চারিদিকে সবুজাভ, সাজানো-গোছানো বাগান। সেই বাগানে ফুটে আছে, গাঁদা, ডালিয়া, চন্দ্রমল্লিকা, কসমস, ক্যালেন্ডুলাসহ নানা প্রজাতির ফুল।
বিশাল খালি মাঠ, গাছের সারি পার হওয়ার পর আকৃষ্ট করবে সুদৃশ্য ফোয়ারা। বাগানের মালি আবদুর রহমান জানালেন, কালের বিবর্তনে শ্বেতশুভ্র মার্বেল ও তার সবুজাভ নকশা কিছুটা মলিন হলেও এখনও জৌলুষ ধরে রেখেছে ফোয়ারাটি। তিনি জানান, রানির জন্যেই বিশেষ করে এটি নির্মাণ করা হয়েছিল।
আঙিনার সৌন্দর্য উপভোগ করতে করতে কোন ফাঁকে শুভ্র প্রাসাদটির সামনে এসে পড়েছি আঁচও করতে পারিনি। এক পলকেই মুগ্ধ করেছে সুনিপুণ হাতে তৈরি টেরাকোটা শিল্পের প্রত্নতাত্ত্বিক প্রাসাদটি। দেখতে অনেকটা ভারতের ত্রিপুরার উজ্জয়ন্ত প্রাসাদের মতো। বিশাল এ প্রাসাদের দোতালাতেই জাদুঘর। এ জাদুঘর তৈরি করেছে অন্যরকম আবহ, শুভ্র বিশালাকার এ প্রাসাদটি যেন ইতিহাসের আশ্রমে পরিণত হয়েছে।
প্রাসাদটির নিরিবিলি সাজানো-গোছানো পরিবেশের সঙ্গে এখানে এসে যুক্ত হয়েছে ইতিহাস-ঐতিহ্য। মাটি খুঁড়ে বের করা হয়েছে প্রাচীন সময়ের মেলবন্ধনের নানা নিদর্শন। প্রায় ১৭ একরের ইংরেজির ইউ আকৃতির পুরো এলাকাটি মুগ্ধ করে রাখে দর্শনার্থীদের। বিনোদনের পাশাপাশি ইতিহাস যাদের পছন্দের বিষয়, অতীত যাদের আকৃষ্ট করে তাদের জন্য এ স্পটটি একটি আদর্শ দর্শনীয় স্থান। ২০০৫ সাল থেকে প্রাসাদটিকে ব্যবহার করা হচ্ছে রংপুর বিভাগের প্রত্নতাত্ত্বিক জাদুঘর হিসাবে।
সুদৃশ্য মার্বেলের সিঁড়ি বেয়ে জাদুঘরে উঠলেই রয়েছে দশম ও একাদশ শতাব্দীর টেরাকোটা শিল্পকর্ম। রয়েছে সংস্কৃত এবং আরবি ভাষায় লেখা বেশ কিছু প্রাচীন পাণ্ডুলিপি। এর মধ্যে রয়েছে মুঘল সম্রাট আওরঙ্গজেবের সময়ের কুরআনসহ মহাভারত ও রামায়ণ। রয়েছে কালো পাথরের বিষ্ণুর প্রতিকৃতিসহ ইতিহাসের নানা নিদর্শন। ছবি তোলার ক্ষেত্রে নিষেধাজ্ঞা থাকায় ছবির না তোলার আফসোস থেকে গেলো।
প্রাসাদের পুরো গঠনশৈলী দেখেলে অনেকেই মনে করবেন প্রাচীন মুঘল স্থাপত্য অনুসরণ করেই নির্মাণ করা হয়েছে ভবনটি। তবে সে ধারণা পাল্টে যায় যখন দেখা যায় নির্মাণে রয়েছে ইতালিয় ধাঁচ। বিশেষ করে সিঁড়িগুলো।
রয়েছে সর্বমোট ৩১টি সিঁড়ি। যার প্রতিটিই ইতালিয় ঘরানার মার্বেল পাথরে তৈরি। সিঁড়ি থেকে উঠে জাদুঘর পর্যন্ত মেঝের পুরোটাও একই পাথরে তৈরি। রাজবাড়ির পশ্চাৎভাগে গুপ্ত সিঁড়ি রয়েছে। এই গুপ্ত সিঁড়ি কোনো একটি সুড়ঙ্গের সঙ্গে যুক্ত, যা সরাসরি ঘাঘট নদীর সঙ্গে যুক্ত এমনটা ধারণা রংপুরের মানুষের। তবে সিঁড়িটা নিরাপত্তার কারণে এখন বন্ধ রয়েছে।
প্রাসাদের ইতিহাসের ব্যাপারে কথা হয় রংপুর প্রত্নতাত্ত্বিক জাদুঘরের হিসাব সহকারী মো. কামরুল ইসলামের সঙ্গে। তিনি জানান, শিখ ধর্ম থেকে হিন্দুধর্মে ধর্মান্তরিত মান্নালাল রায় ছিলেন তাজহাট জমিদার বংশের প্রতিষ্ঠাতা। তিনি পাঞ্জাব থেকে এদেশে আসেন এবং রংপুরের মাহিগঞ্জে বসবাস শুরু করেন। সে সময় মাহিগঞ্জ ছিল রংপুরের জেলা সদর। মান্নালাল রায় ছিলেন স্বর্ণকার। ধারণা করা হয়, মান্নালাল রায়ের আকর্ষণীয় ‘তাজ’ বা রত্নখচিত মুকুটের কারণে এই এলাকার নামকরণ করা হয় তাজহাট। ধারণা করা হয় বিংশ শতাব্দীর শুরুর দিকে মহারাজা কুমার গোপাল রায় এটি নির্মাণ করেন।
তিনি জানান, ১৮৮৪ সাল থেকে ১৯৯১ সাল পর্যন্ত ভবনটি বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের হাইকোর্ট বেঞ্চ হিসেবে ব্যবহৃত হতো। ১৯৯৫ সালে প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর ইমারতটিকে সংরক্ষিত পুরাকীর্তি হিসেবে ঘোষণা করে।
বাংলাদেশ সময়: ১৬১৫ ঘণ্টা, জানুয়ারি ২৩, ২০১৮
এসএইচডি/আরআর