিষেধাজ্ঞার কারণে ইচ্ছে থাকলেও গণমাধ্যমের সামনে আসতে পারেননি বলেও দাবি তার।
সংবাদ সম্মেলনে বিভিন্ন প্রশ্ন এড়িয়ে ফরহাদ মজহার একাধিকবার বলেন, ‘আইনি প্রক্রিয়ায় বিষয়টির সমাধান চাই। বাংলাদেশে বহু মানুষ গুম হওয়া এবং তারপর ভিকটিমের ওপর দায় চাপিয়ে দেওয়ার সংস্কৃতি বন্ধে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে কথা বলতে এসেছি’।
ঘটনার দিনের বর্ণনায় মজহারের দাবি, বাসা থেকে চোখের ওষুধ কিনতে বের হলে বাসার কাছেই তিনজন লোক তাকে ধরে মাইক্রোবাসে তুলে চোখ বেঁধে ফেলেন। হাতে থাকা মোবাইল ফোনে সর্বশেষ ডায়ালকৃত নম্বর দিয়েই তিনি তার স্ত্রীকে ফোন দেন। তারপর সারাপথই তার চোখ বাঁধা ছিল এবং জীবন বাঁচাতে অপহরণকারীদের নির্দেশ মতোই তিনি বিভিন্ন জনকে ফোন করা, ৩৫ লাখ টাকা পাঠানোসহ সবকিছু করেছেন।
তিনি বলেন, ‘অপহরণ করে নিয়ে গিয়ে তারা কোথায় আমাকে ছেড়ে দেন, আমি চিনি না। আমি বুঝতে পারি, তারা আমার ওপর নজরদারি রাখছেন। তাদের নির্দেশমতো হানিফ গাড়িতে উঠলে তারা আমাকে গাড়ির পেছনের সিটে বসিয়ে দেন। মৃত্যুভয়ে ভীত হয়ে আমি শারীরিক অসুস্থতায় নির্জীব হয়ে পড়ি’।
‘কিছুক্ষণ পর সাদা পোশাকে কিছু লোক আমাকে গাড়ি থেকে নামিয়ে আনার চেষ্টা করেন। তখন র্যাবের লোকজন আমাকে নিয়ে যেতে চাইলে সাদা পোশাকের ওই ব্যক্তিরা র্যাবের দিকে বন্দুক তুলে আমাকে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেন। র্যাব এক রকম ছোটখাট যুদ্ধ করে আমাকে তাদের গাড়িতে ওঠায় এবং আমার স্ত্রীর সঙ্গে কথা বলিয়ে আশ্বস্ত করে। কিন্তু সাদা পোশাকের লোকগুলো আমাকে বার বার র্যাবের গাড়ি থেকে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেন’।
‘র্যাব খুলনায় নিয়ে যেতে চাইলে পথিমধ্যে কেউ ট্রাক দিয়ে গাড়ির গতিরোধ করলে তারা আমাকে অভয়নগর থানায় নিয়ে যান। তখন পুলিশ আমাকে গালিগালাজ করে বিনোদনের জন্য এসেছি স্বীকার করতে চাপ দেয়’।
তিনি বলেন, ‘ঢাকায় আনার পর পরদিন সকালে ডিবি অফিসে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদের নামে মামলার ভয় দেখিয়ে লিখিত কপি দিয়ে আদালতে পাঠানো হয়। আমি ট্রমাটাইজড অবস্থায় আদালতে এটুকুই বলি, ডিবি অফিস থেকে আমাকে যা লিখে দিয়েছে, তাই আপনাকে দিচ্ছি। পরে সেটি আদালত আমার জবানবন্দি হিসেবে গ্রহণ করেন’।
‘ডিবি পুলিশ সুষ্ঠু তদন্ত না করে ঘটনাটিকে ভিন্নদিকে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করে এবং তাদের তদন্তকে চ্যালেঞ্জ করলে আমার বিরুদ্ধে মামলার হুমকি দেয়। তারপরেও আমি সুষ্ঠু তদন্তের স্বার্থে চুপ থাকি এবং পুলিশের প্রতিবেদন আইনিভাবে মোকাবেলা করবো বলে সিদ্ধান্ত নেই’।
কারা অপহরণ করেছেন- এমন প্রশ্নের জবাবে ফরহাদ মজহার বলেন, ‘সাংবাদিক হিসেবে খুঁজে বের করেন, সেদিন কি হয়েছিল? আশা করি, আদালতের মাধ্যমে সত্য উন্মোচিত হবে। আর না হলে আমি বলবো’।
