ঢাকা, রবিবার, ৯ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৪ নভেম্বর ২০২৪, ২২ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

মুক্তমত

ইতিহাস নির্মাতা প্রীতিলতার জন্মদিন

মনোয়ার রুবেল, অতিথি লেখক | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৭৪০ ঘণ্টা, মে ৫, ২০১২
ইতিহাস নির্মাতা প্রীতিলতার জন্মদিন

চট্টগ্রামে একটি ক্লাবের গেটে লেখা আছে ‘ডগ অ্যান্ড ইন্ডিয়ানস প্রহিবিটেড ’ ( কুকুর এবং ভারতীয়দের প্রবেশ নিষেধ)। এখানে সাদা চামড়ার লোকেরা সন্ধ্যার পর নাচানাচি করে।

মদ্যপান করে। ফাঁকে ফাঁকে ‘ডার্টি ইন্ডিয়ান’দের কীভাবে শায়েস্তা করা যায় তা নিয়ে শলা পরামর্শ করে। এরা সবাই ব্রিটিশ রাজ কর্মকর্তা। কেউ মদ খেয়ে ঝিমুচ্ছে কেউ ড্রামের শব্দে নাচ্ছে। সাদা চামড়ার মানুষগুলো জানে না ইহজগতে আজই তাদের শেষ দিন।

সন্ধ্যায় রাবারের সোল পায়ে কয়েকজন  যুবক ক্লাবের চারপাশে বোমা হাতে নিয়ে ঘুরছে। সুযোগ বুঝেই বোমা মারা হবে। তার গায়ে পা‍ঞ্জাবি আর মালকোঁচা দেওয়া ধুতি। মাথায় সাদা পাগড়ি। এটা পাঞ্জাব যুবকদের বেশ। পাশেই পাঞ্জাবি কোয়ার্টার। কোয়ার্টারের ছেলে হবে, এটা ভেবে কেউ তেমন পাত্তা দিচ্ছে না। রাত পৌনে ১১টায় যুবকটি ইউরোপিয়ান ক্লাবের জানালা দিলে বোমা ছুড়লো। তার সাথে আর কয়েকজন জানালা দিয়ে বোমা ছুড়লো। ড্রাম আর পিয়ানোর শব্দ মুহূর্তের চিৎকার চেচামেচিতে পরিণত হলো।

গোলাগুলি শুরু হলে ক্লাবের ভেতর থাকা একজন ব্রিটিশ পুলিশ কর্মকর্তা তার রিভলবার থেকে গুলি ছোড়েন। গুলি এসে লাগে পাঞ্জাবি পরা যুবকটির পায়ে। ধরা পড়ার ভয়ে সে আত্মহত্যা করতে পটাসিয়াম সায়ানাইড চায় তার সহযোগী কালীকিংকর দের কাছে। কালীকিংকর পটাসিয়াম দিতে অস্বীকৃতি জানায়। তার কপালে পিস্তল ঠেকিয়ে পটাশিয়াম সায়ানাইড হাতিয়ে নিয়ে মুখে পুরে আত্মাহুতি দেয় যুবক। ২৪ সেপ্টেম্বর, ১৯৩২।

মুহূর্তেই পাঞ্জাবিপরা যুবকের আক্রমণের খবর চারদিকে চাউর হয়ে যায়।   কে এই যুবক। পরদিন সকালে ক্লাবঘর থেকে ১০০ গজ দূরে পাঞ্জাবিপরা যুবকের লাশ পাওয়া যায়। পুলিশ তার মাথার পাগড়ি খুলে নিতে লম্বাচুল বেরিয়ে পড়ে। সবাই জানতে পারে এটা যুবক নয়, যুবতী। যুবতীর নাম প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার। এই প্রথম কোনো নারী বিপ্লবীকে সচক্ষে দেখতে পায় ব্রিটিশ সরকার। শুধু ভারত নয় পৃথিবী জুড়ে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের ইতিহাসে প্রথম আত্মঘাতী নারী বিপ্লবী প্রীতিলতার নাম পৌঁছে যায়। পিলে চমকে উঠে ব্রিটিশ রাজের।

