ঢাকা, মঙ্গলবার, ১১ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৬ নভেম্বর ২০২৪, ২৪ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

জাতীয়

‘বাউত উৎসবে’ পাবনার শৌখিন মাছ শিকারিরা

| বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৩০২ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ৪, ২০১৯
‘বাউত উৎসবে’ পাবনার শৌখিন মাছ শিকারিরা

পাবনা (ঈশ্বরদী): গ্রাম বাংলার বিলাঞ্চলে চিরচেনা ঐতিহ্যবাহী ‘বাউত উৎসবে’ মেতেছেন পাবনার অধ্যুষিত চলনবিল এলাকার ভাঙ্গুড়া ও চাটমোহরের শৌখিন মাছ শিকারিরা। অনেকে একে ‘পলো উৎসব’ নামেও চেনেন।

মঙ্গলবার (০৩ ডিসেম্বর) চলনবিল অধ্যুষিত পাবনার ভাঙ্গুড়া উপজেলার মণ্ডতোষ ইউনিয়নের চাটমোহর-ভাঙ্গুড়া-ফরিদপুর উপজেলার মহাসড়ক সংলগ্ন পাটুলিপাড়া-দিয়ারপাড়া বগাবিলের অংশ বিল রুহুলে এ উৎসবে শত শত মাছ শিকারি সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত একসঙ্গে মৎস্য শিকার করেন।

সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, চলনবিলের পানি এখন অনেকটাই কমে গেছে।

বিশাল এ বিলের বিভিন্ন অংশে রয়েছে স্বল্প পরিমাণ পানি। আর মাঠগুলোয় চলছে ধান কাটা আর ফসল বোনার উৎসব। তবে বিলের যেসব জায়গায় এখনও পানি রয়েছে, সেসব জায়গায় হাজার হাজার শৌখিন মাছ শিকারিরা পলো দিয়ে মাছ ধরায় ব্যস্ত হয়ে উঠেছেন। বাঁশ ও বেত দিয়ে তৈরি এক একটি পলোর উচ্চতা প্রায় তিন ফিটের মতো। শখের বশে অনেকে পলোতে শৈল্পিক কারুকার্য করে নিয়েছেন। এ যেন এক অভূতপূর্ব মহোৎসব। এলাকায় মাইকিং করে নদী ও বিলের পাড়ে ভোর না হতেই পলো হাতে নামতে দেখা যাচ্ছে মানুষকে। হাঁটু পানি, কোথাও বা গলা পানিতে মাইলকে মাইল পলো দিয়ে মাছ ধরছেন শৌখিন মাছ শিকারিরা। কিছু মানুষ একদিন আগে এসে নিকট আত্মীয়ের বাড়িতে রাত কাটিয়ে ভোরে এসেছেন। বর্তমানে বিলপাড়ে একটা উৎসব উৎসব ভাব বিরাজ করছে। প্রতিবছরের এই দিনে পাবনাসহ আশপাশের জেলা থেকে আসা মাছ শিকারির হাতে প্রচুর পরিমাণে দেশীয় মিঠা পানির মাছ ধরা পড়ে। কাকডাকা ভোর থেকে সাংসারিক সব কাজ কর্ম ফেলে পলো, বাদাইজাল, ঘেরজাল ঠেলাজালসহ মাছ ধরার বিভিন্ন উপকরণ নিয়ে মাছ শিকার করতে আসেন শিকারিরা।

