পঞ্চগড়: ‘টিউলিপ’ ফুল। পাত্রে চাষাবাদের উপযোগী এক প্রকার পুষ্পজাতীয় উদ্ভিদ।
গৃহের সৌন্দর্যবর্ধনের জন্য এ ফুলের বেশ সুনাম রয়েছে। তবে বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলের প্রথম ও দেশে দ্বিতীয়বারের মতো এবার খামার পর্যায়ে বাণিজ্যিকভাবে চাষ হচ্ছে সবচেয়ে দামি ফুল টিউলিপ।
দেশের সর্ব উত্তরের জেলা হিমালয়ের কন্যা খ্যাত পঞ্চগড়ে সমতল ভূমিতে চা, কমলা, মাল্টা, ড্রাগন ফল, সূর্যডিম আম চাষের খ্যাতি অর্জনের পর এবার খামার পর্যায়ে পঞ্চগড় জেলার তেঁতুলিয়া উপজেলায় বাণিজ্যিকভাবে টিউলিপ ফুল চাষ শুরু হয়েছে। শীত মৌসুমে আবহাওয়া অনুকূলে থাকায় ও পরিমিত তাপমাত্রা বিরাজ করায় প্রথমবারের মতো পরীক্ষামূলকভাবে বিদেশি জাতের ফুল টিউলিপ চাষ করে সফলতা পেয়েছে বেশ কয়েকজন কৃষক।
কৃষকের মুখে একটি প্রবাদ রয়েছে ‘পঞ্চগড়ের মাটি, সোনার চেয়েও খাঁটি। ’ মূলত এই প্রবাদটির বলার কারণ পঞ্চগড়ের মাটি ভৌগলিক কারণে উঁচু বেলে-দোআঁশ মাটি। এ মাটিতে বিভিন্ন ফসলের পাশাপাশি ফুল চাষের জন্য উৎকৃষ্ট। এর আগে, সব শেষে প্রান্তিক এ উপজেলায় বিশ্বের সবচেয়ে বেশি দামি জাপানের প্রজাতি আম ‘মিয়াজাকি’ চাষ শুরু হয়। যা বাংলায় সূর্যডিম নামে পরিচিত। এবার চাষ শুরু হয়েছে ভিন দেশি ফুল ‘টিউলিপ’র।
সরেজমিনে তেঁতুলিয়া উপজেলার সদর ইউনিয়নের শারিয়ালজোত ও দর্জিপাড়া এলাকা ঘুরে দেখা যায়, কৃষকরা তাদের টিউলিপ ফুল ক্ষেতে পরিচর্যার কাজে ব্যস্ত সময় পার করছেন। এদিকে তেঁতুলিয়ার মাটিতে এই ফুল হওয়ায় ফুল দেখতে পর্যটকদের ভিড় লক্ষ্য করা গেছে বাগানগুলোতে। অনেকেই আবার বাড়িতে রাখতে শখের বসে এই ফুল ক্রয় করে নিয়ে যাচ্ছে, কেউ বা শখের বসে ছবি তুলছে।
এদিকে উদ্যোক্তাদের সঙ্গে কথা বললে তারা বাংলানিউজকে বলেন, নেদারল্যান্ড, কাশ্মীর, সুইজারল্যান্ড, তুরস্কমতো শীত প্রবণ দেশে এ ফুলের ‘টিউলিপ’ চাষ হয়ে থাকে। পঞ্চগড় শীতপ্রবণ জেলা হওয়ায় টিউলিপ পরীক্ষামূলকভাবে চাষে বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা ইকো সোস্যাল ডেভলেভমেন্ট অর্গানাইজেশন (ইএসডিও) ও পল্লী কর্ম-সহায়ক ফাউন্ডেশনের (পিকেএসএফ) সহযোগীতায় তেঁতুলিয়ার মাটিতে প্রথমবারের মতো চাষ শুরু করা হয়েছে এই ফুলের। ইতোমধ্যে অনেকটাই সাফল্য পাওয়া গেছে বলে জানিয়েছে উদ্যোক্তা ও চাষিরা।
জানা যায়, ইএসডিও ও পিকেএসএফ এর সহযোগীতায় তেঁতুলিয়ার মুক্তা বেগম, আনোয়ারা বেগম, সুমি আক্তার, আয়েশা বেগম, হোসনেয়ারা বেগম, মনেয়ারা, মোর্শেদা, সাজেদা বেগম নামে ৮ জন প্রান্তিক কৃষককে পরীক্ষামূলকভাবে চারা দিয়ে সহযোগীতা করেন। ফলে প্রথমবারের মতো ৪০ শতক জমিতে ৬ প্রজাতির ৪০ হাজার টিউলিপ ফুলের চারা দিয়ে সহযোগীতা করে তাদের টিউলিপ ফুল চাষের স্বপ্ন দেখান। সার, বীজসহ সব ধরনের সহযোগীতা করে কৃষকদের অনুপ্রাণিত করেন। পরে কৃষকরা তাদের জমিতে প্রথমবারেই মতো টিউলিপ চাষ করে সফলতার মুখ দেখেছেন।
