মুক্তিযুদ্ধে তার ত্যাগের স্বীকৃতি হিসেবে তার নামে বরাদ্দ দেয়া খাস জমি এখন স্থানীয় প্রভাবশালীদের দখলে। নতুন করে জমি বরাদ্দের আবেদন করা হলেও এ বিষয়ে কোন অগ্রগতি নেই।
সব মিলিয়ে নাজুক জীবন যাপন করছেন মৃত্যুর প্রহর গুণতে থাকা বীরকন্যা খঞ্জনী। অথচ নিজের সম্ভ্রমের বিনিময়ে চৌদ্দগ্রাম এলাকার সোনাপুর গ্রামের নারীদের সম্ভ্রম রক্ষা করেছিলেন তিনি।
১৯৩৯ সালে ফেনী জেলার বরইয়া চৌধুরীবাড়ি গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন খঞ্জনী বেগম। ১৯৬৩ সালে কুমিল্লার চৌদ্দগ্রাম উপজেলার জগন্নাথদীঘি ইউনিয়নের সোনাপুর গ্রামের হেকমত আলীর সঙ্গে তার বিয়ে হয়। তাদের সংসারে রোকসানা ও আবদুল মতিন নামে দুই ছেলেমেয়ে জন্মগ্রহণ করে।
১৯৬৬ সালে চট্টগ্রাম রেলওয়ের বৈদ্যুতিক শাখায় কর্মরত থাকা অবস্থায় মারা যান তার স্বামী হেকমত আলী। স্বামী মারা যাওয়ার পর এতিম দুই ছেলেমেয়ে ও শাশুড়িকে নিয়ে স্বামীর বাড়িতেই রয়ে যান খঞ্জনী বেগম।
মুক্তিযুদ্ধের সময় জগন্নাথদীঘি এলাকার ক্যাম্প স্থাপন করে সেখানে স্থানীয় রাজাকারদের সহযোগিতায় এলাকার সুন্দরী মেয়েদের উঠিয়ে নিয়ে যেত হানাদার বাহিনী। এক পর্যায়ে স্থানীয় রাজাকারদের সহায়তায় ক্যাম্পের দায়িত্বরত পাক হাবিলদারের কাছে খবর পৌঁছে যায় সুন্দরী বিধবা খঞ্জনী বেগমের কথা। তাকে পাক হাবিলদারের হাতে তুলে দিলে গ্রামের অন্য নারীদের ওপর নির্যাতন করা হবে না এমন শর্তে স্থানীয় কয়েকজন রাজাকার খঞ্জনীকে হানাদারদের হাতে তুলে দেয়।
ওই ক্যাম্পে এই বীরকন্যার উপর চলে প্রতিনিয়ত পাশবিক নির্যাতন। তবে এর বিনিময়ে ১৬ ডিসেম্বরের আগ পর্যন্ত এ গ্রামের আর কোনো নারীকে সম্ভ্রম হারাতে হয়নি। যুদ্ধকালীন সময়ে সোনাপুর গ্রামসহ আশপাশের অসংখ্য গ্রামের অসহায় লোকজনকে পাক বাহিনীর চোখ ফাঁকি দিয়ে সামর্থ্য অনুযায়ী সাহায্য করেছেন এই খঞ্জনী বেগম।
১৬ ডিসেম্বর পাকিস্তানিদের ক্যাম্প থেকে মুক্ত হয়ে ছুটে যান তার শাশুড়ি,মেয়ে রোকসানা ও ছেলে মতিনের কাছে। কিন্তু ভাগ্যের নির্মম পরিহাস, যে গ্রামবাসীর জন্য খঞ্জনী বেগম ইজ্জত বিলিয়ে দিলেন তারাই তাকে অপবাদ দিলো নষ্টা নারীর।
বলতে লাগলেন, এই নষ্টা ও অসতী নারীকে সোনাপুরে জায়গা দেয়া যাবে না। গ্রামের সমাজের লোকেরা এক কাপড়ে গ্রাম থেকে বের করে দিলেন খঞ্জনী বেগমকে।
শাশুড়ির কাছে থাকা একমাত্র ছেলে আবদুল মতিন অভাব অনটনে মারা যায় ছয় বছর বয়সে। মৃত ছেলেকেও দেখতে দেয়া হয়নি খঞ্জনী বেগমকে। এভাবে এক সময় তিনি মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলেন। মানসিক ভারসাম্যহীন অবস্থায় যুদ্ধের পর প্রায় ৩০ বছর রাস্তায় রাস্তায় ভিক্ষা করে দিন কাঁটিয়েছেন খঞ্জনী।
আফিয়া খাতুন খঞ্জনীর মেয়ে রোকসানা বেগমের বিয়ে হয় ফুল মিয়া নামক এক শ্রমজীবীর সঙ্গে। মায়ের সন্ধান পেয়ে বিগত ৫ বছর পূর্বে মাকে নিজের কাছে নিয়ে আসেন রোকসানা। সেই থেকে শহরের পূর্ব বাগিচাগাঁওয়ের বস্তির দু’কক্ষের একটি খুপড়ি ঘরে থাকেন খঞ্জনী বেগম।
তবে শেষ পর্যন্ত ২০১৬ সালের ২৩ নভেম্বর মুক্তিযোদ্ধা স্বীকৃতি পান খঞ্জনী বেগম।
এ স্বীকৃতির পর তৎকালীন জেলা প্রশাসক হাসানুজ্জামান কল্লোল তাকে চৌদ্দগ্রামের কালকোট এলাকায় ৫ শতক খাস সম্পত্তি বরাদ্দ দেন।
খঞ্জনীর মেয়ে রোকসানা জানান, চৌদ্দগ্রামের খাস জায়গা ওই গ্রামের খবির আলম নামের এক প্রভাবশালী জোরপূর্বক দখল করে আছে। তাই কুমিল্লা নগরীর পূর্ব বাগিচাগাঁও ভূতের গলিতে খাস জমি বরাদ্দের জন্য আবেদন করেছি। গত ৫/৬ মাস ধরে জেলা প্রশাসন কার্যালয়, ভূমি অফিস আসা-যাওয়া করছি। কিন্তু এখনো বরাদ্দ পাইনি। সংশ্লিষ্ট দফতর যদি একটু আমাদের বিষয়ে সুনজর দিত তাহলে আমার মা শেষ জীবনটা একটু ভালোভাবে কাটাতে পারতো।
জেলা মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার শফিউল আহমেদ বাবুল জানান, বীরকন্যা খঞ্জনী বেগমের জন্য সরকারি বরাদ্দকৃত চৌদ্দগ্রামের খাসজমিটা দখলমুক্ত করার জন্য আমি সর্বোচ্চ চেষ্টা করেছি। পুলিশ পাঠিয়েছি সেখানে। কিন্তু ভূমিদস্যুরা খুবই শক্তিশালী। তাই সম্ভবপর হয়নি জায়গাটা দখলমুক্ত করা। এখন যদি কোন নতুন জায়গার জন্য খঞ্জনী বেগম আবেদন করে থাকে তাহলে আমি সহায়তা করবো।
বাংলাদেশ সময়: ১৪০০ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ১৫, ২০১৭
আরআই