বৃহস্পতিবার (২৫ জানুয়ারি) চিকিৎসাধীন অবস্থায় সেই মানুষটি রাজধানীর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেছেন।
বিকেলে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে সর্বস্তরের মানুষের শ্রদ্ধা নিবেদন শেষে বাদ মাগরিব টিকাটুলি জামে মসজিদে জানাজা হয় গুণী এই কথাসাহিত্যিকের।
তিনি জানান, বিএসএমএমইউ থেকে শওকত আলীর মরদেহ নিয়ে যাওয়া হয় টিকুটুলির কে এম দাস লেনের বিরতি ভিলায়। যেখানে জীবনের শেষদিনগুলো কাটিয়েছেন প্রান্তিক মানুষের কথা বলে যাওয়া এই সাহিত্যিক।
বাংলাদেশ লেখক শিবিরের আয়োজনে শেষ বিকেলে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে অনুষ্ঠিত নাগরিক শ্রদ্ধানুষ্ঠানে তার প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে আসেন সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক অঙ্গনের বিশিষ্ট ব্যক্তিরা।
এ সময় বাংলানিউজের কথা হয় শ্রদ্ধা জানাতে আসা প্রফেসর ইমিরিটাস সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীর সঙ্গে। তিনি বলেন, শওকত আলী প্রান্তিক মানুষের জীবন পরিবর্তনের কথা বলে গেছেন সবসময়। তার সাহিত্যের বিষয়বস্তুতে সেই পরিবর্তনটি নিজস্ব ভাষারীতিতে উপস্থাপন করে গেছেন নান্দনিকভাবে। দার্শনিক অবস্থান থেকে তিনি বুঝতে পেরেছিলেন জীবনের বিদ্যমান অস্থির অবস্থার পরিবর্তন করতে হলে জীবনকে আরো স্বচ্ছ দৃষ্টিতে দেখতে হবে।
বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক শামসুজ্জামান খান বলেন, তার রাজনৈতিক চিন্তাধারা, বামপন্থি ধারা নিয়ে নানা মূল্যায়ন তার শৈল্পিক দক্ষতারই পরিচয় তুলে ধরে।
অধ্যাপক আবুল কাসেম ফজলুল হক বলেন, শওকত আলীর গল্প উপন্যাসের বিষয়বস্তুতে সামাজিক অবিচার, অন্যায়ের কথা ফুটে উঠেছে। এসেছে গণমানুষের কথা। এক উন্নত প্রগতিশীল অবস্থায় যেতে হলে শওকত আলীর রচনাবলী আলোচনা সমালোচনার দরকার রয়েছে।
সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের সভাপতি গোলাম কুদ্দুছ বলেন, প্রগতিশীল চিন্তাধারায় তিনি সারা জীবন শোষণমুক্তির পক্ষে কথা বলে গেছেন। তিনি কখনো কারো কাছে বিক্রি হননি, নিজের বিশ্বাসকে কখনো তিনি হারাতে দেননি।
১৯৩৬ সালের ১২ ফেব্রুয়ারি ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের উত্তর দিনাজপুর জেলার থানা শহর রায়গঞ্জে জন্ম নেন শওকত আলী। প্রথম জীবনে চিকিৎসক হওয়ার স্বপ্ন বুনেছিলেন তিনি। কিন্তু কলেজে বিজ্ঞান বিভাগ না থাকায় পরে তিনি মানবিক বিভাগ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক পাস করেন। কলেজের ছাত্র জীবনেই তিনি কমিউনিস্ট আন্দোলনে জড়িয়ে পড়েন। এর কিছুদিন পরেই তিনি জড়িয়ে পড়েন রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনে।
১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে তাকে বন্দি করে জেলে পাঠায় পাকিস্তানের সামরিক জান্তা। পরে সাংবাদিক হিসেবে কর্মজীবন শুরু করলেও কিছুদিন পরে শিক্ষকতায় যোগ দেন তিনি। বামপন্থিদের ‘নতুন সাহিত্য’ পত্রিকায় লেখালেখি করেন শওকত আলী। এছাড়া দৈনিক মিল্লাত, মাসিক সমকাল, ইত্তেফাকে তার অনেক গল্প, কবিতা ও শিশুতোষ লেখা প্রকাশিত হয়।
শওকত আলী ‘ওয়ারিশ’ উপন্যাসে ব্রিটিশ শাসনামল, দেশভাগ আর হিন্দু-মুসলিম দাঙ্গার মর্মন্তুদ ছবি তিনি এঁকেছেন। তার বিখ্যাত ‘প্রদোষে প্রাকৃতজন’ উপন্যাসে তিনি নিম্নবর্গের মানুষের বঞ্চনার কথা বলেছেন, পাশাপাশি তিনি শোষকের করাল গ্রাসের বিপরীত সম্প্রদায়ের বিপ্লব-বিদ্রোহের চিত্রটিও ফুটিয়ে তুলেছেন এখানে।
তার অন্যান্য উপন্যাসের মধ্যে রয়েছে, ‘পিঙ্গল আকাশ’, ‘প্রদোষে প্রাকৃতজন’, ‘অপেক্ষা’, ‘গন্তব্যে অতঃপর’, ‘উত্তরের খেপ’, ‘অবশেষে প্রপাত’, ‘জননী ও জাতিকা’, ‘জোড় বিজোড়’। ‘উন্মুল বাসনা’, ‘লেলিহান সাধ’, ‘শুন হে লখিন্দর’, ‘বাবা আপনে যান’সহ বেশ কয়েকটি গল্পগ্রন্থ সম্পাদনা করেছেন তিনি। ‘দক্ষিণায়নের দিন’, ‘কুলায় কালস্রোত’ এবং ‘পূর্বরাত্রি পূর্বদিন’ তার শ্রেষ্ঠ উপন্যাসত্রয়ী। এর জন্য তিনি ‘ফিলিপস সাহিত্য পুরস্কার’ পান।
কথাসাহিত্যে অবদানের জন্য ১৯৯০ সালে একুশে পদক পান শওকত আলী। পরে বাংলা একাডেমি পুরস্কার, হুমায়ুন কবির স্মৃতি পুরস্কার, অজিত গুহ স্মৃতি সাহিত্য পুরস্কারসহ ভূষিত হয়েছেন একাধিক পুরস্কারে।
কথাসাহিত্যে অমর এ মানুষটি ফুসফুসের সংক্রমন, কিডনি জটিলতা ও হৃদরোগের সমস্যা নিয়ে ৪ জানুয়ারি হাসপাতালে ভর্তি হন। এরপর ৮১ বছর বয়সী কথাসাহিত্যিককে প্রথমে আইসিইউতে, পরে অবস্থার অবনতি হলে ৬ জানুয়ারি তাকে ল্যাব এইড হাসপাতালের লাইফ সাপোর্টে নেওয়া হয়। পরে তিনি রাজধানীর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় (বিএসএমএমইউ) হাসপাতালের নিবিড় পর্যবেক্ষণ কেন্দ্র- আইসিইউতে চিকিসাধীন ছিলেন। মৃত্যুকালে তার বয়স হয়েছিল ৮২ বছর।
বাংলাদেশ সময়: ২০৩০ ঘণ্টা, জানুয়ারি ২৫, ২০১৮
এইচএমএস/এমজেএফ