গত পহেলা জানুয়ারি (শনিবার) টিউলিপ চাষে বীজ (বাল্ব) বপন করা হয়। বীজ বপনের ২৫-২৮ দিনের মধ্যে ফুটেছে ফুল। টিউলিপের দৃষ্টি নন্দন সৌন্দর্য ও হাসি দেখে অভিভূত কৃষকরা। কৃষকদের ক্ষেতে শোভা পাচ্ছে লাল, সাদা, হলুদ, কমলাসহ বিভিন্ন রংয়ের টিউলিপ ফুলের। আর এই ফুল চাষ দেখে স্থানীয় কৃষকরা যেমন টিউলিপ ফুল চাষে আগ্রহী অনুপ্রাণিত হচ্ছে, তেমনি দেশের নানা প্রান্ত থেকে ছুটে আসা পর্যটকদেরও নজর কাড়ছে।
টিউলিপ ফুল দেখতে আসা জাহিদা ও আমিরুল দম্পত্তি বাংলানিউজকে বলেন, আমরা এই ফুল আগে দেখিনি। ফুলটি দেখার জন্য পঞ্চগড় থেকে এসেছি। বাগানে এই ফুলগুলো দেখে অনেক ভালো লাগছে। বাড়ির জন্য কয়েকটি ফুল ৮০-১০০ টাকা দরে কিনে নিলাম।
আয়শা নামে এক শিক্ষার্থী বাংলানিউজকে বলেন, আমি টেলিভিশন বা ইউটিউবে টিউলিপ দেখেছি। কিন্তু এভাবে কখনো টিউলিপ ছুঁয়ে দেখিনি। সত্যিই টিউলিপ একটা আকর্ষণীয় ফুল। তেঁতুলিয়ায় টিউলিপ চাষ হচ্ছে, এটা ভাবতেই অবাক লাগছে।
এদিকে সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন সঠিকভাবে বাজারজাত করতে পারলে যেমন অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি ঘটবে তেমনি এই অঞ্চলের পর্যটনে নতুনমাত্রা তৈরি করবে।
উদ্যোক্তারা আরো জানান, পিকেএসএফ’র সহযোগিতায় ইএসডিও দেশের উত্তরাঞ্চলে টিউলিপ ফুল চাষ সম্প্রসারণের উপযোগীতা নির্ণয় শীর্ষক ভ্যালুচেইন পাইলটিং প্রকল্পের উদ্যোগে এই প্রকল্পের আওতায় ৮ জন ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক চাষির মাধ্যমে ৪০ শতক জমিতে তিনটি প্লটে লেদারল্যান্ড থেকে আনা ৪০ হাজার বাল্ব রোপণ করা হয়েছে। এখানে ছয়টি প্রজাতির ১২ কালারের টিউলিপ চাষ করা হয়েছে। এর মধ্যে অ্যান্ট্রাকটিকা (হোয়াইট), ডাচ সানরাইস (ইয়েলো), পারপেল প্রিন্স (পারপেল), টাইমলেস (রেড হোয়াইট শেডি), মিল্কসেক (লাইট পিংঙ্ক), বারসেলোনা (ডার্ক পিংঙ্ক) নামে রংবেরঙ্গে টিউলিপ ফুলে ভরে উঠেছে বাগান। এছাড়া অ্যাড রেম (অরেঞ্জ), লালিবেলা (রেড), দি ফ্রান্স (রেড), রিপ্লে (অরেঞ্জ), ডেনমার্ক (অরেঞ্জ), স্ট্রং গোল্ডসহ (ইয়েলো) বিভিন্ন প্রজাতির টিউলিপ কলিতে ভরে গেছে প্রতিদিনই নতুন নতুন ফুল ফুটছে বাগানগুলোতে। আশা করা যায় আবহাওয়া ঠিক থাকলে আর কিছু দিনের মধ্যে বাগানের সকল ফুল ফুটবে। টিউলিপ ফুল চাষের ক্ষেত্রে দিনের বেলা ১৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস এবং রাতে ১০ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রায় এই ফুল চাষ সহনশীল।
টিউলিপ চাষি হোসনেয়ারা বেগম বাংলানিউজকে বলেন, ইউএসডিও অফিস থেকে আমাদের টিউলিপ ফুলের বীজ, সার দিয়ে পরামর্শ ও সহযোগী করে। আমি ৫ শতক জমিতে এই ফুলের চাষ প্রথমবারের মতো করেছি। আমি বীজ বপনর কয়েক দিনের মাথায় বাগানে ফুল ফোঁটা শুরু হয়েছে।
