মানিকগঞ্জ: ১৯৭১ সালে স্বাধীনতা যুদ্ধের আগে আমি পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে চাকরি করতাম। ২৫ মার্চ রাতে যখন বাঙালি জাতির ওপর জঘন্যতম হত্যাকাণ্ড চলে তখন আমি বাড়িতে ছুটিতে ছিলাম।
পরে একদিন মানিকগঞ্জ শহরে গিয়ে শুনি ক্যাপ্টেন হালিম চৌধুরী মুক্তিযুদ্ধ করার জন্য একটি সংগঠন করছে হরিরামপুরে। ওই সময় আমি হরিরামপুরের সুতালড়ি গ্রামের রফিক মাস্টারের বাড়ি গিয়ে হালিম চৌধুরীর সঙ্গে দেখা করি। তার সঙ্গে আমার আগে থেকে পরিচয় ছিল। ক্যাপ্টেন হালিম চৌধুরী আমাকে দেখে অনেক খুশি হয়ে বলেছিলেন এই মুহূর্তে তোমাকে অনেক প্রয়োজন আমাদের।
এভাবেই মুক্তিযুদ্ধের সময়ের স্মৃতিকথা বলছিলেন বীর মুক্তিযোদ্ধা টাইগার লোকমান হোসেন।
মানিকগঞ্জে মুক্তিযোদ্ধাদের প্রথম যুদ্ধ: ২২ জুন বুধবার ভোর বেলায় ঘিওর থানায় পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর ক্যাম্পে আমরা হামলা করি আর এই হামলায় প্রথম বিজয় অর্জন করি। পরে ওখান থেকে আমি আবার হরিরামপুরে চলে আসি। ক্যাপ্টেন হালিম চৌধুরী আমাকে বললেন তুমি সিংগাইর চলে যাবে আর ওখানে ইঞ্জিনিয়ার তোবারক হোসেন লুডু নামের একটি ছেলে আছে তার সঙ্গে দেখা করবে। ওখানে লুডু সাহেবের সঙ্গে থেকে মুক্তিযুদ্ধের জন্য ছেলে মেয়েদের সংগ্রহ করতে হবে এবং ট্রেনিং করাতে হবে। সিংগাইরে চারিগ্রামে খাল দিয়ে সেনাবাহিনীর রসদ নিয়ে একটি লঞ্চ যাচ্ছিলো সেটা আমরা ধ্বংস করি।
মানিকগঞ্জের সবচেয়ে বড় যুদ্ধ: একদিন হঠাৎ করে আমাদের এক সোর্স জানায় সিংগাইর থানা আর আমাদের ক্যাম্পে আক্রমণ হতে পারে। ওই সোর্সের কথা অনুযায়ী আমাদের ছেলেদের চার ভাগে বিভক্ত করে চারটি গ্রামে ছড়িয়ে দিলাম।
জানা গেল ঠিকই ২৯ অক্টোবর ভোর বেলায় একশ’র বেশি পাকিস্তানি বাহিনী খাল দিয়ে সাতটি নৌকায় করে সিংগাইর থেকে গোলাইডাঙ্গার উদ্দেশ্যে রওনা হয়েছে। আমরা ওই চার গ্রাম থেকে আমাদের ছেলেদের নিয়ে পৌঁছানোর আগেই তারা আমাদের অতিক্রম করে চলে যায়। পরে আমি সবাইকে বললাম কেউ কোনো কথা বলবা না ওরা এই জায়গা দিয়ে আসবে, তখন তোবারক হোসেন লুডু আমাকে বললো আমরা লেখাপড়া জানা মানুষ তবে যুদ্ধ সম্পর্কে ভালো জানি না আর এই যুদ্ধের নেতৃত্ব তোমাকেই দিতে হবে ভাই। পাকহানাদার বাহিনী যখন পাঁচ থেকে দশ মিনিট পর ফিরে আসছে তখন আমরা তিন দিক থেকে ফায়ার করি, পাকিস্তানি বাহিনীর ৬টি নৌকা ডুবিয়ে দেই। আমরা ভাবছিলাম শতাধিক পাকিস্তানি মারা গেছে। ওই সময় পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর প্রতিবেদনেই জানা যায় ৮৩ জন সেনা মারা যায় ওই যুদ্ধে। এছাড়াও আমি আরও চার পাঁচটি বড় বড় যুদ্ধ মানিকগঞ্জে করছি এমন কথা বলেন বীর মুক্তিযোদ্ধা টাইগার লোকমান হোসেন।
