ঢাকা, সোমবার, ১০ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৫ নভেম্বর ২০২৪, ২৩ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

জাতীয়

‘বাড়ি ফিরে দেখি শুধু লাশের হাড়-হাড্ডি আর মাথার খুলি’

| বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৫০০ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ১৪, ২০১৭
‘বাড়ি ফিরে দেখি শুধু লাশের হাড়-হাড্ডি আর মাথার খুলি’ তৎকালীন আমলা আর্মি ক্যম্প দেখাচ্ছেন বীর মুক্তিযোদ্ধা মোহাম্মদ আলী। (বর্তমানে আমলা সরকারী ডিগ্রি কলেজের বিজ্ঞান ভবন)

কুষ্টিয়া: গৌরবময়, মহান স্বাধীনতাযুদ্ধের পর ৪৬ বছর পার হয়ে গেছে। অর্ধ শতাব্দী পার হতে বাকি মাত্র ক’টা বছর। কিন্তু আজও অরক্ষিত হয়ে পড়ে আছে কুষ্টিয়ার মিরপুর উপজেলার ‘’আমলার বধ্যভূমি”। ১৯৭১ সালে যে বর্বর নির্যাতন চালিয়েছিল পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী তার প্রমাণ মেলে এই বধ্যভূমিতে। সহস্রাধিক নিরস্ত্র বাঙ্গালির লাশের স্তুপ করা ছিল সেখানে অরক্ষিত অবস্থায়। বর্তমানে মাছের চাষ হচ্ছে সেখানে।

৭১’র সেই স্মৃতি আর নিজের চোখে দেখা সেই ভয়ানক নৃশংসতার সেইসব হৃদয়বিদারক ঘটনা আজও তাড়া করে বেড়ায় এলাকার বীর মুক্তিযোদ্ধাদের। সেই সাথে বধ্যভূমিটাকে অরক্ষিত অবস্থায় পড়ে আছে দেখে বেদনার্ত, ক্ষুব্ধ তারা।

নতুন প্রজন্ম এই বধ্যভূমি ও গৌরবের মুক্তিযুদ্ধকে কতটা সঠিকভাবে জানতে পারছে, এ নিয়ে সন্দিহান তারা। তৎকালীন আমলা মুজাহিদ ক্যম্প দেখাচ্ছেন বীর মুক্তিযোদ্ধা মোহাম্মদ আলী।                                          (বর্তমানে আমলা সরকারী ডিগ্রি কলেজের প্রশাসনিক ভবন)উপজেলার আমলায় ৭১-এর এই বধ্যভূমি সম্পর্কে বলতে গিয়ে ডুকরে কেঁদে উঠলেন স্বাধীনতাযুদ্ধের বীর, গেরিলা মুক্তিযোদ্ধা মোহাম্মদ আলী।  

