বৃহস্পতিবার (১৮ জানুয়ারি) দুপুরে টুকু মিয়ার সঙ্গে দেখা হয় গুলশানে। এই শহরে একসঙ্গে এতো উন্নয়ন কাজ গত প্রায় ৪৭ বছরে দেখা যায়নি।
টুকু মিয়া বাংলানিউজকে বলছিলেন, ‘শুধু এই পথগুলো নয়, রমনা বা বাংলামোটরের অনেক ফুটপাতগুলো এমনভাবে আটকে রাখা হয়েছে যেন, মোটসাইকেল ফুটপাতে উঠতে না পারে। কিন্তু তাতে কেবল মোটরসাইকেল নয়, আমাদের মতো হুইলচেয়ারে চলা ব্যক্তিরাও চলতে পারেন না। ’
৬১ বছর বয়সী টুকু মিয়া বলেন, ‘একসময় কাঠের স্ট্রেচার ব্যবহার করে চলাফেরা করতাম। বিভিন্ন স্থানে ফুটপাতে হকারি করতাম। কিন্তু বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে এখন আর পারি না। গত তিন বছর ধরে হুইলচেয়ার ব্যবহার করি। এখন যাতায়াত আরও কঠিন হয়ে পড়েছে। এই দেশে বাসে, ট্রেনে, সিএনজিতে কোথাও ওঠা যায় না। রিকশা সব রাস্তায় চলেও না। ’
তবে অনেক রিকশাওয়ালা টুকুদের মতো প্রতিবন্ধীদের তার বাহনে ওঠান এবং নিজেরাও হুইলচেয়ার ওঠাতে সাহায্য করেন বলে জানান তিনি।
টুকু মিয়া বলেন, ‘যদি ফুটপাতগুলো ভাল হতো, তবে সবখানে গাড়ি ছাড়াও অনেকটুকু চলা যেতো। এখন গাড়ির পথ দিয়ে তো আর হুইলচেয়ার চালানো যায় না। আবার শহরের ফুটপাতগুলো এমনভাবেই উঁচু করা, যেন মোটরসাইকেল না উঠতে পারে। মোটরসাইকেল ঠেকাতে গিয়ে আমাদের মতো প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের কথা একবারও ভাবা হয়নি। ’টুকুর কথায় আক্ষেপ ঝরে, এই শহরের কোনো বাসে, ট্রেনে বা অন্য কোন যানবাহনে হুইলচেয়ার ওঠানোর ব্যবস্থা নেই। এখানকার বাসগুলো বাস স্টপেজে থামে না। ফুটপাতগুলোও বাসের দরজার মাপে করা হয়নি, এখানে সড়কে কোথাও এমন ব্যবস্থা রাখা হয়নি, যে অংশ দিয়ে প্রতিবন্ধী ব্যক্তিরা পার হতে পারবেন।
৮ বছর বয়স হতেই চোখে দেখতে পান না রাজীব আহমেদ। তিনি বাংলানিউজকে বলেন, ‘এ দেশের বাসগুলোতে নারী, শিশু ও প্রতিবন্ধীদের জন্য সংরক্ষিত নয়টি আসন রাখা হয়েছে। কিন্তু সেখানে কি নারী ছাড়া আর কাউকে বসতে দেওয়া হয়? আমাদের বাসে উঠতে দেওয়া হয় না। আরেকজনের সাহায্য ছাড়া কোনো বাসে ওঠা যায় না। সেখানে উঠলেও কেউ বলে না, বাসটি কোথায় এসেছে বা কতোদূর আছে। ’
তিনি বলেন, ‘গত দুই মাস ধরে শহরের ফুটপাতগুলোর এমন অবস্থা যে এখন চলাচলই বন্ধ করে দিয়েছি। কারণ আমাদের একটি মাপ আছে চলার। প্রতিদিনকার চলার পথের একটি ধারণা থাকে। কিন্তু এই শহরের পথের কোন ধারণা করা কঠিন। ’
এখানে সাদা ছড়ি কাজ করে না। ফুটপাতগুলোর উচ্চতা একস্থানে এক রকম। আবার বেশিরভাগ ফুটপাতেই হকার বসা। যেগুলোতে হকার নেই, সেখানে হয়তো ম্যানহোলের ঢাকনা ওল্টানো বা খাদ হয়ে আছে অথবা পাশের কোনো ভবন বা সড়কের নির্মাণ কাজের ইট-সুড়কি রাখা।
এই প্রসঙ্গটি টেনে রাজীব বলেন, ‘প্রতিনিয়ত আমাদের মতো অন্ধ ব্যক্তিরা বিভিন্ন স্থানে দুর্ঘটনার শিকার হন। এখানে কোথাও সড়ক পার হওয়ার ব্যবস্থা নেই। এমন কোনো সিগন্যাল নেই বা সিস্টেম দেওয়া নেই, যেখান থেকে আমরা পথ চলার নির্দেশনা পাবো। ’
দেশের সংবিধানের মৌলিক অধিকার অনুচ্ছেদে রাষ্ট্রের নাগরিক হিসেবে প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের অপ্রতিবন্ধী ব্যক্তির মতো সমান অধিকার ভোগ করার কথা বলা হয়েছে। কিন্তু এই সংবিধান প্রদত্ত অধিকারের দিকে কর্তৃপক্ষের কোনো খেয়াল নেই বলে আক্ষেপ আর অভিমান ঝরে টুকু মিয়া ও রাজীব আহমেদদের কণ্ঠে।
বাংলাদেশ সময়: ১৪২৪ ঘণ্টা, জানুয়ারি ২০, ২০১৮
এমএন/এইচএ/