এ বছরও ব্যতিক্রম ঘটেনি। মঙ্গলবার সকাল থেকে শুরু হয়েছে জেলার চলনবিল অধ্যুষিত অঞ্চলের 'বাউত উৎসব'। এ দিন ভাঙ্গুরা ও চাটমোহর উপজেলার শত শত শৌখিন মাছ শিকারি মহা আনন্দে মাছ ধরার উৎসবে মেতে উঠেছেন। সপ্তাহে দুইদিন মঙ্গলবার ও শনিবার এই উৎসবে মিলিত হবেন পাবনার চাটমোহর, ভাঙ্গুড়া, আটঘরিয়া, সদর, বড়াইগ্রাম ও গুরুদাসপুর এলাকার শৌখিন মাছ শিকারিরা। ভোর থেকে শুরু করে সকাল ৯টা পর্যন্ত দূর-দূরান্ত থেকে নছিমন, করিমন, অটোভ্যান, মোটরসাইকেল, বাইসাইকেলে আবার কেউবা হেঁটে রওনা হন বিলের উদ্দেশে। তাদের হাতে ছিল পলো, চাক পলো, নেট পলো, ঠেলা জাল, বাদাই জাল, লাঠি জালসহ মাছ ধরার নানা সরঞ্জাম। বিলপাড়ে সমবেত হওয়ার পর একসঙ্গে বিলে নেমে মাছ ধরার আনন্দ উৎসবে মেতে উঠেন শিশু-কিশোর, যুবক, বৃদ্ধসহ নানা বয়সী মানুষ। সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত শৌখিন মাছ শিকারিরা একত্রিত হয়ে সারিবদ্ধভাবে বিলে পলো, ঠেলাজাল, বেরজাল দিয়ে মাছ শিকার করেন।  

এসময় দেশীয় প্রজাতির বিভিন্ন মাছ শোল, বোয়াল, গজার, রুই, কাতলা, চিতল, পুঁটি, খৈলসা, শিং, টেংরা, পাবদা মাছ ধরা পড়ে। দুপুরের দিকে মনে বেশ আনন্দ নিয়ে গন্তব্য স্থানে ফিরে যান শিকারিরা।  

পাবনা সদর উপজেলার চিকিৎসক ডা. আ. মান্নান নসিমনে করে 'বাউত উৎসব' এ যোগ দিয়েছেন। সকালেই তিনি পৌঁছে যান বিলে। অনুভূতি ব্যক্ত করে তিনি বাংলানিউজকে বলেন, হাজার হাজার মানুষ একসঙ্গে মাছ ধরার আনন্দই আলাদা। মাছ সবাই পায় না। একজন পেলে আনন্দ ভাগাভাগি করেন সবাই। কে মাছ পেল আর কে পেল না, তা নিয়ে কোনো দুঃখ নেই কারো। প্রতিবছর আনন্দের জন্য, মাছ ধরার জন্য, এ সময়টার অপেক্ষায় থাকেন তারা।

চাটমোহর সদর উপজেলার নতুনবাজার এলাকার ওষুধ ব্যবসায়ী মো. আশরাফুল আলম (৩৫) বাংলানিউজকে বলেন, কার্তিক মাসের মাঝামাঝি থেকে শুরু হয় এ উৎসব। এ বছর পানি বেশি থাকার জন্য একটু দেরি হয়েছে। চৈত্র মাস পর্যন্ত পলো দিয়ে মাছ ধরার উৎসব চলে। এটি আমাদের গ্রামীণ সংস্কৃতির একটি প্রাচীন অংশ।  

ভাঙ্গুড়ার রাঙ্গালিয়া গ্রামের ফজের আলী (৪০) বাংলানিউজকে বলেন, পলো দিয়ে মাছ ধারা তার দীর্ঘদিনের শখ। পলো দিয়ে পাঁচ কেজি ওজনের রুই মাছ ধরেছেন তিনি।  

তিনি আরও বলেন, শত ব্যস্ততার মধ্যেও প্রতিবছরের এইদিনে তিনি বিলে মাছ ধরতে আসেন। মাছ না নিয়ে তার বাড়ি ফেরার রেকর্ড নেই। তবে আগেকার তুলনায় দেশীয় প্রজাতির মাছ তেমন ধরা পড়ে না।
ভাঙ্গুড়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) সৈয়দ আশরাফুজ্জামান বাংলানিউজকে বলেন, ভাঙ্গুড়া-চাটমোহর উপজেলার কিছু অংশজুড়ে রয়েছে চলনবিলের বগাবিল। তার কয়েকশ’ একর অবস্থিত বিল রুহুল। বর্ষাকালে এ এলাকা পানিতে ডুবে থাকলেও বর্ষার পানি মেনে যাওয়ার পরই বিভিন্ন স্থান থেকে আসা শৌখিন মাছ শিকারিদের সমাগম ঘটে। বাউত উৎসব যেন এক বড় উৎসবে পরিণত হয়।

বাংলাদেশ সময়: ২২৫৮ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ০৩, ২০১৯
আরবি/

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।