সংশ্লিষ্টরা বলছেন, কক্সবাজারে আশ্রয় দেওয়া হলেও শুরু থেকেই বাংলাদেশের দাবি ছিল নিরাপদে রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নেওয়ার বিষয়টি। নানা আলোচনা-বৈঠকের পর যেভাবে প্রক্রিয়া এগোচ্ছে তাতে কী শেষ পর্যন্ত নির্বিঘ্নে নিজ দেশে ফিরতে পারবে রোহিঙ্গারা? এমনই প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে!
গত বছরের ২৫ আগস্ট থেকে মিয়ানমার সেনাবাহিনী রাখাইনে ‘জাতিগত নির্মূল অভিযান’ শুরু করলে নতুন করে সাড়ে ছয় লাখের বেশি রোহিঙ্গা নাফ নদী পেরিয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়।
এরপর নানা কূটনৈতিক চাপের পর ২৩ নভেম্বর মিয়ানমারের রাজধানী নেপিদোতে দুই দেশের মন্ত্রী পর্যায়ের বৈঠকে রোহিঙ্গাদের ফেরত নেওয়ার বিষয়ে একটি সমঝোতা সই হয়।
সমঝোতা অনুযায়ী, ২ মাসের মধ্যে রাখাইনের নিজ ভূমিতে রোহিঙ্গাদের ফেরত নেওয়ার প্রক্রিয়া শুরু করার কথা। চলতি মাসের ১৫ জানুয়ারি চুক্তি অনুযায়ী গঠিত ‘যৌথ ওয়ার্কিং গ্রুপে’র প্রথম বৈঠক হবে।
পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী মো. শাহরিয়ার আলম বাংলানিউজকে বলেন, যে টাইমফ্রেম দেওয়া হয়েছে সে অনুযায়ী কাজ হবে। রোহিঙ্গাদের সংখ্যা এখন দশ লাখ। প্রায় সবারই নিবন্ধন হয়েছে। রোহিঙ্গা প্রসঙ্গে যেটি আমরা সব সময় বলেছি ‘ফিজিক্যাল অ্যারেঞ্জমেন্ট’ চুক্তি অনুযায়ী মানুষ ফেরত যাবে।
‘তবে অব্যাহতভাবে আন্তর্জাতিক চাপ থাকলেও বিশেষ করে জাতিসংঘ নিরাপত্তা কাউন্সিল রেজ্যুলেশন পাস করতে ব্যর্থ হয়েছে। কিন্তু জেনারেল হাউজে এটির বিরুদ্ধে অবস্থান নেওয়া হয়েছে। ’
তিনি বলেন, জাতিসংঘ রোহিঙ্গাদের ফেরত পাঠানোর প্রক্রিয়ায় সম্পৃক্ত থাকবে সে বিষয়ে আলোচনা হয়েছে। এ বিষয়ে বাইরে থেকে অনেকে শঙ্কা প্রকাশ করেন। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নিজে থেকেই বলেছেন, রোহিঙ্গাদের ফেরত যেতে হবে নিরাপদ, নির্বিঘ্নে, মর্যাদাপূর্ণ ও নিজ ইচ্ছায়।
পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী বলেন, রোহিঙ্গাদের নিরাপদে ফেরাতে বাংলাদেশ সব ধরনের চেষ্টা করছে ও অ্যারেঞ্জমেন্টেও তা বলা আছে। এ নিয়ে অন্য কোনো দেশ বা অন্য কারও এত চিন্তিত হওয়ার কারণ নেই। তাছাড়া বিশ্বের ১০০ শতাংশ দেশ বাংলাদেশের এ আশ্রয় দেওয়াকে সাধুবাদ জানিয়েছে।
অতীতের অভিজ্ঞতায় রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসন নিয়ে শঙ্কা প্রকাশ করেছেন সাবেক পররাষ্ট্র সচিব মো. তৌহিদ হোসেন। বাংলানিউজকে তিনি বলেন, ‘যৌথ কমিটির কার্যকলাপের মাধ্যমে বিপুল সংখ্যক রোহিঙ্গা মিয়ানমারে ফেরত যাবে এ বিষয়ে আমি ব্যাক্তিগতভাবে আশাবাদী নই। টোকেন সংখ্যক কিছু যেতে পারে। অন্যদিকে জানতে পেরেছি প্রাথমিকভাবে টার্গেট করা হয়েছে লাখ-খানেক। ’
‘যদি এক লাখ টার্গেট করা হয় তাহলে বাকি ন’লাখ কোথায় যাবে? তারা তো থেকে যাচ্ছে। এ রকম টার্গেট করলে বাকিদের নিয়ে আমরা কী করবো? দ্বিতীয় প্রশ্ন হলো- এক লাখ কতদিনে ফেরত যাবে? এক লাখ ফেরত পাঠাতে যদি এক/দুই বছর লাগে তাহলে? আর তখন বাকি লোকগুলোকেও যদি মিয়ানমার নিতে রাজিও হয়, সব রোহিঙ্গা পাঠাতে কত সময় লাগবে তা ভেবে দেখার সময় এসেছে!’
সাবেক কূটনীতিক তৌহিদ হোসেন বলেন, রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব দেওয়ার বিষয়ে এখনও রাজি নয় মিয়ানমার। মূল প্রসঙ্গগুলো সমাধান হবে বলে মনে হচ্ছে না। সেক্ষেত্রে এটি আইওয়াশ হচ্ছে যে ‘মিয়ানমার কিছু লোক নিচ্ছে। ’
‘কালক্ষেপণ, হতাশাব্যঞ্জকের দিকেই চিন্তাটা যায় কারণ অতীতে এই হয়ে আসছে। এরমধ্যে এবার হয়েছে সবচেয়ে খারাপ পরিস্থিতি। এ জন্য আমি আশাবাদী হওয়ার কোনো কারণ দেখছি না। তারপরও দেখা যাক কতটুকু কী সাফল্য অর্জন করতে পারি। ’
তিনি বলেন, মিয়ানমারকে সরাসরি বলতে হবে, রোহিঙ্গাদের মিয়ানমার কী স্ট্যাটাস দেবে সেটা তোমাদের বিষয়। মূল কথা হল- সবাইকে ফেরত নিতে হবে। কিন্তু এদের (রোহিঙ্গা) মৌলিক মানবাধিকার যেন লঙ্ঘিত না হয় তা দেখতে হবে।
তৌহিদ হোসেন বলেন, তাদের (রোহিঙ্গা) জোর করে ফেরত পাঠানো যাবে না। তবে মিয়ানমারে ন্যূনতম নিরাপদ পরিস্থিতি সৃষ্টি না হলে রোহিঙ্গারা এদেশ থেকে ফিরে যাবে বলে আমি মনে করি না।
‘তবে কেউ যদি ফেরত যেতে না চায়- তাদের জোর করে ফেরত পাঠালে আশ্রয় দিয়ে যে সুনাম অর্জন করেছেন তা একদিনে ধুলিস্যাৎ হয়ে যাবে। আর জোর করে তাদের পাঠাবেন কোথায়? মিয়ানমারই তো বারবার বলছে তাদের স্বেচ্ছায় রাখাইনে ফেরত আসতে হবে ‘ যোগ করেন সাবেক এই কূটনীতিক।
বাংলাদেশ সময়: ০৩০০ ঘণ্টা, জানুয়ারি ০৮, ২০১৮
কেজেড /এমএ