ঢাকা: গাজীপুর সদরের ভাওয়াল নামে মাদকাসক্তি পুনর্বাসন কেন্দ্রেই চলতো মাদকের রমরমা বাণিজ্য। মাদকাসক্তি থেকে মুক্তির জন্য ভর্তি হওয়া রোগীদের ওপর চালানো হতো নির্যাতন।
এছাড়া, প্রয়োজনের অতিরিক্ত সময় ভর্তি রেখে অর্থ আদায় এবং অনৈতিক কার্যক্রম চলতো গাজীপুর সদরের ভাওয়াল মাদকাসক্তি পুনর্বাসন কেন্দ্রে। শুধু তাই নয়, পুনর্বাসন কেন্দ্র হলেও প্রতিষ্ঠানটির মালিক থেকে কর্মচারী সবাই নিজেরাই মাদকাসক্ত।
মঙ্গলবার (৪ জানুয়ারি) বিকেল থেকে ওই মাদকাসক্তি পুনর্বাসন কেন্দ্রে অভিযান চালিয়ে প্রতিষ্ঠানটির মালিক নাজনিন ফিরোজা বাঁধনসহ ৫ জনকে গ্রেফতার ও একজন চলচ্চিত্র অভিনেতাসহ ২৮ জনকে উদ্ধার করেছে র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র্যাব-২)।
বুধবার (৫ জানুয়ারি) দুপুরে রাজধানীর বসিলায় র্যাব-২ কার্যালয়ে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে এ তথ্য জানান র্যাবের লিগ্যাল অ্যান্ড মিডিয়া উইংয়ের পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন।
তিনি বলেন, গত ১ জানুয়ারি ‘বাংলাদেশ চলচ্চিত্র সমিতির’ পক্ষ থেকে র্যাবের কাছে অভিযোগ করা হয় একজন চিত্রনায়ক দীর্ঘদিন ধরে ভাওয়াল মাদকাসক্তি পুনর্বাসন কেন্দ্রে আটক রেখে নির্যাতন করা হচ্ছে। অভিযোগের ভিত্তিতে মঙ্গলবার (৪ জানুয়ারি) বিকেলে অভিযান চালিয়ে ওই চিত্রনায়কসহ ২৮ জনকে উদ্ধার করা হয়। এ সময় মালিক ফিরোজা নাজনিন ওরফে বাঁধন (৩৫), তার স্বামী মনোয়ার হোসেন ওরফে সিপন (৩১), রায়হান খান (২০), দিপংকর শাহ ওরফে দিপু (৪৪) ও জাকির হোসেন আনন্দকে (২৭) আটক করা হয়।
অভিযানে ৪২০ পিস ইয়াবা, নির্যাতনে ব্যবহৃত লাঠি, স্টিলের পাইপ, হাতকড়া, রশি, গামছা, খেলনা পিস্তল ও কথিত সাংবাদিকের পরিচয়পত্র উদ্ধার করা হয়। তাৎক্ষণিকভাবে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতর ভাওয়াল মাদকাসক্তি পুনর্বাসন কেন্দ্রের কার্যক্রম বন্ধ করে দেয়।
নায়ককে আটকে রাখার বিষয়ে জানতে চাইলে কমান্ডার খন্দকার আল মঈন বলেন, নায়ক করোনাকালীন সময়ে পাঁচটি সিনেমা করেছিলেন, যার কোনোটিই রিলিজ হয়নি। তার তিনটি রেস্টুরেন্টও ছিল। সেখানে ব্যবসাতেও লোকসান করে হতাশা-বিষাদে ভেঙে পড়েন। অর্ধকোটি টাকা ঋণে জর্জরিত হয়ে হতাশায় তিনি নিয়মিত ঘুমের ওষুধ সেবন শুরু করলে তার আচরণে কিছুটা অস্বাভাবিকতা পরিলক্ষিত হয়।
গতবছরের মার্চে তার মা চিকিৎসার জন্য তাকে ভাওয়াল মাদকাসক্ত পুনর্বাসন কেন্দ্রে নিয়ে আসেন। তবে ডোপ টেস্টে তাকে মাদকাসক্ত পাওয়া না হলেও তিন লাখ টাকা ভর্তি ফি ও ৫০ হাজার টাকা মাসিক খরচায় চিকিৎসার জন্য তাকে সেখানে ভর্তি করা হয়। পরবর্তীকালে সেখানে তিন মাস পরপর ভিকটিম নায়ককে অসুস্থ দেখা যায়। মূলত চিকিৎসার নামে তাকে আটকে রেখে প্রতিমাসে মোটা অংকের টাকা আদায় করাই ছিল প্রতিষ্ঠানটির মূল উদ্দেশ্য।
আটক ফিরোজা নাজনিন বাঁধনকে জিজ্ঞাসাবাদের ভিত্তিতে তিনি বলেন, বাঁধন ২০০৯ সালে ভাওয়াল মাদকাসক্তি পুনর্বাসন কেন্দ্রটি অনুমোদনহীনভাবে প্রতিষ্ঠা করেন। ২০১৩-১৪ সালে সাময়িক অনুমোদন পায়। কর্মী সংখ্যা ৪ জন এবং রোগীর সংখ্যা বর্তমানে ২৮ জন। তিনি যে ভবনটিতে থাকতেন সেটির ভাড়া বাবদ প্রতিমাসে ৪০ হাজার টাকা বাড়ির মালিককে পরিশোধ করতেন।
ভিকটিমরা র্যাবকে জানিয়েছে, বাঁধন প্রতি রোগীর কাছ থেকে মাসিক চার্জ হিসাবে ১০-৩০ হাজার টাকা করে আদায় করতেন। নিরাময় কেন্দ্রে দুইজন চিকিৎসক থাকার কথা বললেও কোনো চিকিৎসককে অভিযানকালে পাওয়া যায়নি। সেখানে ২০ জন রোগীর চিকিৎসার অনুমোদন থাকলেও ২৮ জন রোগী পাওয়া গেছে।
যেভাবে নিরাময় কেন্দ্র পরিচালনা করার কথা, চিকিৎসা দেওয়ার কথা, রোগীদের সেবা করার কথা তার ব্যাপক অনিয়ম এখানে পাওয়া যায়। নিরাময় কেন্দ্রে রোগীদেরকে চিকিৎসার নামে শারীরিক নির্যাতন, মানসিক নির্যাতন ও যৌন হয়রানি করা হতো। এখানে চিকিৎসার নামে রশির সাহায্যে ঝুলিয়ে শারীরিক নির্যাতন করা হতো।
প্রতিষ্ঠানটির মালিক-কর্মচারিদরর তাৎক্ষণিক ডোপ টেস্টের মাধ্যমে প্রমাণ পাওয়া যায় তারা সকলেই মাদকাসক্ত। আসলে মাদকাসক্ত নিরাময় কেন্দ্রের নামে সেখানে মাদক ব্যবসা পরিচালনা করা হতো। এলাকায় মাদক গ্রহীতারা প্রতিষ্ঠানের কর্মচারীদের কাছ থেকে মাদক সংগ্রহ করতেন।
বাংলাদেশ সময়: ১৮১৫ ঘণ্টা, জানুয়ারি ০৫, ২০২২
পিএম/এনটি