ঢাকা, রবিবার, ৯ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৪ নভেম্বর ২০২৪, ২২ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

মুক্তমত

রাজনীতিতে এখন নো প্রশ্ন অ্যালাউড!!!

মাসুদা ভাট্টি, কন্ট্রিবিউটিং এডিটর | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৫৫২ ঘণ্টা, মে ৩০, ২০১২
রাজনীতিতে এখন নো প্রশ্ন অ্যালাউড!!!

একটি টক-শো‘তে অংশগ্রহণের সুযোগ হয়েছিল দিন দুয়েক আগে। বিষয় তত্ত্বাবধায়ক বনাম নির্দলীয় সরকার।

বিএনপি চেয়ারপার্সনের এক উপদেষ্টা বলছিলেন তাদের দাবি তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা নিয়ে। আমি বলতে গেলে বেশ বিপদেই পড়েছিলাম কারণ যে পক্ষ নিয়েই বলি না কেন, উল্টো পক্ষ বলবেন, আমি পক্ষপাতদুষ্ট। রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ স্বাভাবিকভাবেই তাদের দলীয় চেতনার বাইরের যে কাউকেই মনে করেন বিরোধী পক্ষ।

স্বাভাবিকভাবেই, বিএনপি চেয়ারপার্সনের উপদেষ্টাও তাই-ই আমাকে ঠাওরালেন। কিন্তু আমার কথা ছিল স্পষ্ট; তাহলো, তত্ত্বাবধায়ক বা নির্দলীয় যে ব্যবস্থাই হোক না কেন, আমাদের সদিচ্ছা বিশেষ করে রাজনৈতিক দলগুলোর সদিচ্ছা না হলে কোনোটিরই কোনো মূল্য নেই। এর কারণ একটু বিস্তারিত বলা প্রয়োজন।

কালকের আলোচনায় উপদেষ্টা মহোদয় বেশ খানিকটা জোরেশোরেই ইতিহাস থেকে দূরে সরে গেলেন এবং অবলীলায় বললেন যে, তার নেতা খালেদা জিয়া অনায়াসে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা মেনে নিয়েছিলেন। এবং এই প্রক্রিয়া নাকি শুরু হয়েছিল ৮৭ সালে। যাহোক, সত্য তো তা নয়। খালেদা জিয়ার প্রধানমন্ত্রিত্বের প্রথম আমলে মাগুরা উপনির্বাচনে যখন ভয়াবহ কারচুপি হলো তখন বিরোধী দল দাবি তুলেছিল দলীয় সরকারের অধীনে কোনো নির্বাচনে তারা অংশ নেবে না। এবং সে কারণেই ১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি একটি নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় এবং বিএনপি এককভাবে বিজয় লাভ করে সরকারও গঠন করে।

মজার ব্যাপার হলো, গণদাবির মুখে সেই সরকারই তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থাকে সাংবিধানকি স্বীকৃতি দিতে বাধ্য হয়। একটি একদলীয় নির্বাচনের মাধ্যমে গঠিত সরকার যাদেরকে কেউই মানেনি, আবার তাদেরই বৈধতা দেয়া তত্ত্বাবধায়ক সরকার বিলটি মেনে নিয়ে নির্বাচনে গিয়ে আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করেছে। রাজনীতিতে এরকম ঘটনা কিন্তু আকছার ঘটছে এবং ঘটবে বলেও মনে হচ্ছে।

যাহোক, ইতিহাস বিকৃতির কবলে আমরা কেবল তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা নিয়েই পড়িনি, আরো বহু ভাবে ইতিহাস বিকৃতির শিকার আমরা। কিন্তু তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিগত ইতিহাস কি খুব একটা সুখকর? ২০০১ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের হাতে ক্ষমতা ছেড়ে দিয়ে শেখ হাসিনা বঙ্গভবন থেকে বেরুতে না বেরুতেই জানা গেলো, নানা কারসাজি শুরু হয়েছে। স্বভাবতঃই শেখ হাসিনা ও তার দলের পক্ষে সেসব কারসাজি মেনে নেয়ার কথা নয়। কিন্তু তারপরও তারা নির্বাচনে গিয়েছেন, কারণ আওয়ামী লীগের ইতিহাস নির্বাচনমুখি। এমনিতেই যে কোনো সরকারই পাঁচ বছর ক্ষমতায় থাকার পর জনপ্রিয়তা হারায় এবং বাংলাদেশের মতো “অভ’ক্ত আর অতৃপ্তির” দেশে মানুষ বিকল্প রাজনৈতিক দলকেই ভোট দেয়। সে হিসেবে ২০০১ সালে আওয়ামী লীগ হয়তো এমনিতেই পরাজিত হতো। বিচারপতি লতিফুর রহমানের অতো কারসাজি করার প্রয়োজন পড়তো না। কিন্তু তিনি কারসাজি করলেন এবং নির্বাচনের দিন সেনাবাহিনীকে ব্যবহার করলেন ভোটারদের প্রভাবিত করার কাজে। এবং নির্বাচনী ফলাফল আওয়ামী লীগ মেনে নেয়নি, সংসদে যাবো কি যাবো না করে কাটিয়েছে কিছুদিন, তারপর সংসদে গিয়েছে, যায়নি এবং রাজপথ উত্তপ্ত রেখেছে পাঁচটি বছর ধরে।

