ঢাকা, রবিবার, ৯ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৪ নভেম্বর ২০২৪, ২২ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

মুক্তমত

সম্পাদকের জবানবন্দি

ড. ইউনূস পদ্মা সেতুর অর্থায়নে এগিয়ে আসুন

নঈম নিজাম, সম্পাদক বাংলাদেশ প্রতিদিন | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৩৩৯ ঘণ্টা, আগস্ট ৯, ২০১২
ড. ইউনূস পদ্মা সেতুর অর্থায়নে এগিয়ে আসুন

গেল বছরের মাঝামাঝি সময়ের কথা। ঢাকা থেকে নিউইয়র্ক যাচ্ছি এমিরেটস্ এয়ারলাইনসে।

বসুন্ধরা গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সায়েম সোবহান এবং আমি পাশাপাশি আসনে। আমাদের পাশেই গ্রামীণ ব্যাংকের প্রতিষ্ঠাতা ড. মুহাম্মদ ইউনূস। শান্তিতে নোবেল বিজয়ী অর্থনীতিবিদ। ঢাকা থেকে দুবাইয়ের পথে বিমান আকাশে ওড়ার পরই বিদেশিরা হুমড়ি খেয়ে পড়েন ড. ইউনূসের ওপর। কেউ অটোগ্রাফ নিচ্ছেন। কেউ পাশে বসে তুলছেন ছবি। ড. ইউনূসও হাসিমুখে সবার সঙ্গে শুভেচ্ছা বিনিময় করছেন। বাংলাদেশের একজন নাগরিক হিসেবে আমাদের ভালো লাগল। আমার দেশের একজন নাগরিক আকাশ ছুঁয়েছেন। সাদা চামড়ার মানুষগুলো তার সঙ্গে হাত মিলিয়ে ভাগ্যবান মনে করছেন নিজেদের। সেই ইউনূসকে নিয়ে এখন আবার আলোচনা-সমালোচনা। আর তা পৃথিবীর অন্য কোনো দেশে নয়, আমাদের দেশেই।