মোহাম্মদ আলী বাংলানিউজকে বলেন, সেসময় আমলায় ছিলো পাকিস্তানি আর্মি, মুজাহিদ ও রাজাকারদের ক্যাম্প। এই  অঞ্চলে তাদের একমাত্র ঘাঁটি ছিলো আমলা। আশেপাশের বিভিন্ন এলাকা থেকে সাধারণ, নিরীহ মানুষকে ধরে নিয়ে এসে নির্মম নির্যাতন করতো পাকিস্তানি বাহিনী। তাদের সাথে যোগ দিয়ে এলাকার কিছু দালাল, আল বদর ও তাদের সহযোগীরা সাধারণ মানুষকে ধরে নিয়ে আসতো। তাদের ওপর নির্মম অত্যাচার চালানো হতো। অত্যাচার করতে করতে এসব নিরীহ নিরপরাধ মানুষগুলোকে মেরে ফেলা হতো। লাশগুলো নিয়ে গিয়ে ফেলে দিত আমলা সদরপুর হাইস্কুলের পাশে। তৎকালীন আমলা রাজাকারদের টর্চার দেখাচ্ছেন বীর মুক্তিযোদ্ধা মোহাম্মদ আলী।  (বর্তমানে আমলা সরকারী ডিগ্রি কলেজের শিক্ষকদের বাসভবন)তিনি আরো জানান, বর্তমানে যেখানটায় আমলা সরকারী কলেজ, সেখানেই ছিল রাজাকারদের ঘাঁটি। পরিত্যক্ত বাড়ি ও নির্জন এলাকা হওয়ায় এখানেই ক্যাম্প গেড়েছিল এইসব মানুষরূপী পশুর দল। বর্তমানে যেটি আমলা সরকারী কলেজের বিজ্ঞান ভবন, সেটি ছিল রাজাকারদের ১নম্বর ক্যাম্প। বাইরের এলাকা থেকে সাধারণ মানুষদের ধরে নিয়ে এই ক্যাম্পে রাখা হতো। তাদের জিজ্ঞাসাবাদ করা হতো। এরপর চলতো পৈশাচিক অত্যাচার। যাদেরকে ওদের কাছে ভালো মনে হতো, পাকিস্তানপন্থি মনে হতো কেবল তাদেরকেই ছেড়ে দেয়া হতো। আর যাদেরকে ওরা তা মনে করতো না, তাদেরকে পাঠিয়ে দিতো ২নং ক্যাম্পে। তৎকালীন আমলা রাজাকারদের লালঘর দেখাচ্ছেন বীর মুক্তিযোদ্ধা মোহাম্মদ আলী।  (বর্তমানে আমলা সরকারী ডিগ্রি কলেজের শিক্ষকদের বাসভবন)২নং ক্যাম্প ছিল বর্তমানে যেখানটায় আমলা সরকারী কলেজের প্রশাসনিক ভবন। এই ক্যাম্পে যাদের নিয়ে যাওয়া হতো তাদের ওপর চলতো ভয়াবহ নারকীয় অত্যাচার। এই ক্যাম্পের পিছনে বর্তমানে যেটা আমলা সরকারী কলেজের শিক্ষকদের বাসভবন সেখানে ছিলো তাদের টর্চার সেল। সেখানে টর্চার করে যাদের মেরে ফেলবে বলে ঠিক করতো, তাদের নিয়ে যেত লাল সেলে।  
লাল সেলে যাদের নিয়ে যেত তারা আর প্রাণ রক্ষা পেত না। সেখানেই তাদের হত্যা করা হতো। আমলার অরক্ষিত বধ্যভূমি দেখাচ্ছেন বীর মুক্তিযোদ্ধা মোহাম্মদ আলী।  (বর্তমানে মাছ চাষ হচ্ছে)বীর এই যোদ্ধা আরো জানান, সেসময় তারা মুক্তিবাহিনী ও তাদের পরিবার-পরিজনদের ওপরেই সবচে বেশি অত্যাচার করতো। যে গ্রামে মুক্তিবাহিনীর লোক আছে বলে খবর পেতো, সেই গ্রামেই নির্বিচারে আগুন ধরিয়ে দিতো হানাদার সেনারা। সেসময় পাকিস্তানি হানাদাররা সাধারণ মানুষকে হত্যা করতো অথচ কবর দিতো না। পানিতে ভাসিয়ে দিতো অথবা মাটির ওপরে ফেলে রাখতো শেয়াল-কুকুরের খাদ্য হিসেবে। আমলাতে যাদের মেরে ফেলতো তাদের নিয়ে গিয়ে আমলা হাইস্কুলের পাশে ফেলে রাখতো ওরা। সেখানে শেয়াল, কুকুরের দল লাশগুলোকে টেনে-ছিঁড়ে খুবলে খেতো। এভাবে এখানে পাহাড় সমান লাশের স্তুপ তৈরি হয়েছিল।

‘যুদ্ধ শেষ করে যখন বাড়ি ফিরে আসি তখন দেখি এখানে শুধু লাশের হাড়-হাড্ডি আর শত শত মাথার খুলি পড়ে রয়েছে’-- আক্ষেপ করে বলছিলেন তিনি।  

‘মুক্তিযুদ্ধের ৪৬ বছর পার হলেও আজও এই বধ্যভূমিটা সংরক্ষণ করা হয়নি। এর পাশ দিয়ে গেলে আমার মনে হয় যারা শহীদ হয়েছিল তারা আমাদের ডাকছে। এমনকি বধ্যভূমিটা বর্তমানে রাজাকার সমর্থকদের দখলে রয়েছে। সেখানে এখন মাছ চাষ করছে তারা। যারা মুক্তিযুদ্ধ দেখেনি, এই বধ্যভূমিটাসহ যুদ্ধের স্মৃতিময় স্থানগুলো সংরক্ষণ না করলে তারা মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে সঠিক তথ্য জানতে পারবে না। তাই এই বধ্যভূমিটার দ্রুত সংরক্ষণ করা দরকার। এর আগে আমি মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ে এই বধ্যভূমিটি সংরক্ষণের জন্য আবেদন করেছি। কিন্তু তাতে কোনো কাজ হয়নি। তাই আবারও দ্রুত সংরক্ষণের জন্য কর্তৃপক্ষের কাছে অনুরোধ জানাচ্ছি। ‘আমলার অরক্ষিত বধ্যভূমি। কুষ্টিয়া জেলা মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডের কমান্ডার নাছিম উদ্দিন বাংলানিউজকে জানান, কুষ্টিয়া জেলায় মোট ৭৬টি যুদ্ধক্ষেত্র, বধ্যভূমি ও গণকবর রয়েছে। এরই মধ্যে বেশ কয়েকটি গণকবর ও বধ্যভূমি সংরক্ষণ করা হয়েছে। বাকিগুলো এখনো অরক্ষিত অবস্থায়, অনাদরে অবহেলায় পড়ে রয়েছে। বাকিগুলো সংরক্ষণের জন্য পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়েছে। খুব দ্রুত সেগুলোকেও সংরক্ষণ করা হবে।  

বাংলাদেশ সময়: ১১০২ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ১৪, ২০১৭
জেএম

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।