ঢাকা, শুক্রবার, ১৪ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৯ নভেম্বর ২০২৪, ২৭ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

জাতীয়

কারও মাতৃভাষা কেড়ে নেওয়া মানে তাকে মেরে ফেলা

এস এস শোহান, ডিস্ট্রিক্ট করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১১১৮ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ২১, ২০২২
কারও মাতৃভাষা কেড়ে নেওয়া মানে তাকে মেরে ফেলা এসএম ইবরাহীম হোসেন

বাগেরহাট: ভাষা আন্দোলনকে আমি আন্দোলন বলি না, এটাকে আমি লড়াই বলি। কারও মাতৃভাষা কেড়ে নেওয়া মানে তাকে মেরে ফেলা।

তাই আমরা নিশ্চিত মৃত্যু থেকে বাঁচতে তখন লড়াই করেছিলাম। আর ভাষার জন্য লড়াই করেছিলাম বলেই বাংলাদেশ পেয়েছি, বাংলা ভাষায় কথা বলতে পারছি। ভাষা আন্দোলনের স্মৃতি চারণ করতে গিয়ে এভাবেই নিজের অভিব্যক্তি প্রকাশ করেন বাগেরহাটের ভাষা সৈনিক এসএম ইবরাহীম হোসেন।

রোববার (২০ ফেব্রুয়ারি) বিকেলে বাগেরহাট শহরের হরিণখানাস্থ নিজ বাসভবনে এই প্রতিবেদকের সঙ্গে আলাপকালে ভাষা আন্দোলনের পটভূমি, প্রয়োজনীয়তা ও পরবর্তী প্রভাব তুলে ধরেন তিনি।  

ভাষা সৈনিক এসএম ইবরাহীম হোসেন বলেন, ১৯৪৮ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি পাকিস্তান গণপরিষদে উর্দু ও ইংরেজির পাশাপাশি বাংলা ব্যবহারের দাবি জানান গণপরিষদ সদস্য ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত। তার দাবি না মানায়, ২৬ ফেব্রুয়ারি ঢাকায় ধর্মঘট হয়। মূলত সেই থেকে ভাষা আন্দোলনের গোড়াপত্তন হয়। তখনই বাংলার মানুষ বুঝতে শুরু করে শুধুমাত্র ধর্ম জাতি গঠনের একমাত্র নিয়ামক নয়। এরই ধারাবাহিকতায় ১৯৪৮, ১৯৫২, ১৯৬৪, ১৯৬৯, ১৯৭০ এবং ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে আমরা একটি স্বাধীন দেশ পাই।

১৯৪৮ সালের ২ মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে গঠিত সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের ডাকে ১১ মার্চ সারা দেশে সাধারণ ধর্মঘট পালনের আহ্বান জানানো হয়। এদিন যেসব স্থান সবচেয়ে প্রতিবাদমুখর ছিল তার মধ্যে অন্যতম ছিল বাগেরহাট। এখানের ছাত্র নেতারা ঢাকার সব খবর রাখতে শুরু করেন। বাংলা ভাষার দাবিতে সচেতনতা বৃদ্ধি পেতে থাকে। ১৯৪৯ সালের শেষের দিকে বাগেরহাটে তমদ্দুন মজলিস এর শাখা স্থাপন হয়। আমি তমদ্দুন মজলিস বাগেরহাট জেলা শাখার একজন সক্রীয় কর্মী ছিলাম। তমদ্দুন মজলিসের কার্যালয় তৎকালীন মুসলিম ছাত্রলীগের অফিসে। ধীরে ধীরে ছাত্র সংগঠন ও তমদ্দুন মজলিসকে কেন্দ্র করে ঢাকার সঙ্গে মিল রেখে বাগেরহাটে ভাষা আন্দোলন দানা বাঁধতে থাকে। বড়দের সঙ্গে আমিও বাংলা ভাষার পক্ষে কাজ শুরু করি। সাধারণ ছাত্রদের বাংলা ভাষার প্রয়োজনীয়তা বোঝাতে থাকি। এর মাঝে রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি ঢাকার রাজপথে মিছিল বের করেন ছাত্র-জনতা। মিছিলটি ঢাকা মেডিক্যাল কলেজের কাছাকাছি আসলে ১৪৪ ধারা ভঙ্গের অভিযোগে আন্দোলনকারীদের ওপর গুলিবর্ষণ করা হয়। এতে রফিক, সালাম, বরকত ও আব্দুল জব্বারসহ বেশ কয়েকজন নিহত হন। আহত হন ১৭ জন ছাত্র-যুবক। ২১ ফেব্রুয়ারি ছাত্রদের ওপরে গুলি চালানোর প্রতিবাদে পরের ২২ ফেব্রুয়ারি বাগেরহাটে ধর্মঘট পালিত হয়। ছাত্রদের ডাকে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসহ শহরের অধিকাংশ দোকান-পাট বন্ধ রাখা হয়। বিভিন্ন স্কুল ও পিসি কলেজ থেকে মিছিল বের করা হয়। ২৩ ফেব্রুয়ারিও আমরা পিসি কলেজ থেকে মিছিল বের করি। এর পর থেকে বিভিন্ন সময়, তমদ্দুন মজলিস ও সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের ডাকে আমরা বিভিন্ন আন্দোলন সংগ্রামে অংশ নিয়েছি। সবকিছু মিলে ভাষা আন্দোলনে ছাত্র সমাজের উল্লেখযোগ্য ভূমিকা ছিল।