গত ০৩ জুলাই ভোর পাঁচটার দিকে শ্যামলীর হক গার্ডেনের বাসা থেকে বের হন ফরহাদ মজহার। ভবনের সিসিটিভি ফুটেজে যায়, ভোর ৫টা ৫ মিনিটে ফরহাদ মজহার খুব স্বাভাবিক ভঙ্গিতে সিঁড়ি দিয়ে নিচে নামেন। ভোর সাড়ে পাঁচটার দিকে অপরিচিত নম্বর থেকে ফরহাদ মজহার স্ত্রী ফরিদা আখতারকে ফোন করে বলেন, ‘ওরা আমাকে নিয়ে যাচ্ছে। ওরা আমাকে মেরে ফেলবে’।
পরে আদাবর থানায় ফরহাদ মজহারের স্ত্রী সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করেন, যা পরে অপহরণ মামলায় রুপ নেয়।
পুলিশ ফরহাদ মজহারের মোবাইল ফোন ট্র্যাক করে খুলনায় তার অবস্থান শনাক্ত করে। পরে খুলনার পরিচিত একটি রেস্টুরেন্টে তিনি খাবার খেয়েছিলেন বলে প্রমাণ পায়। এরপর খুলনা থেকে ঢাকাগামী হানিফ পরিবহনের একটি বাসে মিস্টার গফুর নামে টিকিট কাটেন ফরহাদ মজহার।
সেদিনই রাত সাড়ে ১১টার দিকে যশোরের অভয়নগর উপজেলার এলাকায় খুলনা থেকে ঢাকাগামী হানিফ পরিবহনের একটি বাস থেকে তাকে উদ্ধার করে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী।
পরদিন ০৪ জুলাই সকালে ঢাকার আদাবর থানায় ও দুপুরের দিকে মিন্টো রোডের গোয়েন্দা কার্যালয়ে নিয়ে আসা হয় ফরহাদ মজহারকে। সেখানে প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদ শেষে আদালতে তিনি অপহৃত হয়েছিলেন বলে জবানবন্দি দেন। এরপর আদালত তাকে নিজ জিম্মায় বাড়ি ফেরার অনুমতি দেন।
মামলাটিতে গত ০৬ জুলাই হানিফ পরিবহনের এক কর্মচারী নাজমুস সাদাত সাদী এবং গত ১০ জুলাই অর্চনা নামে এক নারী সাক্ষী হিসেবে জবানবন্দি দেন।
গত ০৯ নভেম্বর তদন্ত শেষে আদালতে দাখিল করা মামলাটির চূড়ান্ত প্রতিবেদনে তদন্তকারী কর্মকর্তা ডিবি পুলিশের পরিদর্শক মাহবুবুল ইসলাম জানান, ফরহাদ মজহার অপহৃত হননি, তিনি স্বেচ্ছায় খুলনা গিয়েছিলেন। একই সঙ্গে মিথ্যা অপহরণের মামলা দিয়ে বিভ্রান্ত ও হয়রানি করার অভিযোগে দণ্ডবিধির ২১১ ও ১০৯ ধারায় ফরহাদ মজহার ও তার স্ত্রী ফরিদা আক্তারের বিরুদ্ধে প্রসিকিউশন মামলা দায়েরের অনুমতি চান।
গত ০৭ ডিসেম্বর মিথ্যা তথ্য দিয়ে মামলা করায় দণ্ডবিধির ২১১ ও ১০৯ ধারায় বাদিনী ফরিদা আখতার ও ফরহাদ মজহারের বিরুদ্ধে প্রসিকিউশন মামলা দাখিলের অনুমতি দিয়েছেন আদালত।
মামলার চূড়ান্ত প্রতিবেদনের বিরুদ্ধে নারাজি দাখিলে বাদিনী ফরিদা আখতারের সময়ের আবেদন নামঞ্জুর করে ঢাকার মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট খুরশিদ আলমের আদালত এ অনুমোদন দেন।
মিথ্যা মামলা দিয়ে হয়রানি করার অভিযোগ প্রমাণিত হলে দণ্ডবিধির ২১১ ধারায় ২ বছরের সশ্রম বা বিনাশ্রম কারাদণ্ড বা জরিমানা বা উভয় ধরনের শাস্তির বিধান রয়েছে।
বাংলাদেশ সময়: ২০৪০ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ০৯, ২০১৭
পিএম/এএসআর