ঢাকা, মঙ্গলবার, ৩০ আষাঢ় ১৪৩২, ১৫ জুলাই ২০২৫, ১৯ মহররম ১৪৪৭

অফবিট

অজানা এক আশ্চর্য যৌন জগত জার্মানিতে

সাগর আনোয়ার, জার্মানি করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ২১:৩৯, জুলাই ১৪, ২০২৫
অজানা এক আশ্চর্য যৌন জগত জার্মানিতে এআই প্রযুক্তিতে তৈরি প্রতীকী ছবি

জানা-অজানার এক আশ্চর্য যৌন জগত রয়েছে জার্মানিতে। এই দেশের প্রতিটি শহরে রয়েছে ছোট-বড় অসংখ্য যৌনপল্লী, ক্লাব, বার, পাব আর রাতের জলসাঘর।

শুক্রবার সন্ধ্যা হলেই শহরের ক্লাব পাড়ায় বেজে ওঠে উত্তাল গানের সুর। শত শত তরুণ-তরুণী কিংবা যুবক-যুবা থেকে মধ্যবয়সীরা সারারাত আনন্দ করে সপ্তাহের বন্ধের দিন উদযাপন করেন।  

জানা গেছে, জার্মানির এই ক্লাব কালচার ও যৌন পেশা সারা পৃথিবীর মানুষের আগ্রহের বিষয়বস্তু। ক্লাব কালচার সম্পর্কে পৃথিবীর মানুষ জানলেও দেশটির বিশাল যৌনজগত এখনো মানুষের আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দু। জার্মানিতে যৌন পেশা আইনগতভাবে বৈধ হলেও এ পেশায় নিয়োজিত অধিকাংশ নারীই সম্মান ও পরিচয় প্রকাশের ভয়ে থেকে যান বৈধতার নিবন্ধনের বাইরে।

দেশটি পরিসংখ্যান ব্যুরো ও সংবাদমাধ্যম সূত্রে জানা গেছে, জার্মানিতে বর্তমানে আনুমানিক ৪ থেকে ৫ লাখ যৌনকর্মী রয়েছেন। সংখ্যা আরও বেশি হতে পারে। তবে ২০২৪ সালের সরকারি তথ্যমতে, মাত্র ৩২ হাজার ৩০০ জন যৌনকর্মী নিবন্ধিত। অর্থাৎ নিবন্ধিত যৌনকর্মীর চেয়ে অনিবন্ধিতের সংখ্যা প্রায় ১০ গুণ বেশি।

জার্মান-বাংলা প্রেসক্লাবের সভাপতি হাবিবুর রহমান হেলাল বাংলানিউজকে জানান, যৌন পেশাকে কেন্দ্র করে জার্মানিতে একটি ছায়া অর্থনীতি গড়ে উঠেছে। নিবন্ধন করলে যৌনকর্মীদের কর দিতে হয়, স্বাস্থ্য পরীক্ষা করতে হয়। অনেকে নিবন্ধন করে না মূলত করফাঁকি দেওয়ার জন্য। অনেকের বৈধ বসবাসের অনুমোদন না থাকাও নিবন্ধন না করার অন্যতম প্রধান কারণ।

হামবুর্গ প্রবাসী বাংলাদেশি শাহিন আহমেদ বলেন, বড় ব্যাপার হচ্ছে,  আইন থাকা সত্ত্বেও সমাজের দৃষ্টিভঙ্গি এখনো নেতিবাচক হওয়ায় অনেকেই গোপনে জার্মানিতে যৌন পেশায় যুক্ত থাকছেন। কিছুদিন এ পেশায় থেকে যে যার দেশে আবার ফিরে যান।

জার্মানিতে যৌনকর্মীদের অধিকাংশই বিদেশি
জার্মানির যৌন পেশায় নিয়োজিত নারীদের ৮০ শতাংশেরও বেশি বিদেশি। বাকিদেরও বেশিরভাগ জার্মান পাসপোর্টধারী অভিবাসী। সবচেয়ে বেশি যৌনকর্মী জার্মানিতে আসে রোমানিয়া থেকে। জার্মানির সরকারি তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, দেশটিতে কর্মরত ৩৬ শতাংশ যৌনকর্মীই রোমানিয়ার অধিবাসী, ১১ শতাংশের বেশি বুলগেরিয়ান। এছাড়া স্পেন, পোল্যান্ড, ইউক্রেন, নাইজেরিয়া, হাঙ্গেরি এবং এশিয়ার থাইল্যান্ড ও ফিলিপাইনের মেয়েরাও এই পেশায় যুক্ত রয়েছেন।

জার্মানির অন্যতম বিখ্যাত ক্লাবপাড়া সেন্টপাওলিতে কর্মরত পোল্যান্ডের অধিবাসী আলডোনা জানান, দারিদ্র্য, শিক্ষা ও কর্মসংস্থানের অভাবেই মূলত তারা নিজ দেশ থেকে পাড়ি জমান জার্মানিতে। ইউরোপের বাইরে হয়তো কেউ কেউ পাচারের শিকার হয়ে প্রথমে আসেন বলকান (আলবেনিয়া, সার্বিয়া, মন্টিনিগ্রো, কসোভো, উত্তর গ্রিস ও ক্রোয়েশিয়া) দেশে। পরে বেশি টাকার জন্য জার্মানিতে আসেন। তবে অনেকেই বেশি টাকার জন্য স্বেচ্ছায় এ পেশায় যুক্ত হন।

