বাঙালির ভাত-মাছের পরিচয় মানেই ইলিশ। পাশের দেশ ভারতের কলকাতায় গেলে সেখানকার মানুষের সঙ্গে আলাপের প্রথমধাপে প্রশ্ন ছুড়ে দেন- দাদা ইলিশ কেমন খাচ্ছেন? আমরা পদ্মার মতো স্বাদের ইলিশ তো পাই না।
ইলিশ দিয়েই পদ্মা পাড়ের বাঙালিকে চিনে নেয় বিশ্ববাসীও। দেড় যুগ আগে প্রচুর ইলিশ রফতানি হতো ভারতসহ বিদেশের বাজারগুলোতে। কিন্তু যথেচ্ছারভাবে মা ইলিশ ও জাটকা শিকারের কারণে ইলিশের ধস নামে।
সরকার বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে আমলে নিয়ে শুরু করে নানা কর্মসূচি। কীভাবে ইলিশ রক্ষা করে ধনী-গরিব সবার পাতে পৌঁছে দেওয়া যায় জিহ্বায় জল আনা এ মাছটি। শুরু হয় ডিম পাড়ার সময় ইলিশ শিকারে নিষেধাজ্ঞা। নিষিদ্ধ করা হয় খোকা ইলিশ (জাটকা) ধরায়।
যেহেতু মা থেকে জাটকা ইলিশ শিকার নিষিদ্ধ, সেজন্য এ সময়টাতে জেলেদের বিশেষ খাদ্য কর্মসূচির আওতায় আনা হয়। যেন একেবারে অভুক্ত না থাকেন জেলে পরিবারগুলো।
মৎস্য অধিদফতরের জাটকা সংরক্ষণ, জেলেদের বিকল্প কর্মসংস্থান ও গবেষণা প্রকল্পের পরিচালক এবিএম জাহিদ হাসান বাংলানিউজকে বলেন, ইলিশ নিয়ে মৎস্য অধিদফতর যে কর্মসূচি চালু করেছিল তা আজ সাফল্যের দোর গোঁড়ায়। আমরা আশার আলো দেখতে শুরু করেছি। ইলিশ শুধু হারিয়ে যাওয়া থেকে রক্ষাই নয়, এর বংশবৃদ্ধি করে দেশের মানুষের পাতে সহজলভ্য করে দেওয়ার উদ্যোগ নিয়েছে মৎস্য অধিদফতর।
তিনি বাংলানিউজকে জানান, ২০১৭ সালে পাঁচ লাখ মেট্রিকটন ইলিশ উৎপাদিত হয়েছে। ২০১৮ সালে উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে সাড়ে পাঁচ লাখ মেট্রিকটন। ২০১৬ সালে ইলিশ মিলেছে চার লাখ মেট্রিকটন। ২০০৯ সালে ইলিশের উৎপাদন ছিল ২ লাখ ৯৮ মেট্রিকটন। ২০১৪-১৫ সালে সে উৎপাদন বেড়ে দাঁড়ায় ৩ লাখ ৮৫ হাজার মেট্রিকটনে।
২০০৯ সাল থেকে সাগর-নদী বিধৌত উপকূল চাঁদপুর, লক্ষ্মীপুর, ভোলা, পটুয়াখালীর ২১ উপজেলার জাটকা নিধন বন্ধ, মা ইলিশ রক্ষা ও ইলিশের বংশ বিস্তারের জন্য ব্যাপক প্রচারণা চালানো হয়।
পরবর্তীতে এ কর্মসূচি ছড়িয়ে দেওয়া হয় দেশের ২৫ জেলার ১৩৬টি উপজেলায়। তার সুফল এখন আমাদের হাতে। ভোলা থেকে রাজশাহী পর্যন্ত ইলিশ বিচরণ ক্ষেত্র গড়ে তোলার প্রচেষ্টা সাফল্যের মুখ দেখতে শুরু করেছে। জানান তিনি।
জাহিদ হাসান বলেন, দেশের সব নদ-নদী-জলাশয়ে মা ইলিশ রক্ষা পর এখন চলছে জাটকা শিকার নিষিদ্ধ কর্মসূচি। ১৫ জানুয়ারি থেকে ৩১ জানুয়ারি অবধি নদ-নদীতে ইলিশ শিকার নিষিদ্ধ। এ সময় শুধু জাটকা শিকারই নয়, বিক্রির জন্য হাটে-বাজারে তোলা বা সংরক্ষণ করা আইনত দণ্ডনীয় অপরাধ। নভেম্বর থেকে জানুয়ারি পর্যন্ত তিন মাস অভয়াশ্রমে জাটকাসহ (ইলিশের পোনা- ২৫ সে.মি. দৈর্ঘ্য পর্যন্ত) সব ধরনের মৎস্য আহরণ নিষিদ্ধ। এসব কার্যক্রমের ফলে দেশে বড় আকারে ইলিশের উৎপাদন বেড়েছে।
এছাড়া মৎস্য আহরণ নিষিদ্ধ থাকার সময় ক্ষতিপূরণ/প্রণোদনা হিসেবে ভিজিএফ কর্মসূচির আওতায় প্রতি মৎস্যজীবী পরিবারকে মাসে ৪০ কেজি হিসেবে ৪ মাস চাল দেওয়া হচ্ছে। তাদের মধ্যে ৮০ কেজি করে চাল দেওয়ার প্রস্তাব পাঠানো হয়েছে। পাশাপাশি মৎস্য অধিদফতরের জাটকা সংরক্ষণ প্রকল্পের মাধ্যমে হতদরিদ্র মৎস্যজীবীদের বিকল্প কর্মসংস্থান করা হচ্ছে।
গত দু’বছর বাংলাদেশে বেশ ইলিশ মিলেছে। অবশ্য অনেকের আক্ষেপ ছিল, এতো ইলিশ, তবু দাম অনেকের নাগালের বাইরে। বিশেষ করে এক কেজির কাছের ইলিশ হাজারের নিচে পাওয়া যায়নি।
গত বছর পথে-ঘাটে-বাসে, পাড়ায়-মহল্লায় সর্বত্র ইলিশের ব্যাপকতা সত্ত্বেও শুধু মধ্যস্বত্ত্বভোগীদের কারণে ইলিশের দামটা মানুষের নাগালের মধ্যে আসেনি তেমনভাবে। এসময় পত্র-পত্রিকা খুললেই খবর মিলেছে পাইকারি বাজারে ইলিশের ছড়াছড়ি।
আড়তদারদের অভিযোগ ছিল, ইলিশের আমদানি আছে বটে কিন্তু চাহিদা মতো বরফ পাওয়া যাচ্ছে না। আড়তদাররা জানান, ইলিশ সংরক্ষণের ব্যয় বেড়ে যাওযায় দাম কমানো যায়নি। অপরদিকে মৎস্যজীবীরা জীবন-প্রাণ বাজি রেখে ইলিশ ধরেও ন্যায্য দাম থেকে বঞ্চিত।
২০১৫ সালে ফেব্রুয়ারিতে ঢাকা সফরকালে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে বৈঠককালে ইলিশ রফতানির অনুরোধ জানিয়েছিলেন। এভাবে উৎপাদন বাড়তে থাকলে আবার রফতানির সুদিনে ফিরবে বাংলাদেশ।
বাংলাদেশ সময়: ০৮৫৮ ঘণ্টা, জানুয়ারি ১৯, ২০১৮
এসএস/এএ