ঢাকা, রবিবার, ৯ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৪ নভেম্বর ২০২৪, ২২ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

মুক্তমত

টিটু ভাই, ক্ষমা করে দিও

কামাল শাহরিয়ার, অতিথি লেখক | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ২১৪৪ ঘণ্টা, মে ১২, ২০১২
টিটু ভাই, ক্ষমা করে দিও

শহিদুজ্জামান টিটু। বয়সে আমার চেয়ে অনেক বড়।

কিন্তু কখনো বুঝতে দেননি তিনি। তখন আমি বরিশাল থেকে প্রকাশিত দৈনিক ‘দক্ষিণাঞ্চল’ পত্রিকার রিপোর্টার হিসেবে কাজ করছি। ঐ পত্রিকায় যোগ দেয়ার সপ্তাহখানেকের মধ্যে তার সাথে পরিচয় হয়।

আর পরিচয়ের জায়গাটা আমাদের বরিশালের সংবাদকর্মীদের খুবই চেনা। মিনি প্রেসক্লাব। পরিচয়ের প্রথম দিনেই যথেষ্ট আপন করে নিয়েছিলেন তিনি। বলেছিলেন,  ``এগিয়ে যাও। কোনো সমস্যায় পড়লে আমার সাহায্য প্রয়োজন হলে একটা ফোন করবে। ``

এই কথাগুলো খুব বেশি দিনের নয়। কিন্তু এই আশ্বাসবাণী দেয়া মানুষটা যে আজ আর নেই। যখন দক্ষিণাঞ্চল ছেড়ে দৈনিক ‘সত্য সংবাদ’ পত্রিকায় যোগ দিই, তখন শুনে একটু খুশি হয়েছিলেন। ‘সত্যসংবাদ’-এ তখন বার্তা সম্পাদক আমার প্রিয় মানুষ আহমেদ জালাল। তিনি এখনো আমাকে তার ছোট ভাইয়ের মত শাসন আর আদর করেন। প্রতিনিয়তই খোঁজ নেন এই মানুষটা। আহমেদ জালালের কথাটা বলার কারণ হলো, তার মাধ্যমেই টিটু ভাইয়ের সাথে আরো গভীর সম্পর্কে জড়িয়ে পড়ি। প্রতিদিন অশ্বিনী কুমার টাউন হলের সামনে হয়তো এক কাপ চা কিংবা গরম গরম পুরি-সিংগারা খাওয়া হতো। সেখানে আমি, টিটু ভাই আর আহমেদ জালালসহ অনেকে থাকতাম। তাদের মধ্যে ফটো সাংবাদিক সালাউদ্দিন থাকতেন বেশ চটপটে। একটু দেরি করেই যোগ দিতেন ফিরোজ মস্তফা, শাওন খান, শাহীন হাসান। কিন্তু টিটু ভাইয়ের কখনো কোনো কারণ ছাড়া দেরি হতো না। দেরি করতে পছন্দও করতেন না।

ফটো সাংবাদিক হওয়ার কারণে দিনের বেশিরভাগ সময়ই আমাদের আলাদা জায়গায় থাকতে হতো। আবার যেটুকু সময় এক সঙ্গে থাকতাম মনে হত অনেক সময় মানে দিনের অধিকাংশ সময়ই একসাথে আছি। টিটু ভাই ফোনে কথা হলেই আমাকে বলতেন ঢাকায় গিয়ে যেন জাতীয় পত্রিকায় কাজ করি। অনেকটা ভাইয়ের মতই আদেশ নিষেধ করে কথা বলতেন। তার পাশাপাশি আহমেদ জালাল ভাইও একই কথা বেশ করে বলতেন। পরে সত্য সংবাদ থেকে ছেড়ে গেলাম দৈনিক ‘বাংলার বন’-এ এবং সর্বশেষ ‘বরিশাল প্রতিদিন’-এ। বাংলার বনে যোগ দেয়ার পরে টিটু ভাই বলেছিল এটাই যেন বরিশালে আমার শেষ পত্রিকায় কাজ করা হয়। তিনি চাইতেন আমি যেন ঢাকার কোনো জাতীয় কাগজে কাজ করি। এটা আহমেদ জালাল, শাকিব বিপ্লব, শাওন, এম মিরাজ, শাহীন হাসান, শুভদাও চাইতেন। কিন্তু মনে হয় একটু বেশি বেশি চাইতেন টিটুভাই।