ড. ইউনূসের সমালোচনা করার মতো অনেক কিছু আছে। মাইক্রোক্রেডিট বাংলাদেশে তিনি শুরু করেননি। বাংলাদেশে মাইক্রোক্রেডিটের যাত্রা শুরু ষাটের দশকে কুমিল্লা সমবায়ের মাধ্যমে, যার রূপকার ছিলেন ভিক্টোরিয়া কলেজের তৎকালীন অধ্যক্ষ আখতার হামিদ খান। তার বাড়ি ছিল তখনকার পশ্চিম পাকিস্তানে। দারিদ্র্য বিমোচনে ক্ষুদ্র ঋণ প্রকল্প তিনি পাঞ্জাবেও নিয়েছিলেন। সেই আখতার হামিদ খানের মূল্যায়ন কখনো হয়নি। তবে কুমিল্লার মানুষ এখনো তাকে স্মরণে রেখেছে। বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর ক্ষুদ্র ঋণ নিয়ে প্রথম মাঠে নামে ব্র্যাক। তবে ব্যাপক পরিসরে ক্ষুদ্র ঋণের বিকাশ ঘটান ড. মুহাম্মদ ইউনূস। শান্তিতে নোবেল বিজয়ী বাংলাদেশের অর্থনীতিবিদ। বিশ্বজুড়ে যার প্রশংসা, সম্মান, শ্রদ্ধা, ভালোবাসা। দারিদ্র্য বিমোচনে ক্ষুদ্র ঋণ প্রকল্প ও সামাজিক ব্যবসার চিন্তাধারা শুধু ড. ইউনূসকে নয়, বাংলাদেশকেও নিয়ে গেছে নতুন উচ্চতায়। বিশ্বব্যাপী যার প্রশংসা। এর মধ্যে ১৯টি দেশ সামাজিক ব্যবসার চিন্তাধারা গ্রহণও করেছে। শুধু তাই নয়, নোবেল বিজয়ী ইউনূস মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সর্বোচ্চ নাগরিক সম্মান `কংগ্রেশনাল গোল্ড মেডেল` এবং `প্রেসিডেন্সিয়াল মডেল অব ফ্রিডম` পেয়েছেন। যুক্তরাষ্ট্রের প্রথম কংগ্রেশনাল মেডেল পান জর্জ ওয়াশিংটন। ব্রিটেনের কাছ থেকে যুক্তরাষ্ট্রের স্বাধীনতা অর্জনের তিন মাস আগে এ সম্মান দেওয়া হয়। তার অনেক দিন পর ড. ইউনূস। সেই ইউনূসের তুমুল সমালোচনা এখন দেশে। সরকারি দল তাকে নানাভাবে নাজেহাল করছে। কিন্তু কেন? গ্রামীণ ব্যাংকের অনেক সমস্যার কথা আমরা জানি। এ ব্যাংকে সুদ বেশি। একজন গরিব মানুষ একটি গরু অথবা ঘরের চালার জন্য দুই বান্ডিল টিন কিনতে ঋণ নেন গ্রামীণ ব্যাংক থেকে। প্রথম ভালোই লাগে। কিন্তু পরে সুদ এবং চক্র বৃদ্ধির কবলে পড়ে জীবন হয়ে ওঠে অতিষ্ঠ। তখন রাবেয়ার মতো নিরীহ গ্রাম্য নারীরা আত্দহত্যার পথ বেছে নেন। কৃষক জমিরের ঘরের চালা খুলে নেওয়া হয়। গ্রামীণ ব্যাংকের ৮৬ লাখ সদস্য জানেন না মালিকানার ডিভিডেন্ট পাবেন কি না। প্রশ্ন ওঠে ব্যাংক পরিচালনায় ড. ইউনূসের একক ক্ষমতা, অধিক বয়সে এমডি থাকা নিয়ে; গ্রামীণের টাকায় করা ৩৯টি প্রতিষ্ঠান নিয়ে। সমস্যা আছে। প্রশ্ন আছে। তার পরও বলছি, ড. ইউনূসের বিরুদ্ধে সরকারের বর্তমান লড়াই বাড়াবাড়ির পর্যায়ে চলে যাচ্ছে। কারণ আমাদের কোনো ব্যবস্থাই ত্রুটিমুক্ত নয়। গ্রামীণ ব্যাংক ত্রুটিমুক্ত কীভাবে হবে? গ্রামীণ ব্যাংকের বিরুদ্ধে বিগত সরকারগুলো কোনো ব্যবস্থা নেয়নি। কোনো অনিয়মের তদন্ত করেনি। বাংলাদেশ ব্যাংক ছিল নীরব দর্শকের ভূমিকায়। আয়কর বিভাগ ছিল ঘুমিয়ে। আর এখন সবাই সোচ্চার। কেন? একটাই কারণ_ সরকারের নীতিনির্ধারকেরা ব্যাংকের বিরুদ্ধে নেমেছেন, যা খুশি তা করছেন। যা অনভিপ্রেত ও দুঃখজনক। মানুষের মধ্যে একটি ধারণা তৈরি হয়েছে_ সরকার ব্যক্তিগত রেষারেষির কারণে গ্রামীণ ব্যাংকের ওপর নিষ্ঠুর দৃষ্টি দিয়েছে, নির্দয় ব্যবহার করছে; যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্ক নষ্ট করছে।

একটি সরকার চাইলে যে কোনো মানুষকে হয়রানি করতে পারে। কিন্তু এমন কিছু করা উচিত নয় যা ক্ষমতাসীনদের ভাবমূর্তির ওপর আঘাত হানবে। আমেরিকার মতো দেশের সঙ্গে সম্পর্ক নষ্ট করবে। বিশ্বব্যাংকের মতো আর্থিক খাতের সঙ্গে দূরত্ব তৈরি হবে। বুঝতে হবে আওয়ামী লীগ গণমানুষের একটি দল। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্ব দিয়েছে এ দলটি। শেখ হাসিনা শুধু বঙ্গবন্ধুকন্যা নন, তিনি মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসী মানুষের শেষ আশ্রয়স্থল। গণতান্ত্রিক আন্দোলন-সংগ্রামে তার অপরিসীম ভূমিকা রয়েছে। ওয়ান-ইলেভেনের পর অগণতান্ত্রিক সরকারের ক্ষমতা নেওয়ার পথ তিনিই রুদ্ধ করে দেন। এ কারণে শেখ হাসিনার কাছে মানুষের প্রত্যাশা বেশি। ড. ইউনূসকে ঘিরে এ প্রত্যাশার স্থানটুকু যেন নষ্ট হতে চলেছে। কারণ ইউনূস ইস্যুতে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক নষ্টের পথে। কঠিন ভুল বোঝাবুঝি চলছে হিলারি ক্লিনটনের সঙ্গে। শুধু হিলারি নন, যুক্তরাষ্ট্রের সিনেটর, কংগ্রেসম্যানরা এখন ইউনূসের পক্ষে। যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে এভাবে প্রকাশ্য অবস্থান উন্নয়নশীল দেশের কোনো সরকারের জন্য সুখকর হয়নি। অতীত ও বর্তমানের দিকে তাকালে আমরা সবকিছুর কঠিন পরিণতি দেখতে পাই।

