বলছিলাম কুষ্টিয়ার মিরপুর উপজেলার সদরপুর এলাকার রিকাত আলীর ছেলে মুক্তিযোদ্ধা রাহাত আলীর কথা। মহান স্বাধীনতা যুদ্ধে জীবন বাজি রাখা এই বীর সেনানী বাংলানিউজের কাছে তার যুদ্ধকালীন স্মৃতিচারণ করেন।
দেশকে স্বাধীন করার জন্য যুদ্ধে যাওয়ার ইতিহাসটা প্রায় সবার একই ধরনের। পাকিস্তানি সেনাদের অত্যাচারে এলাকা ছাড়া হয়েও যুদ্ধে যায় অনেকে। তবে রাহাত আলীর ঘটনা একটু ব্যতিক্রম।
রাহাত আলী বাংলানিউজকে বলেন, এলাকায় তখন টেলিভিশন ছিল না। আমাদের গ্রামে একটা রেডিও ছিল। রেডিওতে খবর শুনতাম। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ৭ই মার্চের ভাষণও শুনেছিলাম রেডিওতে। তারপর ২৫ মার্চের খবর শুনি। ঢাকায় পাকিস্তানি বাহিনীরা অনেক মানুষকে হত্যা করে। এরপর জানতে পারি, কুষ্টিয়া পুলিশ লাইনে পাক সেনাদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ করা হবে। সাহস করে গেলাম সেখানে। এ ঘটনার পর বাড়ি এসে শুনি আমার কুষ্টিয়ায় যাওয়ার খবর চারিদিকে ছড়িয়ে পড়েছে। তবে বাড়ির আশপাশের লোকজন ছিল আমার পক্ষে।
এর মধ্যে এলাকার আবুল রাজাকার পাক সেনাদের নিয়ে ছাতারপাড়া এলাকায় লুট করে বাড়ি ফেরার সময় সাগরখালী নদীতে আমাদের নৌকায় উঠতে যায়। এসময় ফজল খাঁ, মধু মণ্ডল, মসলেম মণ্ডলের নেতৃত্বে আমরা কয়েকজন মিলে খেয়া ঘাটে আবুল রাজাকারকে মেরে ফেলি। তখন মধু মণ্ডল বলে তুই ছোট মানুষ, বাড়ি চলে যা। তারপর ওদের সঙ্গে না গিয়ে বাড়ি চলে আসলাম। পরে এলাকায় ছড়িয়ে পড়ে আবুল রাজাকারকে হত্যার সময় আমিও ছিলাম।
পাক সেনারা আমাদের মেরে ফেলবে এই ভয়ে ভাবলাম যুদ্ধের জন্য আমাকে ট্রেনিং নিতে হবে। তাই ভারতে যেতে হবে। কিন্তু সেদিন আমার কাছে কোনো টাকা পয়সা, কিংবা বাড়িতে শুকনো খাবারও ছিল না।
তিনি বলেন, আমাকে বাঁচানোর জন্য প্রতিবেশীরা বাড়ি বাড়ি থেকে এক পোয়া, আধা কেজি করে চাল তুলে নিয়ে আসেন। সব মিলিয়ে ২০ কেজি চাল হয়। চাল মাথায় করে আমি আর আমার বন্ধু সাদেক আলী শিকারপুর পর্যন্ত যাই। সেখানে ২ টাকা কেজি দরে চাল বিক্রি করি। সেই টাকা নিয়েই গেলাম প্রশিক্ষণ নিতে। থ্রি নট থ্রি, রাইফেল, এলএমজিসহ বিভিন্ন অস্ত্র চালানোর প্রশিক্ষণ গ্রহণ করলাম। ট্রেনিং নিলাম গেরিলা মুক্তিযোদ্ধার।
ট্রেনিং এ কখনো বাড়ি কিংবা পরিবারের কথা মনে হয়নি আমার। কারণ আমার মতো আরও অনেক ছেলে ছিল সেখানে। আর যে পথে এসেছি সেটা শেষ তো করতেই হবে। ট্রেনিং শেষে ফিরে আসলাম দেশে। দেশে এসে লোকালয়, নদীর ধারে, মাঠে, ঝোপে, মানুষের বাড়ি বাড়ি লুকিয়ে থাকতে হতো। সকালে একবার আর রাতে একবার খেতে পেতাম। কোনো কোনোদিন একবার।
যুদ্ধের সময় একদিন আজমপুরের রুহুলের বাড়িতে রাতে থাকার কথা ছিল আমাদের। আমি আর আমার সঙ্গে সাদেক আলী। দু’জনকে ঘরে বসতে দিয়েছে। শুনতে পেলাম পাশের ঘরে রুহুলের স্ত্রী বলছেন, ওনারা তো এসেছেন আমরাই তো না খেয়ে আছি। তাদের কি খাওয়াবো। পরে লুৎফর চৌধুরী নামে এক দোকানির কাছে গেলাম আটা আর চাল কিনতে। সে টাকা না নিয়ে ১০ কেজি চাল আর ১০ কেজি আটা দিল। সেটা রুহুলের বাড়িতে নিয়ে গেলাম। পরে রুটি বানিয়ে কাঁচা মরিচ দিয়ে আমাদের দিল সেটাই খেলাম আমরা।
