মাদক কারবারীদের আত্মসমর্পণ প্রক্রিয়ার আলোচনার বিষয়ে কক্সবাজারের নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিত্বদের সঙ্গে আলাপ করলে তারা বাংলানিউজকে বলেন, ইয়াবা কারবারীরা মাদকের বিষবাষ্প ছড়িয়ে সমাজ, দেশ ও জাতিকে কলুষিত করে চূড়ান্ত পর্যায়ে এসে এভাবে পার পেয়ে গেলে এটা অনেকটা দায়মুক্তি হয়ে যাবে। অপরাধীদের এভাবে দায়মুক্তি দেওয়ার আগে কর্তৃপক্ষকে পরবর্তী পরিণতিও ভাবতে হবে।
কক্সবাজার জেলা আইনজীবী সমিতির সদস্য ও জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক তোফায়েল আহমদ এ বিষয়ে বাংলানিউজকে বলেন, মাদক বিশেষ করে ইয়াবা চোরাচালানের কারণে কক্সবাজারের দুর্নাম ছড়িয়েছে সারাদেশে। এ কলঙ্ক থেকে জেলাবাসী মুক্তি চায়। তাই শুধু নামে নয়, আত্মসমর্পণের এ উদ্যোগটি ফলপ্রসূ এবং কার্যকর হোক, এখানকার মানুষ এটি মনে-প্রাণে চায়। তবে বিষয়টি গণমাধ্যমে আসার পর থেকে কক্সবাজারের সচেতন মহলে গুঞ্জন বাড়ছে। অনেকে শঙ্কাও প্রকাশ করছেন।
তোফায়েল আহমদ বলেন, সবার একই ভাবনা- মাদক ব্যবসায়ীদের কী কী শর্তে আত্মসমর্পণের সুযোগ দেওয়া হচ্ছে, তাদের শাস্তির আওতায় আনা হবে কিনা, মাদক ব্যবসায়ীদের অর্জিত সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করা হবে কিনা। আমি মনে করি, সরকার এসব কৌশল ঠিক করেই আত্মসমর্পণের বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেবে।
মাদক কারবারীদের আত্মসমর্পণের বিষয়টি নিয়ে এখন পর্যন্ত কক্সবাজার জেলা পুলিশের পক্ষ থেকে আনুষ্ঠানিক কোনো বক্তব্য বা ঘোষণা না এলেও ইতোমধ্যে এ প্রক্রিয়া সরকার অনেক দূর এগিয়ে নিয়েছে বলে বিভিন্ন সূত্রে নিশ্চিত হওয়া গেছে। সূত্রগুলো বলছে, এই জানুয়ারির শেষের দিকে অথবা ফেব্রুয়ারির প্রথম দিকে ইয়াবা কারবারীদের আত্মসমর্পণের আনুষ্ঠানিকতা হতে পারে। অনুষ্ঠানে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খাঁন কামালও উপস্থিত থাকতে পারেন বলে শোনা যাচ্ছে।
পুলিশের একটি দায়িত্বশীল সূত্রে জানা গেছে, আত্মসমর্পণ প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবে চিহ্নিত মাদক কারবারীদের বেশিরভাগই এরইমধ্যে পুলিশের হেফাজতে চলে গেছেন। বর্তমানে তাদের কক্সবাজার পুলিশ লাইনে রাখা হয়েছে। এদের মধ্যে কক্সবাজার-৪ (উখিয়া-টেকনাফ) আসনের সাবেক সংসদ সদস্য আব্দুর রহমান বদির ফুফাতো ভাই কামরুল হাসান রাসেল, মো. শফিক, ভাগিনা সাহেদুর রহমান নিপু ও তালতো ভাই সাহেদ কামাল, চাচাতো ভাই ও বোন জামাই মো. আলমও রয়েছেন।
এ ব্যাপারে যোগাযোগ করলে কক্সবাজার জেলা পুলিশ সুপার (এসপি) এবিএম মাসুদ হোসেন বাংলানিউজকে জানান, মাদক কারবারীদের আত্মসমর্পণের প্রক্রিয়াটি এগোচ্ছে। সরকারের উচ্চ পর্যায়ে সব প্রস্তুতি সম্পন্ন হলেই আনুষ্ঠানিকতার দিকে যাওয়া হবে।
তবে কোন কৌশলে বা কী শর্তে মাদক কারবারীদের আত্মসমর্পণের সুযোগ দেওয়া হচ্ছে- এ বিষয়ে এখনো তিনি কিছু জানেন না বলে জানান।
বিজিবি, পুলিশ, কোস্ট গার্ড, মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর ও গোয়েন্দা সংস্থার তালিকা অনুযায়ী, সারাদেশে ৩ হাজারেরও বেশি চিহ্নিত মাদক কারবারী রয়েছে। এদের মধ্যে মিয়ানমারের সীমান্তঘেঁষা কক্সবাজার জেলায়ই আছে ১ হাজার ১৫১ জন। তাদের মধ্যে আবার বেশিরভাগই টেকনাফের। বিভিন্ন সময়েই এই তালিকায় আব্দুর রহমান বদি ও তার স্বজনদের নাম এসেছে।
কক্সবাজার জেলা পুলিশের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মো. ইকবাল হোসেন বাংলানিউজকে জানান, গত ৪ মে থেকে সারাদেশে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর মাদকবিরোধী অভিযান জোরদার করা হয়। এরপর থেকে এ অভিযানে এবং মাদক কারবারীদের অভ্যন্তরীণ কোন্দলে ‘বন্দুকযুদ্ধে’ শুধু কক্সবাজারেই ৫১ জন নিহত হয়েছেন।