তাই ক্ষমতাসীনদের প্রতি অনুরোধ ড. ইউনূস নিয়ে হৈচৈ বন্ধ করুন। তার বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ থাকলে নীরবে তদন্ত করুন। প্রচলিত আইনে ব্যবস্থা নিন। নোবেল বিজয়ী বলে তিনি আইনের ঊধের্্ব নন। কিন্তু তাকে অসম্মান করে, যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্ক নষ্ট করে কোনো লাভ হবে না। এমন তো নয়_ ইউনূসের বিরুদ্ধে কথা বললে আওয়ামী লীগ আবার ক্ষমতায় আসবে, বিশ্ববাসী খুশি হবে, দেশের মানুষ আগামী নির্বাচনে চোখ বুজে ভোট দেবে। আওয়ামী লীগের সামনে এখন হাজারো সমস্যার পাহাড়। পদে পদে স্খলন। তার পরও শুধু গ্রামীণ ব্যাংক কেন? আর কিছু কি চোখে পড়ে না? ব্যাংকিং খাতে বিরাজ করছে চরম নৈরাজ্য। সরকারি ব্যাংকগুলোতে চলছে হরিলুট। অখ্যাত, অজ্ঞাত ব্যক্তিরা অনিয়মের মাধ্যমে হাজার হাজার কোটি টাকা ঋণ নিচ্ছেন। সোনালী ব্যাংকের রূপসী বাংলা হোটেল শাখার কেলেঙ্কারি নজিরবিহীন। রূপালী ব্যাংকে যা খুশি তা হচ্ছে। দেখার কেউ নেই। সবাই ব্যস্ত ড. ইউনূসকে নিয়ে। সরকারের একজন প্রভাবশালী মন্ত্রীর কাছে জানতে চাইলাম ইউনূস নিয়ে এত বাড়াবাড়ি করছেন কেন? এমন তো নয় আমাদের সব সেক্টর ভালো চলছে। এক গ্রামীণ ব্যাংক সব শেষ করে দিচ্ছে। জবাবে মন্ত্রী মহোদয় বললেন, ড. ইউনূস দেশের ক্ষতি করেছেন। তিনি বিশ্বব্যাংককে দিয়ে পদ্মা সেতুর অর্থায়ন বন্ধ করিয়েছেন। মন্ত্রীর কথার সত্য-মিথ্যা জানি না। আমার মনে হচ্ছে ড. ইউনূস পারেন পদ্মা সেতু সংকট নিরসন করতে। তার সেই উচ্চতা আছে। তাই ড. ইউনূসকে বলছি কারও কথায় কান দেবেন না। মেঘ কেটে আকাশ ফর্সা হবেই। বাংলা সাহিত্যের যুবরাজ হুমায়ূন আহমেদকে নিয়েও অনেক বিতর্ক ছিল। কিন্তু বাংলাদেশের মানুষ লেখক হুমায়ূনের প্রতি সর্বোচ্চ ভালোবাসা দেখিয়েছে। তিনি এখন কিংবদন্তি। আপনি মানুষের ভালোবাসা পেয়েছেন। আরও পাবেন। আপনি পদ্মা সেতুর ওপর কাজ শুরু করুন। বিশ্বব্যাংকের সঙ্গে ভুল বোঝাবুঝির অবসান ঘটান। ফিরিয়ে আনুন পদ্মা সেতুর অর্থায়ন। সরকারের কর্মকাণ্ডে বিরক্ত হবেন। মন খারাপ করবেন না। পদ্মা সেতুর অর্থায়নের ব্যবস্থা করলে ইতিহাসে অমরত্ব পাবেন। জীবিত থাকাকালেই দেখবেন মানুষের সর্বোচ্চ শ্রদ্ধা, ভালোবাসা। সরকারগুলোর লম্বা হাত আপনার উচ্চতাকে স্পর্শ করতে পারবে না।

সৌজন্যে: বাংলাদেশ প্রতিদিন

বাংলাদেশ সময় ১৫৩০ ঘণ্টা, আগস্ট ০৯, ২০১২

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।