কথাগুলো বলতে গিয়ে কেঁদে ফেললেন ৭১’র গেরিলা মুক্তিযোদ্ধা আফতাব আলী।
১৯৭১ সালের ২৬ নভেম্বর কুষ্টিয়ায় সর্ববৃহৎ গেরিলা যুদ্ধের সময় তার সহযোদ্ধা হাবিবুর শহীদ হওয়া ও সেদিন কি ঘটেছিলো সে সম্পর্কে বাংলানিউজকে জানালেন দৌলতপুর উপজেলার আড়িয়া ইউনিয়নের শেরপুর গ্রামের মুক্তিযোদ্ধা আফতাব আলী।
তিনি বলেন, সেদিন আমরা মাত্র ১০ জন গেরিলা মুক্তিযোদ্ধা অবস্থান করছিলাম শেরপুর গ্রামে। আমাদের অবস্থান পাকবাহিনীর হানাদাররা আঁচ করতে পেরে যায়। ঠিক মধ্য রাতে শেরপুর গ্রামের এক পাশ থেকে আগুন ধরিয়ে দিতে দিতে আমাদের দিকে আসতে শুরু করে তারা। সেই সঙ্গে বেপরোয়াভাবে গুলিবর্ষণ করতে থাকে। তখন আমরা যে ১০ জন গেরিলা মুক্তিযোদ্ধা ছিলাম আমাদের সিদ্ধান্ত হয় যে, আমরা তাদের সঙ্গে যুদ্ধ করবো।
তবে আমাদের তো সম্মুখযুদ্ধের ট্রেনিং ছিলো না। আমরা চুপি চুপি গিয়ে এক-দুইজনকে মেরে পালিয়ে আসতাম। তবে যখন আর উপায় ছিলো না তখন আমরা সম্মুখযুদ্ধ করারই সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম। তিনজন করে ভাগ হয়ে গিয়েছিলাম আমরা। শেরপুর মাঠের মধ্যে অবস্থান নিয়েছিলাম আমি আর হাবিবুর। আমার হাতে একটা এসএমজি আর হাবিবুরের হাতে আরেকটা। আমাদের টার্গেট ছিলো গুলি করতে করতে পিছু হটবো। ১০ জন মিলে এদিক ওদিক থেকে আমরা ফায়ার করবো। যাতে আমরা কতজন আছি তা বুঝতে না পারে শত্রুরা।
হাবিবুর আমাকে বললো একটা উঁচু জমির আইল পেয়েছি। এখান থেকেই আমি গুলি করবো। আমি বললাম ঠিক আছে তবে বেশি সামনে জাস না। তাই বলে আমি ফায়ার করছিলাম। আশপাশ থেকেও ফায়ার করছিলো কয়েকজন। হঠাৎ একটা বুলেট এসে হাবিবুরের কপালে লাগলে ‘মরে গেলাম’ বলেই মাটিতে পড়ে গেল সে। কি করবো আমি আর ভেবে পাচ্ছিলাম না। বৃষ্টির মতো গুলি আর বোমা ফাটছিলো। বোমার বারুদ এসে পিঠে লাগে আমার। সেই দাগ এখনো রয়েছে।
তারপর আমি ফায়ার করা বন্ধ করে হাবিবুরকে সেখানে রেখে হামাগুঁড়ি দিতে দিতে পেছনের দিক দিয়ে পালিয়ে গেলাম। তখনও যুদ্ধ চলছে। এর মধ্যে কুষ্টিয়া ই-৯ এর গ্রুপ কমান্ডার আফতাব উদ্দিন খাঁন প্রায় ১শ’ জন সুসজ্জিত মুক্তিবাহিনীর একটি দল নিয়ে আমাদের সঙ্গে যোগ হলো। মনে তখন একটু সাহস পেলাম। হাবিবুরকে হারানোর ব্যথা বুকে রাগ হয়ে জেগে উঠলো।
কিছুক্ষণ পরে দেখা গেলো সাধারণ জনতা আমাদের সাহায্য করার জন্য লাঠি, ঝাড়ু, কোদাল, লাঙল ইত্যাদি নিয়ে এগিয়ে এসেছে। তারা জোরে জোরে চিৎকার করছিলো। তখন হানাদার বাহিনী মনে করেছিলো সবাই মুক্তিযোদ্ধা। তাতে তারাও ভয় পেয়ে গিয়েছিলো। আমি হাবিবুরের হত্যার প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য মরিয়া হয়ে উঠলাম। দেখলাম যেই হানাদার হাবিবুরকে গুলি করেছিলো সে তখনো গমের জমিতে শুয়ে গুলি করছে। তার হাতে রয়েছে একটা এসএলআর। আমি জীবনের মায়া ত্যাগ করে তাকে হত্যা করার জন্য গেলাম। পেছন থেকে গিয়ে রাইফেলের বাট দিয়ে তার মাথায় আঘাত করতে থাকলাম। মাথা থেতলে গেল তার।
ইতোমধ্যেই মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে পরাজিত হয়ে গিয়েছিলো হানাদার বাহিনী। সেখান থেকে আমরা ৪টি এলএমজিসহ ১০৫টি অস্ত্র উদ্ধার করি।
আফতাব আলী আরো বলেন, সেদিনের সেই ঘটনার কথা নতুন প্রজন্মের কাছে তুলে ধরা দরকার। হাবিবুর যেখানে শহীদ হয়েছিলো সেই স্থানটুকু সংরক্ষণ করা দরকার। আমার মনে হয় যখন আমি এই জমির আইল (যেখানে হাবিবুর শহীদ হয়েছিলো) দিয়ে হাঁটি তখন হাবিবুর আমাকে ডাকে। বলে বন্ধু তোরা কি করলি আমার জন্য। তোদের জন্যই তো আমি জীবন দিলাম।
তিনি আরো বলেন, যুদ্ধের এত বছর পার হয়ে গেলেও আজ অবধি শেরপুর মাঠের এই যুদ্ধ ক্ষেত্রটি সংরক্ষণ করা কিংবা একটি মাত্র ফলকও তৈরি করা হয়নি। সেদিন হয়তো প্রাণে বেঁচে গিয়েছিলাম আমি। তবে আজো আমি হাবিবুরের স্মৃতির কাছে মৃত হয়ে জীবনযাপন করছি।
কুষ্টিয়া জেলা মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার নাছিম উদ্দিন জানান, কুষ্টিয়া জেলায় মোট ৭৬টি যুদ্ধক্ষেত্র, বধ্যভূমি ও গণকবর রয়েছে। ইতোমধ্যে বেশ কয়েকটি গণকবর ও বধ্যভূমি সংরক্ষণ করা হয়েছে। বাকীগুলো এখনো অরক্ষিত ও অবহেলায় রয়েছে।
আমরা যুদ্ধক্ষেত্রগুলো সংরক্ষণের জন্য উদ্যোগ গ্রহণ করেছি। খুব শিগগিরই সেগুলো সংরক্ষণ করা হবে।
বাংলাদেশ সময়: ১২৩৭ ঘণ্টা, ১১ ডিসেম্বর, ২০১৭
আরএ