কিন্তু এমন পরিস্থিতিতেও টেকনাফে সর্বনাশা মাদক ইয়াবার কারবার বন্ধ হয়নি। গত দেড়মাসে পুলিশ, র্যাব, বিজিবি, কোস্ট গার্ড ও মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের হাতে ধরা পড়ে প্রায় সাড়ে ১৪ লাখের বেশি পিস ইয়াবা।
ঠিক এই জায়গায় এসে শঙ্কিত সচেতন মহল। তারা মনে করছেন, আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী এমন কঠোর অবস্থানে থাকলেও মাদক তথা ইয়াবা পাচার ঠেকানো যাচ্ছে না। এ অবস্থায় আত্মসমর্পণ প্রক্রিয়া ফলপ্রসূ না হলে অর্থাৎ আত্মসমর্পণের আড়ালে মাদক কারবারীরা কৌশলে পার পেয়ে গেলে ভবিষ্যতে সীমান্ত শহর উখিয়া-টেকনাফসহ পুরো কক্সবাজারে মাদক পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ রূপ নেবে।
এ ব্যাপারে বিশিষ্ট সাহিত্যিক বিশ্বজিত সেন বাঞ্চু বাংলানিউজকে বলেন, যুদ্ধাপরাধীরা দেশের যে ক্ষতি করেছে, মাদকের এ ক্ষতি কোনো অংশে তার চেয়ে কম নয়। মাদকের বিরূপ প্রভাবে যুব সমাজসহ পুরো দেশ ও জাতি আজ ভয়াবহ পরিস্থিতির সম্মুখীন। মাদকের কারণে আজ সমাজে উন্নয়ন বাধাগ্রস্ত হচ্ছে, সমাজে এক ধরনের ভারসাম্যহীনতা তৈরি হয়েছে, পুরো জাতি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। তাই এদেশে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার হতে পারলে, এসব চিহ্নিত মাদক কারবারীদেরও বিচারের আওতায় কেন আনা হবে না? আত্মসমর্পণের নামে মাদক কারবারীদের রেহাই দেওয়া মোটেও সমীচীন হবে না।
আত্মসমর্পণের বিষয়টিকে স্বাগত জানিয়ে তিনি বলেন, আত্মসমর্পণে আসা মাদক কারবারীদের আইনের আওতায় এনে তাদের অবৈধ উপায়ে অর্জিত সকল সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করতে হবে। তাহলেই সরকারের এ মহৎ উদ্যোগ ফলপ্রসূ হবে।
কক্সবাজার বাঁচাও আন্দোলনের সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট আয়াছুর রহমান বাংলানিউজকে বলেন, ইয়াবার প্রধান উৎস মিয়ানমার। সীমান্ত উপজেলা টেকনাফের বিভিন্ন সীমান্ত পয়েন্ট দিয়ে ইয়াবা আমাদের দেশে ঢুকছে। বিশেষ করে ইয়াবার এ দুর্নামের কারণে সারাদেশে কক্সবাজার নামটিতে কলঙ্ক লেগেছে। আমরা এ কলঙ্ক থেকে দ্রুত মুক্তি পেতে চাই।
কক্সবাজারের সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব ও বিশিষ্ট আবৃত্তিকার জসীম উদ্দিন বকুল বলেন, আত্মসমর্পণ মানে পার পেয়ে যাওয়া নয়। আমরা এটি বিশ্বাস করি না। সরকারের পক্ষ থেকে হোক, মাদক কারবারীদের পক্ষে হোক, এ উদ্যোগের সূচনা যেখান থেকেই হোক না কেন, আমরা চাই এ উদ্যোগের মধ্য দিয়ে কক্সবাজারের দুর্নাম ঘুচবে। পাশাপাশি দেশ ও জাতিকে ধ্বংস করা এসব চিহ্নিত মাদক কারবারীদের অবশ্যই আইনের আওতায় এনে শাস্তি দিতে হবে। তাদের অবৈধভাবে অর্জিত সকল সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করতে হবে।
কক্সবাজার-৪ (উখিয়া-টেকনাফ) আসনের সাবেক সংসদ সদস্য অধ্যাপক মো. আলী বাংলানিউজকে বলেন, মূলত আব্দুর রহমান বদি সংসদ সদস্য নির্বাচিত হওয়ার পর থেকেই টেকনাফে ইয়াবার প্রসার ঘটেছে। ইয়াবার বিষবাষ্প ঠেকাতে বদির ভূমিকা কোনোকালেই ইতিবাচক ছিল না। উল্টো তার ভাই, আত্মীয়-স্বজনসহ অনেকেই এ ব্যবসায় জড়িয়ে গেছেন। কিন্তু এখন শুনতে পাচ্ছি সেই বদিই মাদক কারবারীদের আত্মসমর্পণ করানোর উদ্যোগ নিয়েছেন। এ উদ্যোগ কতোটা ফলপ্রসূ হবে, ঠিক এই জায়গায় আমি সন্দিহান। সরকার এ বিষয়ে কঠোর না হলে উদ্যোগ ফলপ্রসূ হবে না।
বাংলাদেশ সময়: ১২৫৫ ঘণ্টা, জানুয়ারি ২৪, ২০১৯
এসবি/এইচএ/
** কক্সবাজারে ‘বন্দুকযুদ্ধে’ ৩ মাদকবিক্রেতা নিহত