যুদ্ধের কথা জানতে চাইলে রাহাত আলী বলেন, ছোট ছোট গেরিলা যুদ্ধে অংশ নিয়েছিলাম। যুদ্ধকালীন কমান্ডার মারফত আলীর নেতৃত্বে ভয়াবহ কাকিলাদহ যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিলাম। নিজের চোখে না দেখলে বোঝা যাবে না সেদিনের ভয়াবহতা। কাকিলাদহতে আমরা পাক সেনা ও রাজাকারদের মুখোমুখি অবস্থানে পড়ে যাই। তারা কাকিলাদহের দিকে আসবে জেনে আমরা তিন গ্রুপে ভাগ হয়ে প্রায় ৫০/৬০ জন মুক্তিযোদ্ধা সেখানে শেল্টার নিয়েছিলাম। প্রথম গ্রুপ ছিল ক্যানেলের ধারে গোরস্থানের কাছে, আমরা গেলাম কাঁঠাল বাগানে আর আমাদের দুই গ্রুপের মাঝখানে এক গ্রুপ ছিল।
তিনি বলেন, একটা কাঁচা রাস্তার একপাশে আমি, অন্যপাশে সাদেক আর পাশেই কাঁঠাল গাছের কাছে ছিল মধু মণ্ডল। এবার গোরস্থানের কাছ থেকে আমাদের লোকজন গুলি করা শুরু করলে পাক সেনারাও গুলি করতে করতে আমাদের দিকে আসতে থাকে। আমরা মাঝের গ্রুপের নির্দেশনার অপেক্ষায় আছি। মাঝখান থেকে হিট করলে আমরাও হিট করবো। কিন্তু দুঃখের বিষয় মাঝখানে থাকা মুক্তিযোদ্ধারা ভয়ে আমাদের সংকেত না দিয়ে তাদের অবস্থান থেকে সরে যায়। এই সুযোগে পাকিস্তানি বাহিনীরা মাঝ দিয়ে এসে কাঁঠাল বাগানে হামলা চালায়। তখন মধু মণ্ডলকে বার বার বলছি উস্তাদ আমরা গুলি করি গুলি করি। কিন্তু উস্তাদ মধু মণ্ডল বললো, গুলি আমার ঘরের ধানের ভাত না, কেনা চাল। তোমরা চুপ করো, থামো আর তখনই একটা গুলি এসে মধুর পায়ে লাগে। তখন মধু পড়ে যায়।
মধু মণ্ডলকে যদি তখন চিকিৎসা দেওয়া যেত তাহলে হয়তো বেঁচে যেতো। কিন্তু ওই সময় কোনো পরিস্থিতি ছিল না। সেসময় আমাদের সঙ্গে যশোর এলাকার দুইজন মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন। তারা এলএমজি নিয়ে দু’জনের দুই পা একস্থানে রেখে আলাদা দিকে গুলি শুরু করলেন। তারা আমাদের বলছিলেন আমাদের ভাগ্যে যা হয় হোক, তোমরা বাঁচো।
এর মধ্যে এক পাক সেনা গুলি খেয়ে জোরে চিৎকার করে ওঠে। আর একজন ম্যাগজিন কুড়াচ্ছিল। এই সুযোগে আমরা আক্রমণ চালাই। যে ম্যাগজিন কুড়াচ্ছিল সেই পাক সেনা মারা যায়। সেই ফাঁকে আমরা সেখান থেকে রাস্তা পার হয়ে চলে আসি।
কিন্তু সাদেক আলী আহত হয়ে আখের ক্ষেতে থেকে যায়। যা আমরা বুঝতে পারিনি। সাদেককে ফেলেই আমরা চলে আসি। এর মধ্যে বিভিন্ন এলাকা থেকে মুক্তিযোদ্ধারা যুদ্ধ স্থানে পৌঁছে যায়। তারপর সবার সহায়তায় সঙ্গবদ্ধ হয়ে ছোট ছোট দলে বিভক্ত হয়ে স্থান ত্যাগ করি। সেদিন আমরা বহু পাক সেনা ও রাজাকারকে হত্যা করতে সক্ষম হই। সেইসঙ্গে ১৪ জন রাজাকারকে জীবিত ধরে নিয়ে হত্যা করি। এ যুদ্ধে আমরা সাদেক আলী, মধু মণ্ডল, আকুল শেখ, জহুরুল ইসলামসহ বেশ কয়েকজন সাথীকে হারাই।
রাহাত আলী আক্ষেপ করে বলেন, সেদিন যদি মাঝখানে থাকা নজরুল ভাইসহ অনান্য মুক্তিযোদ্ধারা ভুল করে সরে না যেতেন তাহলে পাক সেনা ও রাজাকারদের পাখির মতো মারতে পারতাম।
মুক্তিযুদ্ধকালীন স্মৃতি বুকে নিয়ে আজো বেঁচে আছেন রাহাত আলী। স্বাধীনতার পরে সম্মান পেয়েছেন বীর মুক্তিযোদ্ধার। লাল মুক্তিবার্তার এই গেরিলা মুক্তিযোদ্ধা রাষ্ট্রের কাছ থেকে স্বীকৃতি স্বরূপ পেয়েছেন থাকার জন্য ‘বীর নিবাস’। স্ত্রীকে নিয়ে সেখানেই বাস করেন তিনি।
বাংলাদেশ সময়: ১১৪২ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ০৪, ২০১৯
আরএ