ঢাকা: দেশের সড়ক, রেল, নৌপথে সব শ্রেণির গণপরিবহনে শিক্ষার্থীদের হাফ ভাড়ায় যাতায়াতের সুযোগের দাবি জানিয়েছে বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতি।
একইসঙ্গে দেশের যাত্রী সাধারণকে অতিরিক্ত ভাড়া আদায়ের নৈরাজ্যের হাত থেকে মুক্তি দিতে সব পথে সরকার নির্ধারিত ভাড়া কার্যকর করার দাবিও জানিয়েছে সংগঠনটি।
শনিবার (৪ ডিসেম্বর) সকালে ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটির সামনে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে যাত্রী কল্যাণ সমিতির মহাসচিব মো. মোজাম্মেল হক চৌধুরী এ দাবি জানান।
তিনি বলেন, শিক্ষার্থীদের দীর্ঘদিন আন্দোলনের পর প্রথমে সড়ক পরিবহনমন্ত্রী সারা দেশের বিআরটিসি বাসে ও পরে বাস মালিক সমিতি ঢাকা মহানগরীতে ১ ডিসেম্বর থেকে শিক্ষার্থীদের হাফ পাসের সুবিধা দেওয়ার ঘোষণা দিলেও এখনও তা পুরোপুরি কার্যকর হয়নি। রাজধানীর অনেক বাসে শিক্ষার্থীদের উঠানো হচ্ছে না। অনেক বাসে অর্ধেক ভাড়া নিচ্ছে না। শিক্ষার্থীরা হাফ ভাড়া দিলে তাদের সঙ্গে দুর্ব্যবহার করা হচ্ছে। অনেক শিক্ষার্থীকে বাস থেকে নামার সময় ধাক্কা দিয়ে নামিয়ে দিচ্ছে।
মোজাম্মেল হক চৌধুরী আরও বলেন, পরিবহন সেক্টরে যারা নেতৃত্ব দিচ্ছেন সড়কে এহেন অব্যবস্থাপনার জন্য তারাই দায়ী। এই সেক্টরের ইতিবাচক পরিবর্তনের জন্য বর্তমানে নেতৃত্বদানকারী পরিবহন মালিক-শ্রমিক নেতৃত্বের পরিবর্তন জরুরি।
এ সময় তিনি দেশের সড়ক পথে সব শ্রেণির গণপরিবহনে অতিরিক্ত ভাড়া আদায়ের নৈরাজ্য বন্ধ করে সরকার নির্ধারিত ভাড়া কার্যকর করার দাবি জানান। এ লক্ষ্যে বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির ২০ দফা সুপারিশ জমা দেন।
দাবিগুলো- সারাদেশের সড়ক, রেল, নৌ-পথে সব শ্রেণির গণপরিবহনে একজন শিক্ষার্থীকে তার ছাত্র জীবনে সার্বক্ষণিক এবং যেকোন দিন, যেকোন সময় আইডি কার্ড প্রদর্শন সাপেক্ষ্যে হাফ পাস সুবিধা নিয়ে অর্ধেক ভাড়ায় যাতায়াতের সুযোগ দেওয়া; ছাত্র-ছাত্রীদের পরিবহনে অস্বীকৃতি জানালে, হাফ ভাড়া না নিলে, সংশ্লিষ্ট পরিবহনের চালক, সহকারী, কাউন্টারম্যান, টিকিট বিক্রয়কারীর কি শাস্তি হবে তা স্পষ্ট করে স্ব-স্ব মন্ত্রণালয় থেকে নির্দেশনা জারি করা; সব শ্রেণির গণপরিবহন দৈনিক চুক্তিতে ইজারা দেওয়া বন্ধ করে ভাড়া নির্ধারণের শর্তানুযায়ী মালিকের শুধু মুনাফা পাওয়ার বিষয়টি নিশ্চিত করা; সব শ্রেণির গণপরিবহনে সরকার নির্ধারিত ভাড়ার তালিকা স্পষ্ট আকারে, দৃশ্যমান স্থানে, যাত্রী সাধারণ যাতে সহজে পড়তে পারে সেই অনুযায়ী প্রদর্শন করা; সব পথের গণপরিবহনে মালিকদের ইচ্ছেমতো ভাড়া আদায় বন্ধ করে সরকার নির্ধারিত ভাড়ার তালিকা অনুযায়ী কিলোমিটার প্রতি ভাড়া আদায় নিশ্চিত করা; নারী যাত্রীদের কটূক্তি ও যৌন হয়রানি মুক্ত যাতায়াত ব্যবস্থা গড়ে তোলা মাধ্যমে গণপরিবহনে নারীর নিরাপত্তা নিশ্চিত করা।