জার্মানিতে যৌন পেশা নিবন্ধন ও সামাজিক জীবন
জার্মানিতে ২০১৭ সালে যৌনকর্মী সুরক্ষা আইন চালু হয়। এ আইনের আওতায় যৌন পেশায় কাজ করতে হলে প্রশাসনের নির্ধারিত দপ্তরে গিয়ে সঠিক পরিচয়পত্র, ঠিকানা, স্বাস্থ্য পরীক্ষা, এমনকি ব্যক্তিগত সাক্ষাৎকার দিয়ে নিবন্ধন করতে হয়। নিয়ম অনুযায়ী প্রতি ছয় মাসে স্বাস্থ্য পরীক্ষার সনদ নবায়নও বাধ্যতামূলক। এছাড়া থাকতে হয় বৈধ বসবাসের অনুমতি।

হামবুর্গে কর্মরত রোমানিয়ার যৌনকর্মী আনিয়া বাংলানিউজকে বলেন, এই নিবন্ধন প্রক্রিয়া জটিল এবং গোপনীয়তা রক্ষায় বড় অন্তরায়। অনেকেই পরিচয় ফাঁসের ভয়ে নিবন্ধন করতে চান না। সবারই পরিবার আছে। যদি কেউ জেনে যায়, পরিবারের সম্মান থাকে না। আসলে সবাই উপার্জন করে সম্মানের জন্য। এজন্য আমার মতো অনেকেই নিবন্ধন করে না। ৩/৪ মাস জার্মানিতে থেকে আবার যার যার দেশে চলে যায়।

তিনি আরও বলেন, পূর্ব ইউরোপের অনেক দেশের মেয়েদের জার্মানিতে বৈধভাবে অবস্থানের অনুমোদন নেই। নিবন্ধিত হতে হলে বৈধ বসবাসের অনুমোদনও দরকার। তাই আইনি ঝুঁকি থাকায় অনেকেই সরাসরি এই প্রক্রিয়ার বাইরে থাকেন।

দেশটির সরকারি তথ্যসূত্র মতে, ২০২০ সালে নিবন্ধিত যৌনকর্মীর সংখ্যা ছিল মাত্র ২৪ হাজার ৯০০ জন। এরপর ধীরে ধীরে বেড়ে ২০২৪ সালের শেষে এসে দাঁড়ায় ৩২ হাজার ৩০০ জনে।  

জার্মানির গণমাধ্যম ও যৌনকর্মীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, করোনা পরবর্তী সময়ে যৌন পেশায় ফেরার হার বাড়লেও আইনি জটিলতার কারণে অনেকে নিবন্ধন না করিয়েই এ পেশায় যুক্ত থেকে যান। এছাড়া জার্মান ও ইউরোপীয় সমাজে যৌনকর্মীদের সম্মান এখনো সীমিতই। বাসা ভাড়া, ব্যাংকে অ্যাকাউন্ট খোলা বা অন্য পেশায় স্থানান্তরের ক্ষেত্রে তারা নানা ধরনের বৈষম্যের শিকার হন। অনেক যৌনকর্মী তাদের পরিবারের কাছেও নিজেদের পেশা গোপন রাখেন। আবার কেউ কেউ অন্য পেশার পরিচয় ব্যবহার করে সমাজে বসবাস করেন।

ফ্রাঙ্কফুর্টে যৌনকর্মী আনালিনা বলেন, এই পেশায় আয় করা সহজ। তবে সম্মান নেই। আমি আমার প্রতিবেশী বা বন্ধুদের আমার এই পেশার কথা বলি না। কারণ, তারা জানলে আমাকে আর সম্মান করবে না।

তিনি আরও বলেন, জার্মানিতে একজন যৌনকর্মী গড়ে প্রতি মাসে ৩০০০ থেকে ৫০০০ ইউরো পর্যন্ত আয় করে। বড় শহর, বিলাসবহুল ক্লাব বা নির্দিষ্ট গ্রাহক থাকলে আয় আরও বেশি হতে পারে। এই অর্থপ্রবাহের কারণে বহু নারী – বিশেষ করে পূর্ব ইউরোপ ও আফ্রিকার দরিদ্র পরিবার থেকে আসা নারীরা এ পেশায় জড়িয়ে পড়েন।

পুরুষ যৌনকর্মী
জার্মানিতে নারী যৌনকর্মীদের পাশাপাশি রয়েছে পুরুষ যৌনকর্মীও। সাধারণ বড় বড় শহরগুলোর ক্লাব পাড়ায় তারা নারী খদ্দেরদের বিনোদন দিয়ে থাকেন। নর্থ জার্মানির বিখ্যাত ক্লাব পাড়া রিপা বানেও রয়েছে পুরুষদের যৌনক্লাব।  

অবৈধদের বিরুদ্ধে কি পুলিশ ব্যবস্থা নেয়?
যেসব যৌনকর্মী নিবন্ধন ছাড়াই জার্মানিতে এই পেশায় নিয়োজিত, তাদের বিরুদ্ধে প্রশাসন সময় সময় অভিযান চালিয়ে থাকে। বিশেষ করে হোটেল, অ্যাপার্টমেন্ট, নাইটক্লাব বা যৌনপল্লিতে তল্লাশি চালানো হয় মাঝে মাঝেই।  ক্লাব পাড়া মাদকের আখড়া হওয়ায় সেখানে পুলিশি অভিযান অনেক বেশিই হয়ে থাকে। তবে পুলিশ সাধারণত যৌনকর্মীদের গ্রেপ্তার না করে প্রশাসনিক জরিমানা করে ছেড়ে দেয়।

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।