যুদ্ধের শুরুতেই পাথরের আঘাতে নষ্ট হয়ে যায় তার ডান চোখ। এর পর থেকে তিনিই হয়ে গেলেন পরিবারের বোঝা।
পাথর শ্রমিক খায়রুল ইসলাম লালমনিরহাটের পাটগ্রাম উপজেলার শ্রীরামপুর ইউনিয়নের তেলিবাড়ি গ্রামের ভূমিহীন ভ্যানচালক রহিদুল ইসলামের ছেলে।
খায়রুল ইসলাম বাংলানিউজকে জানান, অভাবের সংসারে ছোটবেলা থেকেই বাবার সঙ্গে ভ্যান চালাতেন। কিছুদিন যেতেই ভ্যানের পাশাপাশি কৃষি শ্রমিক হিসেবে দিনমজুরি শুরু করেন। বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে বার্ধক্যে পৌঁছে যান বাবা রহিদুল ইসলাম। বৃদ্ধ বাবা ভ্যান চালাতে অক্ষম হওয়ায় বেশি উপার্জনের আশায় ৫ মাস আগে পাথর ভাঙা শ্রমিক হিসেবে কাজ শুরু করেন খায়রুল।
দৈনিক ৩২০ টাকা মজুরিতে কাজ নেন বুড়িমারী এলাকার সোহেল মিয়ার পাথর কারখানায়। সেখানে ৩ মাস ভাল ভাবেই কাজ করেন তিনি। কাজ করাকালীন একদিন হঠাৎ একটি পাথর এসে তার ডান চোখে আঘাত করে। এতে গুরুতর আহত হন খায়রুল। সহকর্মীরা তাকে উদ্ধার করে প্রথমে পাটগ্রাম উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স ও পরে দিনাজপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যান।
সেখানকার চক্ষু চিকিৎসক ডা. টি জামান তাদের জানান, খায়রুলের ডান চোখ নষ্ট হওয়ার পথে। সুষ্ঠু চিকিৎসা না হলে বয়স হওয়ার পরে অপর চোখেও এর প্রভাব পড়বে। তাকে সুস্থ করতে ভারতে নিতে হবে। এ কথায় ভ্যান চালক বাবা রহিদুলের মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ে। কোথায় পাবেন এত টাকা। কে তাকে টাকা দিয়ে সহযোগিতা করবে। নয়তো সারা জীবনের জন্য একটি চোখ হারাতে হবে তার আদরের সন্তানকে।
টাকার অভাবে দিনাজপুরের চিকিৎসকের দেওয়া সান্ত্বনা চিকিৎসাই চলছে তার। এখন ডান চোখে দেখতে পারেন না খায়রুল। ছেলের চিকিৎসার জন্য হাতে পায়ে ধরে পাথর কারখানা মালিকের কাছে ক্ষতিপূরণ বাবদ পেয়েছেন মাত্র ৮ হাজার টাকা। যা দিনাজপুর মেডিকেলে থাকতেই খরচ হয়ে গেছে। এখন সংসারের খাবার যোগাতে বাবা ছেলে অন্যের জমিতে কৃষি শ্রমিক হিসেবে কাজ করছেন। ডান চোখের সুস্থতা ছেড়ে দিয়েছেন সৃষ্টিকর্তার হাতে।
কোনো শ্রমিক কাজ করতে গিয়ে আহত হলে, পঙ্গুত্ব বরণ করলে বা মারা গেলে ওই শ্রমিককে বা তার পরিবারকে ক্ষতিপূরণ দেয়ার বিধান থাকলেও সেই শ্রম আইন মানা হচ্ছে না পাটগ্রামের এসব পাথর ভাঙা কারখানায়। খায়রুলের মত অনেকেই কাজ করতে গিয়ে পাথর মেশিনে হাত পা চোখ হারাচ্ছেন। এমন কি পাথরের সিলিকনের কারণে মরণব্যাধী সিলোকোসিসে আক্রান্ত হয়ে অকালে প্রাণ হারাচ্ছেন অনেকে। তাদের কাউকে ক্ষতিপূরণ দেওয়া হচ্ছে না। এটা আইনের স্পষ্ট লঙ্ঘন হলেও কারোই মাথা ব্যথা নেই।
স্থানীয় সূত্র মতে সিলোকোসিস রোগে আক্রান্ত হয়ে এ পর্যন্ত ৬৭ জনের মৃত্যু হয়েছে। অসুস্থ হয়ে মানবেতর জীবন যাপন করছেন শতাধিক শ্রমিক।
কাউয়ামারী এলাকার সাবেক পাথর শ্রমিক বর্তমান ভ্যানচালক এয়াজ উদ্দিন বলেন, বুড়িমারীর পাথর ভাঙা মেশিনে কাজ করতে গিয়ে অনেকেই হাত পা হারিয়েছেন। কাউকে ক্ষতিপূরণ দেওয়া হয়নি। যারা মারা গেছেন তাদের পরিবারের কোনো খোঁজও নেয়না কোনো কারখানা মালিক।
বুড়িমারী পাথর শ্রমিক সংগঠনের নেতা মমিন উদ্দিন বাংলানিউজকে জানান, পাথর ভাঙার কাজ করতে গিয়ে অনেক শ্রমিক মারা গেছেন। অনেকেই অসুস্থ হয়ে মানবেতর জীবন যাপন করছেন। কেউ কোনোদিন তাদের ক্ষতিপূরণ দেননি। তবে মালিকপক্ষকে চাপ দিয়ে পাথর শ্রমিকদের ক্ষতিপূরণ দিতে সরকারের প্রতি দাবি জানান তিনি।
বাংলাদেশ সময়: ০৬৫৫ ঘণ্টা, জানুয়ারি ২৬, ২০১৮
আরএ