নোয়াখালী: বীরশ্রেষ্ঠ শহীদ রুহুল আমিনের ৫০তম শাহাদাতবার্ষিকী ১০ ডিসেম্বর। একাত্তরের এ দিনটিতে খুলনার রূপসা নদীতে যুদ্ধজাহাজ পলাশে শত্রুপক্ষের প্লেন হামলায় শহীদ হন তিনি।
যেভাবে শহীদ হন:
৬ ডিসেম্বর মুক্তিবাহিনী যশোর সেনানিবাস দখলের পর পদ্মা, পলাশ এবং ভারতীয় মিত্রবাহিনীর একটি গানবোট ‘পানভেল’ খুলনার মংলা বন্দরে পাকিস্তানি নৌ-ঘাটি পিএনএস তিতুমীর দখলের উদ্দেশে বাংলাদেশে প্রবেশ করে। ১০ ডিসেম্বর দুপুর ১২টার দিকে গানবোটগুলো খুলনা শিপইয়ার্ডের কাছে এলে অনেক উঁচুতে তিনটি জঙ্গি প্লেন উড়তে দেখা যায়। শত্রুর প্লেন অনুধাবন করে পদ্মা ও পলাশ থেকে গুলি করার অনুমতি চাওয়া হয়। কিন্তু অভিযানের সর্বাধিনায়ক ক্যাপ্টেন মনেন্দ্র নাথ ভারতীয় প্লেন মনে করে গুলি ছুড়তে নিষেধ করেন।
এর কিছুক্ষণ পর প্লেনগুলো অপ্রত্যাশিতভাবে নিচের দিকে নেমে আসে এবং আচমকা গুলিবর্ষণ শুরু করে। গোলা সরাসরি ‘পদ্মা’র ইঞ্জিন রুমে আঘাত করে ইঞ্জিন বিধস্ত করে। হতাহত হন অনেক নাবিক। পদ্মার পরিণতিতে পলাশের অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কমান্ডার রায় চৌধুরী নাবিকদের জাহাজ ত্যাগের নির্দেশ দেন। রুহুল আমিন এ আদেশে ক্ষিপ্ত হন। তিনি উপস্থিত সবাইকে যুদ্ধ বন্ধ না করার আহ্বান জানান। কামানের ক্রুদের প্লেনের দিকে গুলি ছুড়তে বলে তিনি ইঞ্জিন রুমে ফিরে আসেন। কিন্তু অধিনায়কের আদেশ অমান্য করে প্লেনগুলো চ্যালেঞ্জ করা হয়নি। প্লেন থেকে উপর্যুপরি বোমাবর্ষণ করে পলাশের ইঞ্জিন রুম ধ্বংস করে দেয়। শহীদ হন রুহুল আমিন। পরে রূপসা নদীর পাড়ে তাকে সমাহিত করা হয়।
সংক্ষিপ্ত জীবনী:
বীরশ্রেষ্ঠ রুহুল আমিন ১৯৩৫ সালে নোয়াখালীর সোনাইমুড়ি উপজেলার শহীদ রুহুল আমিন (বাঘপাচড়া গ্রাম) নগরে জন্মনেন। তাঁর পিতার নাম আজহার পাটোয়ারী, মাতা জুলেখা খাতুন। রুহুল আমিন বাঘপাঁচড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পড়াশোনা শেষ করে আমিশাপাড়া উচ্চ বিদ্যালয়ে ভর্তি হন। তিনি ১৯৫৩ সালে জুনিয়র মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে নৌ-বাহিনীতে যোগদান করে আরব সাগরে অবস্থিত নানোরা দ্বীপে পিএনএস বাহাদুর-এ প্রাথমিক প্রশিক্ষণ নেন। প্রশিক্ষণ শেষ করে তিনি পিএনএস কারসাজে যোগদান করেন।
১৯৫৮ সালে তিনি পেশাগত প্রশিক্ষণ শেষ করেন এবং ১৯৬৫ সালে মেকানিশিয়ান কোর্সের জন্য নির্বাচিত হন। পিএনএস কারসাজে কোর্স সমাপ্ত করার পর রুহুল আমিন আর্টিফিসার পদে নিযুক্ত হন। ১৯৬৮ সালে চট্টগ্রাম পিএনএস বখতিয়ার নৌ-ঘাটিতে বদলি হয়ে যান। ১৯৭১ এর এপ্রিলে ঘাঁটি থেকে পালিয়ে যান। রুহুল আমিন ভারতের ত্রিপুরা সীমান্ত অতিক্রম করে ২ নম্বর সেক্টরে মুক্তিযুদ্ধে যোগদান করেন। সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ২ নম্বর সেক্টরের অধীনে থেকে বিভিন্ন স্থলযুদ্ধে অংশনেন। বাংলাদেশ নৌ-বাহিনী গঠিত হলে তিনি কলকাতায় চলে আসেন। ভারত সরকার বাংলাদেশ সশস্ত্র বাহিনীকে দুটি গানবোট উপহার দেয়। গানবোটের নামকরণ করা হয় পদ্মা ও পলাশ। রুহুল আমিন পলাশের প্রধান ইঞ্জিন রুমে আর্টিফিসার হিসেবে দায়িত্ব নেন।
বীরশ্রেষ্ঠ শহীদ মো. রুহুল আমিন গ্রন্থগার ও স্মৃতি জাদুঘর:
২০০৮ সালে বীরশ্রেষ্ঠ শহীদ রুহুল আমিনের বাড়ির পাশে পরিবারের দান করা ২০ শতক জমির স্থানীয় সরকার বিভাগের অর্থায়নে নোয়াখালী জেলা পরিষদ বীরশ্রেষ্ঠ শহীদ মো. রুহুল আমিন গ্রন্থাগার ও স্মৃতি জাদুঘর প্রতিষ্ঠা করে। এখানে রয়েছে বিভিন্ন সময়ে তার পরিবারকে দেওয়া সরকারি-বেসরকারি পদকের পাশাপাশি মুক্তিযুদ্ধ সহ নানা বিষয়ের বই, আছে মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক নানা পোস্টার, সাময়িকী আর পত্রপত্রিকা। তবে, প্রয়োজনের তুলনায় তা নিতান্তই কম বলে মনে করেন দর্শনার্থীরা। এলাকাবাসী ও দর্শর্নার্থীদের দাবি এই কমপ্লেক্সকে ঘিরে সরকারিভাবে মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক নানা কর্মকান্ড পরিচালনার; যাতে করে নতুন প্রজন্ম মুক্তিযুদ্ধের প্রকৃত ইতিহাস সম্পর্কে জানতে পারে।
বীরশ্রেষ্ঠ রুহুল আমিনের পরিবারের দাবি, এ প্রতিষ্ঠানটিকে আরো আধুনিকায়নের পাশাপাশি সরকারিভাবে এখানে বীরশ্রেষ্ঠের জন্ম ও শাহাদাতবার্ষিকীসহ জাতীয় দিবসগুলো পালনের ব্যবস্থা করার। প্রতিষ্ঠানটি করার পর এ এলাকায় শিক্ষা, সংস্কৃতি এবং মুক্তিযুদ্ধের চেতনার প্রসার ঘটেছে। এখানে মুক্তিযুদ্ধ ভিত্তিক আরো বিভিন্ন রকম কার্যক্রম পরিচালনা করলে এলাকার ছাত্রছাত্রী এবং পরবর্তী প্রজম্ম মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে আরো বেশি করে জানতে পারবে এবং মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় নিজেদের গড়ে তুলতে পারবে।
বাংলাদেশ সময়: ১১১৬ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ১০, ২০২১
এসআই