আজ প্রীতিলতার ১০১তম জন্মদিন। প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদারের জন্ম ১৯১১ সালের ৫ মে চট্টগ্রামের পটিয়ার ধলঘাট গ্রাম। প্রীতি ডা. খাস্তগীর স্কুল থেকে এসএসসি পাশ করে ভর্তি হন ইডেন কলেজে। ইডেনে পড়ার সময়ই তিনি নিজেকে ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের সাথে যুক্ত করেন। ইন্টারমিডিয়েট পাশ করার পর কলকাতার বেথুন কলেজ থেকে স্নাতক সম্পন্ন করলেও ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনের জন্য তার ফলাফল আটকে রাখা হয়। ২২ মার্চ, ২০১২ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় প্রীতিলতাকে মরণোত্তর স্নাতক ডিগ্রি দেয়। মাস্টার দা সূর্যসেনের সংস্পর্শে মাত্র ২১ বছর বয়সে ইউরোপিয়ান ক্লাব আক্রমণ করে আত্মহুতি দেন। তার এই আত্মাহুতি ব্রিটিশ রাজের বিরুদ্ধে বিশ্বজুড়ে প্রথম কোনো নারীর আত্মাহুতি। প্রীতিলতার মৃত্যুতে নড়চড়ে বসে ব্রিটিশ সরকার।

ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের মুখে জন্ম নেয় স্বাধীন ভারত। অবাক ব্যাপার হলো কয়েকটা বাম দলের অফিস ছাড়া অন্য কোথাও প্রীতিলতার ছবি, বই, পুস্তিকা বা ইতিহাস খুঁজে পাওয়া যায় না।

এটা দুর্ভাগ্যজনক এমনটাই বলছিলেন পংকজ চক্রবর্তী। পংকজ প্রায় দুই যুগ ধরে প্রীতিলতাকে নিয়ে কাজ করছেন। ধলঘাটে প্রতিষ্ঠা করেছেন প্রীতিলতা প্রাথমিক বিদ্যালয়। সড়কের নামকরণ করিয়েছেন প্রীতিলতা সড়ক। পংকজের প্রচেষ্টায় এবং সরকারি অর্থায়নে দেড় কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত হতে যাচ্ছে প্রীতিলতা কমপ্লেক্স। ধলঘাটকে ‘প্রীতিলতা পল্লী’ নামকরণের আহ্বান জানান পঙ্কজ। ধলঘাটে বর্তমানে প্রীতিলতার বসতভিটার চিহ্ন অবশিষ্ট নেই। যে টুকু আছে তা তিনি সংরক্ষণের চেষ্টা করছেন। সেখানে প্রীতির আবক্ষ মুর্তি স্থাপন করেছেন। প্রীতিলতার ইতিহাস বা স্মৃতি রক্ষার্থে সরকারি কোন উদ্যোগ তেমন চোখে পড়েনি।

কলকাতার ইডেন গার্ডেনে মহাত্মা গান্ধীর মূর্তির পাশে প্রীতিলতার মূর্তি স্থাপন করা হয়েছে ১৯৬৯ সালের দিকে ভারত সরকারের উদ্যোগে। অথচ আমরা তার প্রায় তিন যুগ পরে আবক্ষ মূর্তি স্থাপন করেছি, তাও ব্যক্তি উদ্যেগে। আজ ভারতে সুর্যসেন, প্রীতিলতাদের জীবনী নিয়ে ছবি নির্মিত হচ্ছে। প্রীতি আমাদের কন্যা। আমরা তাকে এতটুকু সম্মানও জানাতে পারিনি।   এর জন্য প্রয়োজন সঠিক ইতিহাস। প্রীতিলতাদের ইতিহাস পাঠ্যপুস্তকে তুলে ধরতে হবে।   আজ বাংলাদেশের রাজনীতিতে নারীদের যে অবস্থান তা পথপ্রদর্শক প্রীতিলতারাই। দেশপ্রেমের উজ্জ্বল দৃষ্টান্তও প্রীতিলতা।

লেখক: ব্লগার, monowarrubel@yahoo.com

বাংলাদেশ সময়: ১৭৩৪ ঘণ্টা, মে ০৩, ২০১২
সম্পাদনা: রানা রায়হান, অ্যাসিসট্যান্ট আউটপুট এডিটর

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।