এরপর কেটে গেছে অনেকটা সময়। এরই মধ্যে আমি ঢাকায় চলে এলাম। ঢাকায় আসার পরের দিন তাকে ফোনে বলেছি, আমি ঢাকায় এসেছি। তিনি আমাকে বলেছিলেন, ``এখন ভালো মানের পত্রিকায় কাজ করার চেষ্টা করো। `` আমি তাকে বলেছিলাম আমি কাজ করার চেষ্টা করব। চেষ্টাও করেছি। কিন্তু মূল ব্যাপারটা দাঁড়ায় সুদূর বরিশাল থেকে এসে দ্রুত ভালো পত্রিকায় কাজ জুটিয়ে ফেলা বেশ কঠিন। তারপরও টিটু ভাই বলতেন ,``লিখতে থাকো, কাজ তুমি পাবেই। হয়ত একটু সময় লাগবে। ``

সত্যিই বোধহয় তাই। কিছুটা সময় পরে দৈনিক ইত্তেফাক-এ প্রদায়ক হিসেবে কাজ শুরু করলাম। তখন প্রতি সোমবারে অর্থনীতি নিয়ে ফিচার পাতা বের হতো। সেখানে কিছু দিন কাজ করি। ব্যস্ততার কারণে তাকে বলতে পারিনি যে আমি প্রদায়ক হিসেবে কাজ করছি। কিন্তু সোমবারে প্রকাশিত অর্থনীতি পাতায় নেম ক্রেডিট লাইনে ছাপানো একটি সংবাদ দেখে টিটু ভাই ফোন দিলেন।

একটু রাগের স্বরেই বলেছিলেন, ``কিরে, আমাকে তো বললি না!`` আমি তার কাছে একটু ক্ষমা চেয়ে নিলাম। বললাম আমি কাউকেই বলিনি। ব্যস্ততার কারণে বলা হয় নি। এই ব্যস্ততা আসলে পড়াশুনা সংক্রান্ত। তখন তিনি বললেন, ``লেগে থাক, একটা ভালো কিছু হবে। ``

এরপর বার্তা সংস্থা এফএনএস-এ রিপোর্টার হিসেবে কাজ শুরু করি। পরে এফএনএস-এ নিউজ রুম এডিটর হিসেবে পদোন্নতি পাই। যেদিন আমি এ পদে যোগ দিই। সেদিন তাকে ফোন দিয়েছিলাম। তিনি আমাকে দোয়া করেছিলেন। বলেছিলেন, `` তোর ভাবীর সঙ্গে আমি তোর কথা কাল রাতেও আলাপ করেছি। ``

কয়েকটা মাস পরে যোগ দিলাম দৈনিক ‘ভোরের ডাক’-এ। সেখানে জাতীয় ডেস্ক-এ সহ-সম্পাদক হিসেবে। ভোরের ডাকে যোগদান করার পরে টিটু ভাই বলেছিলেন আমার চেয়েও তিনি বেশি খুশি হয়েছেন। আমি তাকে প্রশ্ন করেছিলাম, আমার চেয়ে বেশি খুশি হওয়ার কারণ কি। তিনি আমাকে বলেছিলেন,  ``আমার ভাইটা একটা ভালো কাজ করেছে আর আমি খুশি হবো না!`` সেদিন তার সাথে অনেক কথা হয়েছিল। ঐদিন তিনিই প্রথম বলেছিলেন, নতুন কাগজ বের হলে একটু খোঁজ নিতে।

কয়েক মাস আগে আমি দৈনিক সংবাদ-এ সাব এডিটর হিসেবে যোগ দিয়েই তাকে ফোন করেছি। তখন তিনি বলেছেন, এবার ঢাকা এসে তিনি আমার সঙ্গে দেখা করবেন। আর আমার জন্য বস্তা-বস্তা কথামালা নিয়ে আসবেন। আমি এই কথা শুনে হাসলে তিনি বলেছিলেন, ``অনেক দিন তোর সাথে দেখা হয় না। একসাথে খাওয়া হয় না। তাই অনেক কথা জমে আছে। এবার তার কাছে কয়েকদিন থাকবো। ``

আমি তাকে সাদরে আমন্ত্রণ দিয়েছিলাম ভাবী আর তাসিনকে (৪ বছরের শিশুপুত্র)। টিটু ভাই বলেছিলেন, ``তোর ভাবীকে নিয়ে সময় করে আসবো। ``

কিছু দিন আগে ফোনে কথা হয় তার সঙ্গে। ঐ প্রশ্নটা আবার জিজ্ঞেস করেছিলেন, ``নতুন কোনো কাগজ বের হবে নাকি রে?``
আমি বলেছিলাম দৈনিক ‘মানবকণ্ঠ’ নামে একটি পত্রিকা বের হবে।   ভালো মানের করবে-এমনটাও বলেছি। টিটু ভাই তখন বলেছিলেন, তার আরেক বন্ধু যায়যায়দিন-এর রিপোর্টার রাজু হামিদও `মানবকন্ঠ`র কথা বলেছেন। শুনেছেন `মতবাদ`র তাওহীদ সৌরভও নাকি ওখানে জয়েন করেছেন। তিনি ঢাকা আসবেন এরকম একটা কথা দিয়ে সেদিনের মত কথা শেষ হয়।

