ঢাকা, শনিবার, ২৮ আষাঢ় ১৪৩২, ১২ জুলাই ২০২৫, ১৬ মহররম ১৪৪৭

মুক্তমত

ক্যালিফোর্নিয়ার চিঠি

ট্রাম্পের ‘বিগ বিউটিফুল বিল’, মাস্কের ‘আমেরিকা পার্টি’ ও অন্যান্য

মাহবুব আহমেদ | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৮:২৯, জুলাই ১০, ২০২৫
ট্রাম্পের ‘বিগ বিউটিফুল বিল’, মাস্কের ‘আমেরিকা পার্টি’ ও অন্যান্য ইলন মাস্ক ও ডোনাল্ড ট্রাম্প

ক্যালিফোর্নিয়াতে গরম কাল শুরু হয়েছে। কিছুদিন আগে দেখা বসন্তের তরতাজা ফুলের সমুদ্রে রোদে ঝলসানো রং।

আবার দাবানল। আবার পুড়ে যাওয়া সবুজ বৃক্ষের আর্তনাদ। প্রিয় এই ক্যালিফোর্নিয়ার সান লুইস ও বিস্পো কাউন্টিতে ছড়িয়ে পড়া একটি বিশাল দাবানলে এখন পর্যন্ত ৭০ হাজার ৮০০ একর এলাকা পুড়ে ছাই হয়ে গেছে!

‘মাদ্রে ফায়ার’ নামে পরিচিত দাবানলটি বুধবার শুরু হয় এবং এটি এ বছর ক্যালিফোর্নিয়ার সবচেয়ে বড় দাবানলে পরিণত হয়েছে। জানি না দাবানলের এই ভয়াবহ আগুন সামনে কতদূর ছড়িয়ে পড়বে। তবে গরমের উত্তাপ বেড়ে যাওয়ায় এই আশঙ্কা প্রবল হয়েছে। বাতাসে জলীয় বাষ্পের আর্দ্রতার মাত্রা সামান্য অথচ পাশে প্রশান্ত মহাসাগর—এটাই প্রধান কারণ অনেকে মনে করেন।

তবে আমেরিকার রাজনৈতিক উত্তাপ গরমকালের উত্তাপকে ছড়িয়ে গায়ে লাগতে শুরু করেছে। যুক্তরাষ্ট্রে নতুন একটি রাজনৈতিক দল গঠন করার ঘোষণা দিয়েছেন টেসলা ও স্পেসএক্সের প্রধান ধনকুবের ইলন মাস্ক। দলটির নাম দিয়েছেন ‘আমেরিকা পার্টি’। নামটি সহজ ও অসাধারণ। আমেরিকাকে খুঁজে পেতে সময় লাগে না।

তবে যুক্তরাষ্ট্রের ঐতিহ্যবাহী দুই রাজনৈতিক দল—রিপাবলিকান ও ডেমোক্র্যাটিক পার্টির বাইরে এবার আলোচিত ধনকুবের ইলন মাস্কের ‘আমেরিকা পার্টি’ নতুন আলোচনার জন্ম দিয়েছে, একইসঙ্গে রাজনৈতিক উত্তাপকে আরও জোরালো করেছে প্রতিটি রাজনৈতিকভাবে সচেতন আমেরিকানদের মধ্যে।

৪ জুলাই যুক্তরাষ্ট্রের ২৫০তম স্বাধীনতা দিবসে নিজের সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম এক্স-এ পোস্ট করে মাস্ক প্রশ্ন তোলেন, ‘স্বাধীনতা দিবস হলো দ্বিদলীয় (কেউ কেউ বলবেন একদলীয়) ব্যবস্থা থেকে স্বাধীনতা চান কি না, তা জিজ্ঞাসা করার উপযুক্ত সময়!’

এক্সে পোস্ট করে মাস্ক প্রশ্ন তোলেন, “আমাদের কি আমেরিকা পার্টি তৈরি করা উচিত?’ প্রশ্ন ছুড়ে দিয়ে হ্যাঁ-না ভোটের অপশনও জুড়ে দেন। প্রায় ২০ ঘণ্টা পর দেখা যায়, ১১ লাখ ৫৯ হাজারের বেশি মানুষের ভোটে ৬৫ শতাংশ ‘হ্যাঁ’ এবং ৩৫ শতাংশ ‘না’ ভোট দিয়েছেন। এটা বেশ গরম উত্তাপ ছড়িয়ে দেবার মতো সংবাদ। আমি ইলন মাস্কের একজন ভক্ত। প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের নির্বাচনী সভায় তার নৃত্য আমার চোখের সামনে এখনো ভাসছে, তার সেই আনন্দ উল্লাস যা ইতিহাসের পাতায়।

এই সপ্তাহের শুরুতে ট্রাম্প হুমকি দেন, মাস্কের কোম্পানিগুলো কেন্দ্রীয় সরকারের কাছ থেকে যে ভর্তুকি পায়, তা বন্ধ করে দেওয়া হতে পারে। এক সময়ের বন্ধু আজ পরিণত হয়েছে তীব্র সমালোচক হিসেবে। তারপর স্বভাবসুলভ ভাবেই তিনি অনেক কথা বলছেন, যা অন্য কোনো সময় বলব আশা করছি।