চাষি আয়েশা বেগম বাংলানিউজকে বলেন, আমি টিউলিপ ফুলের চাষ করে সফলতা পেয়েছি। বাগান থেকে প্রতি পিস ফুল ১০০ টাকা দরে বিক্রি করছি। আশা করি বাগানে যে ফুল আছে বিক্রি করে আমি আমার খরচ তুলে বাড়তি অর্থ আয় করতে পারবো। বিভিন্ন এলাকা থেকে মানুষ বাগানে এসে ফুল কিনে নিয়ে যাচ্ছে। যদি এবার লাভ হয় তাহলে আগামীতে বেশি করে টিউলিপ চাষ করবো।
নিজেদের বাগানে ফোটা এমন মায়াবী ফুলের চাহিদা আর কদর দেখে এখন টিউলিপ চাষেই স্বপ্ন বুনতে শুরু করেছেন তেঁতুলিয়ার চাষিরা।
এ বিষয়ে ইএসডিও'র সিনিয়র অ্যাসিসটেন্ট প্রোগ্রাম কো-অর্ডিনেটর (এপিসি) ও টিউলিপ প্রকল্পের সমন্বয়কারী আইনুল হক বাংলানিউজকে বলেন, আমরা ইউএসডিও পক্ষ থেকে প্রাথমিকভাবে ৮ জন কৃষকের মাধ্যমে এ টিউলিপ ফুলের চাষ করার কয়েক দিনের মধ্যে টিউলিপের ফুল ফুটেছে। প্রতিদিন নতুন নতুন রংয়ের ফুল ফোটতেছে। আশাকরছি চাষিরা টিউলিপ ফুল চাষ করে এবার লাভবান হবে। বীজ যেহেতু বাইরের দেশ থেকে নিয়ে আসতে হয় যে কারণে খরচ বেশি হয়। বীজ যদি আমাদের দেশে উদ্বোধন বা সংরক্ষণ করা যায় তাহলে এতে উৎপাদন খরচ যেমন হ্রাস পাবে তেমনি স্বল্প মূল্যে মানুষ ক্রয় করতে পারবে।
ইএসডিও’র নির্বাহী পরিচালক ড. মুহম্মদ শহীদ উজ জামান বাংলানিউজকে বলেন, টিউলিপ ফুল চাষের মাধ্যমে আগামী দিনগুলোতে প্রান্তিক এবং ক্ষুদ্র চাষিদের মধ্যে একটি অর্থনৈতিক আয় এবং সম্ভাবনা যেমন অনেকাংশে বেড়ে যাবে, এছাড়া পর্যটন শিল্পেও তেঁতুলিয়ার যে বিদ্যমান কাঞ্চনজঙ্ঘাসহ অপূর্ব নৈসর্গিক সৌন্দর্যের যে একটি আধার সেটি আরও সম্প্রসারিত হবে। এটি এ অঞ্চলের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের ক্ষেত্রে অনেক বড় ভূমিকা রাখতে সক্ষম হবে। ভবিষ্যতে টিউলিপ চাষ আরও বড় আকারে সম্প্রসারিত করার ইচ্ছা রয়েছে। টিউলিপের বাজারজাতকরণের জন্য আমরা বেশকিছু উদ্যোগ নিয়েছি। ইতোমধ্যে ফুল ব্যবসায়ীদের প্রকল্প এলাকায় নিয়ে এসে ফুল কেনার বিষয়ে যোগাযোগ করা হচ্ছে। এছাড়া ইকো ট্যুরিজম গড়ে তোলার বিষয়েও বেশকিছু নতুন উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।
এ বিষয়ে তেঁতুলিয়া উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা জাহাঙ্গীর আলম বাংলানিউজকে বলেন, প্রথমবারের মতো তেঁতুলিয়ায় ইউএসডিও সহযোগীতায় ৮ জন কৃষক চাষ করে সফল হয়েছেন। মূলত তেঁতুলিয়ায় শীতের মৌসুমে সর্বনিম্ন তাপমাত্রা বিরাজ করে আর তেঁতুলিয়ায় তাপমাত্রায় টিউলিপ চাষ সম্ভাবনা হওয়ায় পরীক্ষামূলকভাবে চাষ হয়েছে। আমরাও কৃষি অফিস থেকে সবধরনের সহযোগীতা কৃষকদের দিয়ে যাচ্ছি। প্রথমবারেরই টিউলিপের ফুল ফুটেছে। তেঁতুলিয়ার পর্যটন বিকাশে টিউলিপ একটি নতুন সংযোজন।
এদিকে পর্যটন ক্ষেত্রে এই বাগান অনেকটাই ভূমিকা পালন করবে। এই ফুল দেশে যত্রতত্র ভবে না হওয়ায় বাইরের জেলার অনেক ভ্রমণ পিপাসু ও ফুল প্রেমিরা এই ফুল দেখতে ও ক্রয় করতে উপজেলায় ভিড় জমাবে বলে মনে করছেন তেঁতুলিয়া উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান কাজী মাহমুদুর রহমান ডাবলু।
বাংলাদেশ সময়: ১৪১১ ঘণ্টা, জানুয়ারি ২৭, ২০২২
এনটি