ঢাকা: গত একযুগে টানা তিন মেয়াদে আওয়ামী লীগ সরকারের উন্নয়নের কথা তুলে ধরে প্রধানমন্ত্রী ও দলটির সভাপতি শেখ হাসিনা বলেছেন, গত একযুগে আমরা জনগণের জন্য কী করেছি, তা মূল্যায়নের ভার আপনাদের।
বৃহস্পতিবার (৭ জানুয়ারি) সন্ধ্যায় আওয়ামী লীগ সরকারের বর্তমান মেয়াদে দুই বছর পূর্তি ও তৃতীয় বছরে পদার্পণ উপলক্ষে জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে একথা বলেন তিনি।
বাংলাদেশের ইতিহাসে সবচেয়ে দীর্ঘ সময়ের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, জনগণের সরকার হিসেবে মানুষের জীবনমান উন্নয়ন করা আমাদের দায়িত্ব এবং কর্তব্য বলেই আমি মনে করি। গত একযুগে আমরা জনগণের জন্য কী করেছি, তা মূল্যায়নের ভার আপনাদের।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ২০০৯ সালে রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্ব গ্রহণের পর আওয়ামী লীগ সরকারের গত ১২ বছরের শাসনামলে বাংলাদেশ বিশ্বের বুকে একটি আত্মমর্যাদাশীল দেশ হিসেবে প্রতিষ্ঠা পেয়েছে। আর্থ-সামাজিক এবং অবকাঠামো খাতে বাংলাদেশের বিস্ময়কর উন্নয়ন সাধিত হয়েছে। দ্য ইকোনমিস্ট-এর ২০২০ সালের প্রতিবেদন অনুযায়ী ৬৬টি উদীয়মান সবল অর্থনীতির দেশের তালিকায় বাংলাদেশের অবস্থান ৯ম। ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরামের পূর্বাভাস অনুযায়ী ২০৩০ সাল নাগাদ বাংলাদেশ হবে বিশ্বের ২৪তম বৃহত্তম অর্থনীতির দেশ।
আওয়ামী লীগ সরকারের বর্তমান মেয়াদের তৃতীয় বছর শুরু করা প্রসঙ্গে প্রধানমন্ত্রী বলেন, বাংলাদেশের উন্নয়ন অভিযাত্রার এক গুরুত্বপূর্ণ সন্ধিক্ষণে এবং বৈশ্বিক মহামারির অস্বাভাবিক পরিস্থিতিতে আপনাদের সামনে হাজির হয়েছি। দুই বছর আগে আজকের এই দিনে তৃতীয় মেয়াদে সরকার পরিচালনার যে গুরুদায়িত্ব আপনারা আমার উপর অর্পণ করেছিলেন, সেটিকে পবিত্র আমানত হিসেবে গ্রহণ করে আমরা সরকার পরিচালনার তৃতীয় বছর শুরু করতে যাচ্ছি।
বিদ্যুৎ সেক্টরের উন্নয়নের কথা তুলে ধরে সরকার প্রধান বলেন, ২০০৯ থেকে ২০২০ পর্যন্ত প্রায় ১৯ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ জাতীয় গ্রিডে যুক্ত হয়েছে। বর্তমানে দৈনিক বিদ্যুৎ উৎপাদনের সক্ষমতা দাঁড়িয়েছে ২৪ হাজার ৪২১ মেগাওয়াটে। বিদ্যুৎ সুবিধাভোগী জনসংখ্যা ২০০৫-০৬ সালের ৪৭ শতাংশ থেকে বর্তমানে ৯৯ শতাংশে উন্নীত হয়েছে। দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনার অংশ হিসেবে পায়রাতে ইতোমধ্যে ১ হাজার ৩২০ মেগাওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপিত হয়েছে। রামপাল, পায়রা, বাঁশখালী, মহেশখালী এবং মাতারবাড়িতে আরও মোট ৭ হাজার ৮০০ মেগাওয়াট শক্তিসম্পন্ন বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণকাজ চলছে।
সবার ঘরে বিদ্যুৎ পৌঁছে দিতে সরকারের চলমান কার্যক্রমের কথা তুলে ধরে তিনি বলেন, মুজিববর্ষ ও স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীতে শতভাগ মানুষের ঘরে বিদ্যুৎ পৌঁছে দেওয়া হবে। সব ঘর আলোকিত হবে।
চট্টগ্রামে কর্ণফুলী নদীর তলদেশে টানেল নির্মাণে ৬২ শতাংশ কাজ সমাপ্ত হয়েছে বলে জানান শেখ হাসিনা।