এরপর টিটু ভাইয়ের সাথে শেষ কথা হয় বৃহস্পতিবার। আমি বলেছিলাম পল্টনে আমার সংবাদ অফিসে ঘুরে যেতে। জবাবে তিনি বলেছিলেন, ``আমি কাল (শুক্রবার) মানবকণ্ঠে যাব। তারপর পরশু (শনিবার) বরিশাল যাবো। হাতে তেমন সময় নেই। ``
আমি একটু অভিমান করেই বলেছিলাম, ``থাক আপনার আসার দরকার নেই। ``

তিনি বললেন, ``তুই তো জানিস আগামী রোববার আমার প্রোগ্রাম। তাই হাতে সময় নেই। ঝামেলা শেষ হলে তোর বাসায় বেড়াতে আসব। ``

আমি তখন তাকে বলেছি, ``ভাইয়া আমি তোমার উপর মোটেও রাগ করিনি। আসলে আমার হাতেও তেমন সময় নেই তোমাকে নিয়ে যে একটু ঘুরবো। ``

তখন টিটু ভাই বলেছেন, ``মিডিয়ায় কাজ করি, আমি বুঝি ব্যস্ততা। ``

[ টিটু ভাইয়ের প্রোগামটা নিয়ে খেলাসা করতে ইচ্ছে। পাঠকদের একটু এড়িয়ে যাচ্ছিলাম। তাই তা তুলে ধরলাম- বরিশালে কর্মরত ফটো সাংবাদিকদের তোলা ছবি নিয়ে প্রদর্শনীর আয়োজন করেছিলেন শহীদুজ্জামান টিটু। ১৩ মে নগরীর অশ্বিনী কুমার হলে ওই প্রদর্শনী অনুষ্ঠানের কথা ছিল। বিসিসি মেয়র শওকত হোসেন হিরন এ অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথি থাকবেন বলে কথা ছিল। কিন্তু সেই অপেক্ষায় সবাইকে রেখে ফিরে না আসার দেশে চলে গেলেন তিনি। এখন শুধু তার জন্য অন্তহীন অপেক্ষার পালা সবার। ]

বৃহস্পতিবার রাতে তার সাথে শেষ কথা। এই কথা শুধু সেদিনের নয়, আজীবনের মতো তিনি আর আমার সঙ্গে কথা বলবেন না। এটা মানতে পারছি না। এটা কি হলো। কি বলতে চেয়েছিলেন আমাকে। তা আজো অজানাই রয়ে গেল।

গতকাল (শুক্রবার)  আমার আরেক বন্ধু শফিকুল রেজা ফোন করে তার মৃত্যুর খবর জানাল। স্তম্ভিত আমি। যেন বিনা মেঘে হঠাৎই বজ্রপাত হলো। আমি কোন কথা বলতে পারলাম না। আমার চোখ দিয়ে দুই ফোটা পানি গড়িয়ে পড়লো। আমার সহকর্মী মান্নান ভাই ব্যাপারটা বুঝতে পারেননি। একটু ইতস্তত বোধ করলেন তিনি। বুঝতে পারছিলেন না হঠাৎ আমার কি হলো। আমাকে কয়েকবার ডাক দিলেন। কিন্তু আমি কিছু টের পেলেও যেন কথা বলার শক্তি হারিয়ে ফেলেছি। আমারই তো ভাই। টিটু ভাই নেই।

এ কথাটা ভাবতেও পারছিলাম না। একটু সময় নিয়ে স্বাভাবিক হতে চেষ্টা করলাম। কিছুটা স্বাভাবিক হয়ে তাকে বললাম, ``আমি আর নিউজ দেখতে পারবো না। আমারকে  যেতে হবে। হাসপাতালে যেতে হবে। ``

অফিস থেকে বের হয়ে চলে এলাম আর শেষবারের মত তাকে দেখে নিলাম। কিন্তু প্রশ্নটা বারবার ঘুরপাক খায় আমার মনে, কি বলা বাকি ছিল আমাকে? নিজের প্রতি রাগ হচ্ছে কেন একটু সময় নিয়ে তার সাথে দেখা করতে গেলাম না। এখন নিজেকে বেশ অপরাধী মনে হচ্ছে। বারবার বলতে ইচ্ছে করছে, ``সরি টিটু ভাই, বস্তা-বস্তা কথামালা আমি আর শুনতে পারলাম না। আমায় ক্ষমা করে দিও। ``

লেখক- কামাল শাহরিয়ার
সাব-এডিটর (জাতীয় ডেস্ক), দৈনিক সংবাদ
বাংলাদেশ সময় : ২১৩৯ ঘণ্টা, ১২ এপ্রিল, ২০১২
সম্পাদনা: জুয়েল মাজহার, কনসালট্যান্ট এডিটর  
Jewel_mazhar@yahoo.com

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।