আপনার নাম কেন টাইগার লোকমান হলো- এমন প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, গোলাইডাঙ্গা যুদ্ধে আমি এক পাকিস্তানি সেনাকে জীবিত অবস্থায় থাবা দিয়ে ধরে ফেলি। ওই সময় আমার এক সাথী যোদ্ধা বলে তুই-তো বাঘের মতো করে ধরলি আর ওই থেকে নামের আগে টাইগার শব্দটা বসে যায়।
আপনার শোবার ঘরে বীর মুক্তিযোদ্ধাদের ছবি, কিভাবে সংগ্রহ করলেন এই ছবিগুলো, কেনো করলেন এবং নতুন প্রজন্মের জন্য কোনো মেসেজ আছে কি- এমন প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, এই ছবিগুলো সংগ্রহ করি নতুন প্রজন্মকে উদ্দেশ্য করে। আমি আমার মুক্তিযোদ্ধা বন্ধুদের বলি মানিকগঞ্জ জেলায় যত মুক্তিযোদ্ধা আছে সবার ছবি আমি আমার ঘরে রাখবো কারণ এই মুক্তিযোদ্ধারা তো সারা জীবন বেঁচে থাকবে না মারা যাবে, মারা গেলেও তাদের একটা স্মৃতি থাকবে আমার এই সংগ্রহশালায়। এটা ভেবেই আমি এই ছবি সংগ্রহ করতে শুরু করি। কেউ কেউ আমাকে ছবি দিয়েছে আবার আমার অনেক সাংবাদিক বন্ধুরা তাদের ক্যামেরায় ছবি সংগ্রহ করে আমাকে দিছে। নতুন প্রজন্মের ছেলে মেয়েরা তো তেমন কিছু জানে না, বন্ধের দিনগুলিতে অনেক ছেলে মেয়েরা আসে আমার বাড়িতে। তারা দেখে তার বাবার ছবি, দাদার ছবি আবার অনেকের নানার ছবি। আমি একটা কাজ করি এই স্মৃতি সংরক্ষণ কেন্দ্র নিয়ে। বিভিন্ন স্কুল-কলেজে গিয়ে ছাত্র-ছাত্রীদের নিয়ে মুক্তিযোদ্ধের ওপরে এক ঘণ্টার আলোচনা করি। কেন মুক্তিযুদ্ধে গেলাম, কার ডাকে গেলাম, কে স্বাধীনতার যুদ্ধের ঘোষক এই বিষয়গুলো ছেলে মেয়েদের বোঝাই। মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে চাওয়া পাওয়ার আর কিছু নেইই। বঙ্গবন্ধুর সুযোগ্য কন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনা অনেক দিয়েছেন, যে সম্মান রাষ্টিয়ভাবে দিয়েছে এই সম্মান আমার পাওয়ার কথা ছিল না যদি আমি মুক্তিযোদ্ধা না হতাম।
মানিকগঞ্জ জেলা মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার তোবারক হোসেন লুডু বাংলানিউজকে বলেন, টাইগার লোকমান হোসেন খুব সাহসী একজন মুক্তিযোদ্ধা, তিনি তার জীবনের কথা না ভেবে সব সময় সম্মুখ যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছেন। লোকমান যে পুরো মানিকগঞ্জ জেলার সব মুক্তিযোদ্ধাদের ছবি সংগ্রহ করে স্মৃতি সংগ্রহশালা করেছে এটা অবশ্যই প্রশংসার দাবিদার। আমরা মন্ত্রণালয়ে জানাবো তার এই মহতি উদ্যোগের কথা।
বাংলাদেশ সময়: ১১০৫ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ১৩, ২০২১
আরএ