খাদ্য উৎপাদন প্রসঙ্গে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ২০১৯-২০ অর্থবছরে দানাদার খাদ্যশস্য উৎপাদনের পরিমাণ ছিল ৪ কোটি ৫৩ লাখ ৪৪ হাজার মেট্রিক টন। বাংলাদেশ বিশ্বে ধান উৎপাদনে চতুর্থ থেকে তৃতীয় স্থানে উন্নীত হয়েছে। অব্যাহত নীতি সহায়তা ও প্রণোদনার মাধ্যমে কৃষিক্ষেত্রে এই বিপ্লব সাধিত হয়েছে। শুধু ২০১৯-২০ বছরে কৃষিখাতে ৭ হাজার ১৮৮ কোটিরও বেশি টাকা ভর্তুকি দেওয়া হয়েছে। মাছ-মাংস, ডিম, শাকসবজি উৎপাদনেও বাংলাদেশ স্বয়ংসম্পূর্ণ। অভ্যন্তরীণ মুক্ত জলাশয়ে মাছ উৎপাদন বৃদ্ধির হারে বাংলাদেশ দ্বিতীয় স্থানে এবং ইলিশ উৎপাদনকারী ১১ দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান প্রথম।
গ্রামের অর্থনীতিকে এগিয়ে নিতে সরকারের উদ্যোগের কথা তুলে ধরে শেখ হাসিনা বলেন, আমাদের গ্রামগুলি বরাবরই উন্নয়ন ভাবনার বাইরে ছিল। আমরাই প্রথম গ্রামোন্নয়নকে উন্নয়নের মূলধারায় সম্পৃক্ত করি। ২০১৮ সালে আমাদের নির্বাচনী ইশতেহারে বিষটি অন্তর্ভুক্ত করে ‘আমার গ্রাম, আমার শহর’ এই প্রতিপাদ্য সামনে রেখে প্রতিটি গ্রামে আধুনিক নগর সুবিধা সম্প্রসারণের অঙ্গীকার করি।
২০০৯ থেকে ২০২০ পর্যন্ত পল্লি এলাকায় ৬৩ হাজার ৬৫৫ কিলোমিটার সড়ক উন্নয়ন, ৩ লাখ ৭৬ হাজার ব্রিজ-কালভার্ট, ১ হাজার ৬৮৫টি ইউনিয়ন পরিষদ কমপ্লেক্স ভবন, ৯৩৬টি সাইক্লোন সেন্টার এবং ২৪৯টি উপজেলা কমপ্লেক্স ভবন নির্মাণ করা হয়েছে। ৪৫৩ কিলোমিটার জাতীয় মহাসড়ক ৪ বা তদূর্ধ্ব লেনে উন্নীত করা হয়েছে। আরও ৬৬১ কিলোমিটার মহাসড়ক চার এবং তদূর্ধ্ব লেনে উন্নীত করার কাজ চলছে বলে জানান সরকার প্রধান।
রেলের উন্নয়নের কথা তুলে ধরে তিনি বলেন, ২০০৯ থেকে ২০২০ পর্যন্ত ৪৫১ কিলোমিটার নতুন রেলপথ নির্মাণ এবং ১ হাজার ১৮১ কিলোমিটার রেলপথ পুনর্বাসন করা হয়েছে। ৪২৮টি নতুন রেলসেতু নির্মাণ করা হয়েছে। কিছুদিন আগে আমরা যমুনা নদীর উপর ৪ দশমিক ৮ কিলোমটির দীর্ঘ বঙ্গবন্ধু রেলওয়ে সেতুর ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেছি। লোকোমোটিভ যাত্রীবাহী ক্যারেজ এবং মালবাহী ওয়াগন সংগ্রহ করা হয়েছে ১ হাজার ৪০টি। এসময় বাংলাদেশ রেলওয়েতে ১৩৭টি নতুন ট্রেন চালু করা হয়েছে।
আকাশপথে যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়নের চিত্র তুলে ধরে শেখ হাসিনা বলেন, বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের বিমানবহরে ১২টি নতুন অত্যাধুনিক বোয়িং এবং ড্রিমলাইনার উড়োজাহাজ সংযোজিত হয়েছে। গত মাসে একটি ড্যাশ-৮-৪০০ উড়োজাহাজ সংযোজিত হয়েছে। চলতি মাসে আরও দু’টি ড্যাশ-৮-৪০০ উড়োজাহাজ সংযোজিত হবে।
স্বাস্থ্যখাতের উন্নয়ন তুলে ধরে প্রধানমন্ত্রী বলেন, সরকারি-বেসরকারি মিলিয়ে স্বাস্থ্যখাতে বাংলাদেশের ব্যাপক ইতিবাচক পরিবর্তন সাধিত হয়েছে।
করোনা ভাইরাসের মহামারি সত্ত্বেও আমাদের অর্থনীতি সঠিক পথে অগ্রসর হচ্ছে বলে জানান সরকার প্রধান।
করোনার মধ্যেও মেগা প্রজেক্টগুলোর কাজ পূর্ণ্যোদ্দমে এগিয়ে যাচ্ছে বলে জানান তিনি।
এ পর্যন্ত পদ্মাসেতুর ৮২ শতাংশ কাজ শেষ হয়েছে জানিয়ে শেখ হাসিনা বলেন, আশা করা হচ্ছে, আগামী বছর এই স্বপ্নের সেতু যানবাহন এবং রেল চলাচলের জন্য উন্মুক্ত করে দেওয়া সম্ভব হবে।