ভাষা সৈনিকদের স্বীকৃতি ও সম্মানের বিষয়ে তিনি বলেন, ভাষা আন্দোলন না হলে দেশে স্বাধীন হত না। শুধু আমি না, দেশের বেশির ভাগ মানুষের চিন্তা একই। কিন্তু আমার জানামতে ভাষা আন্দোলনের ৭০ বছরেও দেশে ভাষা সৈনিকদের তালিকা হয়নি। স্বীকৃতি তো অনেক পরের ব্যাপার। বর্তমান স্বাধীনতার পক্ষের সরকারের উচিত, অন্তত ভাষা সৈনিকদের একটি তালিকা করা। রাষ্ট্রীয়ভাবে তাদের মর্যাদাপূর্ণ স্বীকৃতি দেওয়া। এর বাইরে আমার কোনো চাওয়া নেই।

১৯৩৬ সালের ২৬ জানুয়ারি বাগেরহাট শহরের হরিণখানা গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন এসএম ইব্রাহিম হোসেন। রাজনৈতিক পরিবারে জন্মগ্রহণ করার কারণে বিভিন্ন রাজনীতিবিদের সান্নিধ্য পেয়েছেন। ১৯৫৫ সালে অর্থনীতিতে স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করেন তিনি। পরবর্তীতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও সিটি ল’ কলেজে আইন বিভাগে অধ্যায়ন করেন। ১৯৬১ সালে পাকিস্তান কেন্দ্রীয় পাবলিক সার্ভিস কমিশন পরীক্ষায় পাস করে সরকারি চাকরিতে যোগদান করেন। দীর্ঘ ৩৬ বছর শ্রম, জনশক্তি উন্নয়ন ও বৈদেশিক কর্মস্থান বিভাগে উচ্চপদে চাকরি করেছেন। ২০০৫ সালে যুক্তরাষ্ট্র কর্তৃক সম্মানসূচক নাগরিকত্ব পান তিনি। চার মেয়ে ও এক ছেলের জনক এসএম ইব্রাহিম হোসেন। ২০২০ সালে করোনা আক্রান্ত হয়ে তার ছেলে মারা যান। বর্তমানে বাগেরহাটে নিজ বাড়িতেই বই পড়ে এবং স্ত্রীর সঙ্গে গল্প করে সময় কাটে তার। শেষ জীবনে একটাই চাওয়া তার ভাষা সৈনিক হিসেবে মর্যাদাপূর্ণ সরকারি স্বীকৃতি।

বাংলাদেশ সময়: ১১১৫ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ২১, ২০২২
আরএ

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।