এছাড়া সরকারি তালিকার অতিরিক্ত ভাড়া দেওয়ার অস্বীকৃতি জানালে যাত্রীদের কটূক্তি করা, অপমান-অপদস্ত করা, নামার সময় ধাক্কা দিয়ে নামিয়ে দেওয়ার মত কর্মকাণ্ড বন্ধ করা; অতিরিক্ত ভাড়া আদায় বন্ধের অভিযানে অভিযুক্ত বাসের মালিক-চালক-সহকারীর পাশাপাশি কোম্পানির এমডি, চেয়ারম্যানকে শাস্তির আওতায় আনা; গণপরিবহন নিয়ন্ত্রক সংস্থাগুলোর অনিয়ম-দুর্নীতি বন্ধ করা; মালিক সমিতির প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী সিটিং সার্ভিসের নামে ভাড়া ডাকাতি বন্ধে ওয়েবিল প্রথা বাতিল করতে হবে এবং যাত্রীর মাথা গুণে স্বল্প দূরত্বের যাতায়াতকারীর ক্ষেত্রেও পুরো পথের ভাড়া আদায় বন্ধ করা; সিটি সার্ভিস ও শহরতলীর বাসের ভাড়া নির্ধারণে ৭০ শতাংশ গড় ধরে ভাড়া নির্ধারণ করা হয়েছে। তাই বাকি ৩০ শতাংশ আসনে শিক্ষার্থী, প্রতিবন্ধী, বয়স্ক ব্যক্তি ও দাঁড়ানো যাত্রীদের অর্ধেক ভাড়ায় যাতায়াতের সুযোগ দেওয়া; ডিজেলের মূল্য বৃদ্ধির কারণে সরকার ডিজেল চালিত বাস মিনিবাসের ভাড়া বৃদ্ধি করেছে কিন্তু দেশব্যাপী চলাচলরত সিএনজিচালিত হিউম্যান হলার, লেগুনা, বাস-মিনিবাসের ভাড়া নৈরাজ্য চলছে। এসব যানবাহনে সরকারিভাবে ভাড়া নির্ধারণ করে ভাড়া নৈরাজ্য বন্ধ করা।
বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির পক্ষ থেকে বর্তমান সরকারের গত একযুগের ধারাবাহিক উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের ফলে দেশের সড়ক-মহাসড়কে গতি বেড়েছে, বহু মহাসড়কে দূরত্ব কমেছে। তাই দূরপাল্লার রুটে যাত্রী প্রতিনিধি সঙ্গে নিয়ে প্রতিটি রুটে দূরত্ব জালিয়াতি ও কিলোমিটার চুরি বন্ধ করে ভাড়ার তালিকা সংশোধন করা; গণপরিবহনে চাঁদাবাজি ও পুলিশি হয়রানি বন্ধ করা; কথায় কথায় যেকোন ঠুনকো অজুহাতে গণপরিবহন বন্ধ করে দিয়ে যাত্রীদের জিম্মি করার মতো বেআইনি কর্মকাণ্ড বন্ধ করা; যাত্রীর নিরাপত্তায় ফিটনেসবিহীন যানবাহন ও লাইসেন্সবিহীন চালক উচ্ছেদ করা; সড়ক পরিবহন আইন-২০১৮ অনুযায়ী সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত প্রত্যেক পরিবারকে ২০ লাখ টাকা, আহত ভিকটিমকে ১০ লাখ টাকা ক্ষতিপূরণ দেওয়া; গণপরিবহনের ভাড়া নির্ধারণে সরকার ও মালিকদের সমন্বয়ে গঠিত কমিটি বাতিল করে বাস ও লঞ্চের ভাড়া নির্ধারন কমিটিতে যাত্রী প্রতিনিধি অন্তর্ভুক্ত করা; এবং নিয়ন্ত্রক সংস্থাগুলোর সক্ষমতা বাড়ানোর পাশাপাশি জবাবদিহিতা নিশ্চিত করার দাবিও জানানো হয়।
সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হিসাববিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপিকা মোশাহিদা সুলতানা, ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়নের সাবেক সভাপতি আবু জাফর সূর্য, সাংবাদিক মঞ্জুরুল আলম পান্না, সেইফ রোড অ্যান্ড ট্রান্সপোর্ট এলায়েন্স (স্রোতা)- এর সভাপতি ড. হোসেন জিল্লুর রহমান প্রমুখ।
বক্তারা বলেন, পরিবহন ধর্মঘটের নামে জনগণকে জিম্মি করে সরকারের কাছ থেকে নানাভাবে ফায়দা লুটছে একটি শ্রেণি। তারা রাজধানীর বাসে বারবার ঘোষণা দিয়েও সিটিং সার্ভিসের ভাড়া নৈরাজ্য বন্ধ না করে এসব গাড়িতে সরকার নির্ধারিত ভাড়ার ৩ থেকে ৪ গুণ বাড়তি ভাড়া আদায় করে নগর জীবন বিষিয়ে তুলেছে। এই নৈরাজ্য বন্ধ করতে আমাদের খুব দ্রুত কার্যকরী পদক্ষেপ নেওয়া উচিত।
বাংলাদেশ সময়: ১৪১০ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ০৪, ২০২১
এইচএমএস/এএটি