মেট্রোরেল বাস্তবায়নের অগ্রগতির কথা জানিয়ে তিনি বলেন, উত্তরা থেকে আগারগাঁও পর্যন্ত ১৪ কিলোমিটার অংশে রেললাইন বসানো হয়েছে। শিগগিরই জাপান থেকে ট্রেন ঢাকায় পৌঁছাবে।
এক লাখ ১৩ হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে দেশের ইতিহাসে এ যাবতকালের সর্ববৃহৎ উন্নয়ন প্রকল্প রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের ১২শ মেগাওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন প্রথম ইউনিটের নির্মাণ কাজের ৮০ শতাংশ ইতোমধ্যে শেষ হয়েছে জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, নির্ধারিত সময় ২০২৩ সালের এপ্রিল নাগাদ এই ইউনিট থেকে জাতীয় গ্রিডে বিদ্যুৎ সরবরাহ সম্ভব হবে। রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র দেশের প্রযুক্তিগত উন্নয়নের ক্ষেত্রে এক বৈপ্লবিক পরিবর্তন সাধন করবে।
গত সপ্তাহে ২০২১-২০২৫ মেয়াদি অষ্টম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা অনুমোদন হওয়ার কথা উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, অষ্টম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা বাস্তবায়নে প্রাক্কলিত ব্যয় ধরা হয়েছে ৬৪ লাখ ৯৫ হাজার ৯৮০ কোটি টাকা। এ মেয়াদে ১ কোটি ১৬ লাখ ৭০ হাজার কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হবে। অষ্টম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা বাস্তবায়ন শেষে দারিদ্র্যের হার ১৫ দশমিক ৬ শতাংশে এবং চরম দারিদ্র্যের হার ৭ দশমিক ৪ শতাংশে নেমে আসবে। অষ্টম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনার পাশাপাশি প্রধানমন্ত্রীর ১০টি উদ্যোগ বাস্তবায়ন অব্যাহত থাকবে যা দারিদ্র্য বিমোচনে সহায়ক হবে।
অষ্টম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনার শেষ বছর ২০২৫ সালে জিডিপি প্রবৃদ্ধি ৮ দশমিক ৫১ শতাংশে উন্নীত হবে বলেও আশা প্রকাশ করেন তিনি।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ২০৩১ সালের মধ্যে বাংলাদেশ হবে উচ্চ মধ্যম আয়ের দেশ এবং ২০৪১ সালের মধ্যে উচ্চ আয়ের সমৃদ্ধশালী মর্যাদাশীল দেশ। আমরা ২০২১ সালের আগেই উন্নয়নশীল দেশে উন্নীত হওয়ার যোগ্যতা অর্জন করেছি। প্রত্যাশিত লক্ষ্যে পৌঁছাতে আমরা পথ-নকশা তৈরি করেছি। রূপকল্প ২০৪১-এর কৌশলগত দলিল হিসেবে দ্বিতীয় পরিপ্রেক্ষিত পরিকল্পনা ২০২১-২০৪১ প্রণয়ন করা হয়েছে।
২০১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বর একাদশ সংসদ নির্বাচনে নিরঙ্কুশ জয় পায় আওয়ামী লীগ। এরপর ২০১৯ সালের ৭ জানুয়ারি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে টানা তৃতীয় বারের মতো সরকার গঠন করে আওয়ামী লীগ। বাংলাদেশের ইতিহাসে টানা এতদিন ক্ষমতায় থাকার রেকর্ড আর কারও নেই।
***২০২৫-এ চরম দারিদ্র্য ৭ শতাংশে নেমে আসবে: প্রধানমন্ত্রী
***টিকা দ্রুত আনতে সব ধরনের চেষ্টা করছি: প্রধানমন্ত্রী
***দুর্নীতিবাজ যে দলেরই হোক ছাড় নেই: প্রধানমন্ত্রী
বাংলাদেশ সময়: ২১২৮ ঘণ্টা, জানুয়ারি ০৭, ২০২০
এমইউএম/এএ