বিএনপি-জামায়াত জোটের ২০০১ থেকে ২০০৬ পর্যন্ত শাসনকাল বাংলাদেশে কেমন ছিল- এই প্রশ্নের উত্তর দিতে অন্তরাত্মা কাঁপে। তিন তিনবার দুর্নীতিতে চ্যাম্পিয়ন হওয়ার কাল এটি, বাংলা ভাইয়ের উত্থানের কাল এটি, দেশব্যাপী একযোগে কয়েকশ বোমা বিস্ফোরণ ঘটার কাল এটি, আহসান উল্ল্যা মাস্টার, শাহ্ এ এম এস কিবরিয়া হত্যার কাল এটি, ২১ শে আগস্টের গ্রেনেড হামলার কাল এটি, ১০ ট্রাক অস্ত্র পাচারের কাল এটি- এরকম অসংখ্য অপ ঘটনার  উদাহরণ দেয়া যাবে। কিন্তু তখনও সংসদে না গিয়ে বাইরে দাঁড়িয়ে বিরোধী দলের চেঁচানোর কালও এটি। কিন্তু তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রশ্নে যখন বিচারপতি কে এম হাসানের বয়স বাড়ানো/কমানো সংক্রান্ত জটিলতা নিয়ে তখনকার বিরোধী দল মাঠে নেমে নির্বাচনে অংশগ্রহণ থেকে বিরত থাকার ঘোষণা দিয়েছিল তখন তারাও কিন্তু আজকের মতো জনগণেরই দোহাই দিয়েছিল। আমার আশ্চর্য লাগে রাজনৈতিক দলগুলো বার বারই জনগণের কথা বলে দাবি আদায় করে থাকে কিন্তু জনগণ আদৌ সেই দাবির প্রতি সহমত কি না তা আমরা কেউই যাচাই করার প্রয়োজন বোধ করি না। এ এক দারুণ ‘মাইনক্যা চিপা’!!! সন্দেহ নেই।

আমরা দেখলাম বিচারপতি কে এম হাসান বাদ গেলেন, বিতর্ক শুরু হলো বিচারপতি আজিজকে প্রধান নির্বাচন কমিশনার নিয়োগ করা নিয়ে। বিরোধী দলের দাবির সত্যতা দেখতে পেলাম পরবর্তী সময়ে বিচারপতি আজিজের নানা অপকান্ডে। তখন দেশে যে পরিস্থিতি তৈরি হয়েছিল তাতে যে কোনো রাজনৈতিক বিশ্লেষকই দেশে গৃহযুদ্ধের আশঙ্কা করেছিলেন, এও সত্য। দেশ ও জাতির এরকম সংকট মুহূর্তেই বিদেশি দাতা-বন্ধু (?) এবং সেনাবাহিনীর তৎপরতায় ইয়াজ উদ্দিন সাহেবকে দিয়ে প্রায় জোর করেই নতুন তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা আনা হলো। প্রধান হলেন বিশ্বব্যাংকের প্রতিনিধি ফখরুদ্দীন। আমরা স্মরণ করতে পারি, বিশ্বখ্যাত ইকনোমিস্ট পত্রিকায় বাংলাদেশকে “দুই বেগমের যুদ্ধ” থেকে বাঁচানোর দায়িত্ব সেনাবাহিনী, বিশ্বব্যাংক, যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র ও ইউএনডিপি’র মিলিত ফর্মুলার সরকারকেই দিয়েছিল নির্দ্বিধায়, যেমন তারা আজকে দিচ্ছে ভারতকে।

প্রশ্ন হলো, এই বিদেশি পত্রিকাটি কেন বার বার বাংলাদেশের দায়িত্ব ‘“বারো জন’কে দিতে আগ্রহী? গরীবের বউ সুন্দরী হলে তার দায়িত্ব কোনো ধনীকে নিতে হবে এই থিওরি পশ্চিম এখনও লালন করে এবং পশ্চিমা মিডিয়া যে তার প্রচারক হিসেবে দায়িত্ব নেয়, ইকনোমিস্ট আসলে তা-ই প্রমাণ করছে বার বার।

