মাদারীপুর: রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষের পর মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে দিশেহারা পাকিস্তানি বাহিনীর সদস্যদের আত্মসমর্পণের মধ্য দিয়ে ১০ ডিসেম্বর শত্রুমুক্ত হয় মাদারীপুর।
১৯৭১ সালের ডিসেম্বর টানা দুইদিন একরাত সম্মুখযুদ্ধ শেষে দিশেহারা হয়ে হানাদার বাহিনীর সদস্যরা মুক্তিযোদ্ধা খলিল বাহিনী প্রধান খলিলুর রহমান খানের কাছে আত্মসমর্পণ করেন।
জানা গেছে, ১৯৭১ সালের ডিসেম্বরের প্রথম সপ্তাহ থেকেই মাদারীপুর জেলার সবকটি থানা মুক্তিযোদ্ধাদের দখলে চলে আসে। এর ফলে হানাদার বাহিনী ও তাদের দোসররা মাদারীপুর শহরের এ. আর. হাওলাদার জুট মিলের অভ্যন্তরে ও নাজিমউদ্দিন কলেজে অবস্থান নেয়। তখন মুক্তিযোদ্ধারা চারদিক থেকে তাদের ঘিরে রাখে। ৮ ডিসেম্বর দুপুরে তৎকালীন মহকুমা প্রশাসক আবদুল মতিনের চালক আলাউদ্দিন কলাগাছিয়া মুক্তিযোদ্ধা ক্যাম্পে সংবাদ পৌঁছে দেয় যে, ৯ ডিসেম্বর ভোর রাতে হানাদার বাহিনী মাদারীপুর থেকে ফরিদপুরের উদ্দেশ্যে পালিয়ে যাবে। এ সংবাদ পেয়ে বিভিন্ন অঞ্চলের তিন শতাধিক মুক্তিযোদ্ধা সদর উপজেলার ঘটকচর থেকে সমাদ্দার সেতুর পশ্চিম পার পর্যন্ত মহাসড়কের দু'পাশে প্রায় ৪ কিলোমিটার পথে অবস্থান নেয়।
৯ ডিসেম্বর ভোর ৫টায় হানাদার বাহিনী গোলবারুদ, অস্ত্র ও কনভয়সহ তাদের বাঙালি দোসর রাজাকার, আলবদর, আলসামস ও মুজাহিদ বাহিনী নিয়ে ফরিদপুরের উদ্দেশ্যে রওনা দেয়। ভোর সাড়ে ৫টার দিকে ঘটকচর সেতু পার হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে মুক্তিযোদ্ধারা আক্রমণ শুরু করে। ৯ ডিসেম্বর সারাদিন সারারাত এবং ১০ ডিসেম্বর সারা দিন সম্মুখ যুদ্ধ চলে মুক্তিযোদ্ধা ও হানাদার বাহিনীর মধ্যে। তুমুল যুদ্ধের এক পর্যায়ে হানাদার বাহিনীর গোলা-বারুদ শেষ হয়ে আসলে ১০ ডিসেম্বর দুপুরের পর মুক্তিযোদ্ধাদের পক্ষ থেকে হ্যান্ডমাইকযোগে পাকিস্তানি বাহিনীকে আত্মসর্পণের আহ্বান জানানো হয়। এতে সাড়া দিয়ে হানাদার বাহিনী রাইফেলের মাথায় সাদা কাপড় উড়িয়ে বাঙ্কার থেকে বেরিয়ে আসে এবং কৌশলে পাশের খাল থেকে পানি, গাড়ি থেকে শুকনো খাবার ও গোলা-বারুদ নিয়ে পুনরায় বাঙ্কারে ঢুকে গুলিবর্ষণ শুরু করে।
মুক্তিযোদ্ধারাও তীব্র প্রতিরোধ গড়ে তোলে। মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতিরোধের মুখে ১০ ডিসেম্বর সন্ধ্যার আগেই হানাদার বাহিনীর মেজর আবদুল হামিদ খটক ৩৯ সেনা এবং ১৪ রাজাকারসহ ৫৩ জনের একটি দল নিয়ে খলিল বাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ করেন। মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে পাক বাহিনীর আত্মসমর্পণ করলে শত্রুমুক্ত হয় মাদারীপুর। এ সংবাদ জেলার বিভিন্ন স্থানে পৌঁছালে হাজার হাজার মুক্তিকামী মানুষ জয়বাংলা স্লোগান দিয়ে রাস্তায় নেমে আসে। আনন্দ-উল্লাসে ফেটে পড়ে।
এই যুদ্ধে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন খলিল বাহিনী প্রধান মুক্তিযোদ্ধা খলিলুর রহমান খান। এই যুদ্ধে শহীদ হন মাদারীপুরের সর্ব কনিষ্ঠ মুক্তিযোদ্ধা সরোয়ার হোসেন বাচ্চু। দুঃসাহসিক এই ক্ষুদে মুক্তিযোদ্ধা শত্রুর ব্যাঙ্কারে গ্রেনেড চার্জ করে ক্রোলিং করে ফিরে আসার সময় ক্রস ফায়ারে শহীদ হন। যুদ্ধে ২০ হানাদার সেনা নিহত হয়।
মুক্তিযোদ্ধা ও খলিল বাহিনীর প্রধান খলিলুর রহমান খান বলেন, ‘আজ আমাদের বিজয়ের দিন, দুঃসাহসিকতার দিন। দিনটি আমাদের মাদারীপুরের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কেননা এই দিনে হানাদার বাহিনীর সদস্যরা আমাদের সঙ্গে সম্মুখযুদ্ধে আত্মসমর্পণ করে। দিনটি প্রতি বছরের মত এবারও বিশেষ মর্যাদায় পালন করা হবে।
বাংলাদেশ সময়: ১১০৪ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ১০, ২০২১
কেএআর