শেখ হাসিনা ও তার দল নিজেদের বিজয়ী মনে করলেন ফখরুদ্দীন-মঈনউদ্দীনের সরকারের আমলে। কিন্তু জেলেও গেলেন। খালেদা জিয়া সপুত্র ও স-সতীর্থ (একই রাজনৈতিক ঘরানার ব্যক্তিদের নিয়ে) কারান্তরালে গেলেন। ধুয়া উঠলো ‘মাইনাস টু থিওরি’র। বাংলাদেশের মানুষ এরকম অন্তরীণ পরিস্থিতিতে খুব একটা খাপ খাওয়াতে পারে না। ফলে নির্বাচন দিতে বাধ্য হলো উদ্দীনদের সরকার। ভোটার তালিকা হলো, কয়েক কোটি ভ’য়া আজিজীয়-ভোটার বাদ পড়লো এবং নির্বাচন হলো। সবাই সুষ্ঠুতার সার্টিফিকেট দিলো। আবারও বলি, বিএনপি-জামায়াত জোট দেশের যে হাল করেছিল তাতে তাদের নির্বাচনে পরাজয় অবশ্যম্ভাবী ছিল। কিন্তু স্বাভাবিক নিয়মেই তারা নির্বাচনকে মানেনি, বলেছে উদ্দীন-সরকার আওয়ামী লীগকে জিতিয়ে দিয়েছে।

আমার প্রশ্ন ছিল, তত্ত্বাবধায়ক সরকার নিয়ে এতো তিক্ততার, এতো কাহিনীর পরও যে আরেকটি তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনে পরাজিত পক্ষ সেই তত্ত্বাবধায়ক সরকারকে মেনে নেবে তারই বা কী নিশ্চয়তা আছে? টক শো অনুষ্ঠানে আমার কথা ছিল, বিশ্বের যে কোনো গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে কোনো তত্ত্বাবধায়ক সরকার ছাড়াই যখন নির্বাচন হয় তখন বাংলাদেশে কেন হাঁস-জারু’র মতো “তত্ত্বাবধায়ক-গণতন্ত্র” থাকবে? হয়তো পুরোপুরি একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র হবে নয়তো  অন্য যে কোনো পন্থা। আওয়ামী লীগ কেমন নির্বাচন করবে তা আমরা জানি না। বর্তমান সরকারের অধীনে এরই মধ্যে যে সমস্ত নির্বাচন হয়েছে তাতে বিএনপি-জামায়াত জোট প্রার্থী বিজয়ী হয়েছে, এমন নজির ঢের  আছে। এখন জাতীয় নির্বাচনে তার প্রতিফলন না দেখলে জনগণ আওয়ামী লীগকে ছাড় দেবে সে আশা দুরাশা মাত্র। সেজন্য তত্ত্বাবধায়ক ছাড়া একটি স্বাভাবিক নির্বাচন অনুষ্ঠান হওয়াটা খুবই জরুরি এদেশে। সেকথা বলতে গিয়েই আমি সভ্য, আধুনিক, গণতান্ত্রিক দেশের উদাহরণ টেনেছি। যা ভালো লাগেনি উপদেষ্টা মহোদয়ের। ‘আমরা এগোইনি, আমরা সভ্য হইনি- তাই আমাদের তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা প্রয়োজন’’--- হাস্যকর যুক্তি; কিন্তু কী আর করা, প্রশ্ন তুললেই বিরোধী পক্ষ এবং রোষের শিকার হতে হবে। হয়তো কাল সরকার পক্ষের কেউ ওখানে থাকলেও যদি তত্ত্বাবধায়ক সরকারের পক্ষে কথা বলতাম, তাহলে ‘বিরোধী দলের দালাল’ আখ্যা পেতাম। যেমনটি কাল উপদেষ্টা সাহেব আমাকে বলে ফেললেন, আমি নাকি বাকশালী!!কে জানে, তারা ক্ষমতায় গেলে হয়তো সোজা কারাগার!!! বাংলাদেশের রাজনীতিও ক্রমশঃ ধর্মের মতো হয়ে যাচ্ছে। যা নিয়ে প্রশ্ন তোলা যাবে না, যা নিয়ে বিতর্ক করা যাবে না, ধর্ম নিয়ে প্রশ্ন করলে মুরতাদ আর মুরতাদের শাস্তি মৃত্যুদণ্ড আর রাজনীতিবিদদের রাজনীতি নিয়ে প্রশ্ন তুললেও সেরকমটাই। এ কোন্ দেশে এসে পড়লাম???

লেখক: সম্পাদক, একপক্ষ।
masuda.bhatti@gmail.com
সম্পাদনা: জুয়েল মাজহার, কনসালট্যান্ট এডিটর  
Jewel_mazhar@yahoo.com

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।