প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প গত শুক্রবার ‘বিগ বিউটিফুল বিল’ নামে পরিচিত করছাড় ও ব্যয় বৃদ্ধির বিলে স্বাক্ষর করে বিলটিকে আইনে পরিণত করে ফেলেছেন। আর এই বিলের প্রতিক্রিয়ায় নাকি নতুন দল গঠনের ঘোষণা দিলেন মাস্ক। ট্রাম্প প্রস্তাবিত এই বিলের কড়া সমালোচনা করেছেন মাস্ক। তিনি বলেছেন, ‘বিলটি যুক্তরাষ্ট্রকে দেউলিয়া করে দেবে। ’ আমার ধারণা একটি ধারাবাহিক নাটক শুরু হলো আমেরিকার রাজনীতিতে।

তবে আজকের ‘ক্যালিফোর্নিয়ার চিঠি’ কলামে কিছুটা ব‍্যাখ‍্যা দিতে চাই প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের মহাগুরুত্বপূর্ণ ‘বিগ বিউটিফুল বিল’ নিয়ে। ‘দেশের মানুষকে এত খুশি আগে দেখিনি’, বিলে সই করার পর এ কথা বলেছেন ট্রাম্প। একটু বিস্তারিত আলোচনা করা যাক।

প্রথম মেয়াদে ২০১৭ সালে প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব নেওয়ার পর ট্রাম্প ‘ট্যাক্স কাটস অ্যান্ড জবস অ্যাক্ট’ নামে একটি আইন পাস করেন। এটি কর হ্রাস করে ও করদাতাদের জন্য আয়কর থেকে ছাড় (স্ট্যান্ডার্ড ডিডাকশন) বাড়ায়। যদিও এর সুবিধা উচ্চ আয়ের মানুষরাই বেশি পান। সুবিধা চলতি বছর অর্থাৎ ২০২৫ সালের পর বাতিল হওয়ার কথা ছিল। তবে নতুন বিল এটি স্থায়ী করছে।

এ ছাড়া ২০২৮ সাল পর্যন্ত স্ট্যান্ডার্ড ডিডাকশন আরও বাড়ানো হচ্ছে। এ ছাড় ব্যক্তি করদাতাদের জন্য এক হাজার ডলার, পরিবারপ্রধান (হেড অব হাউসহোল্ড) হলে এক হাজার ৫০০ ডলার ও দম্পতিদের জন্য ২ হাজার ডলার।

এই বিলের আওতায় নতুন কিছু ক্ষেত্রে করছাড় যুক্ত হচ্ছে। তবে সেগুলো শুধু ট্রাম্প প্রেসিডেন্ট থাকা পর্যন্তই বহাল থাকবে। তার নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী, এবার টিপস ও ওভারটাইম আয়ের ওপর করছাড় দেওয়া হচ্ছে। একই সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রে তৈরি গাড়ি কেনার জন্য নেওয়া ঋণের সুদও কর থেকে ছাড় পাবে।

আরও জানা গেছে ৬৫ বছরের বেশি বয়সীদের জন্য অতিরিক্ত ছয় হাজার ডলার করছাড় রাখা হয়েছে। তবে এমন বয়সীদের একক আয় ৭৫ হাজার ডলারের বেশি বা যৌথভাবে দেড় লাখ ডলারের বেশি হলে এ ছাড় প্রযোজ্য হবে না। এসব ছাড় ট্রাম্পের প্রেসিডেন্ট মেয়াদের শেষ বছর অর্থাৎ ২০২৮ সালের শেষে উঠে যাবে।

যুক্তরাষ্ট্রে বসবাসকারী অবৈধ অভিবাসীদের ফেরত পাঠাতে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের নেওয়া পরিকল্পনা বাস্তবায়নের অংশ হিসেবে ‘ইমিগ্রেশন অ্যান্ড কাস্টমস এনফোর্সমেন্ট (আইস)’ সংস্থাকে ৪৫ বিলিয়ন (৪ হাজার ৫০০ কোটি) ডলার দেওয়া হচ্ছে বন্দিশিবির পরিচালনার জন্য। এসব অভিবাসীদের বহিষ্কার কার্যক্রম পরিচালনায় আরও ১৪ বিলিয়ন (১ হাজার ৪০০ কোটি) ডলার ও ২০২৯ সালের মধ্যে নতুন ১০ হাজার এজেন্ট নিয়োগে কয়েক বিলিয়ন ডলার অতিরিক্ত বরাদ্দ রাখা হয়েছে।

এ ছাড়া মেক্সিকো সীমান্ত বরাবর নতুন প্রতিরক্ষাকাঠামো তৈরিতে ৫০ বিলিয়ন (৫ হাজার কোটি) ডলার বরাদ্দ রাখা হয়েছে। এর মধ্যে দেয়াল নির্মাণও অন্তর্ভুক্ত থাকতে পারে। এটা যুক্তরাষ্ট্রে বসবাসকারী অবৈধ অভিবাসীদের তাড়াতে তার আয়োজনকে আরও সফল করে তুলবে, তাতে কোনো সন্দেহ নেই।

দেখা যাচ্ছে নতুন বিলে ব্যয় কমাতে রিপাবলিকানরা যুক্তরাষ্ট্রের দুটি প্রধান সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির বাজেটে ছাঁটাই করেছেন। এ দুটি কর্মসূচি হলো ‘মেডিকেইড’ (দরিদ্র ও প্রতিবন্ধিতার শিকার ব্যক্তিদের স্বাস্থ্যসেবা) ও ‘সাপ্লিমেন্টাল নিউট্রিশন অ্যাসিস্ট্যান্স প্রোগ্রাম’ বা স্ন্যাপ (খাদ্যসহায়তা কর্মসূচি)। সত্যিই সাধারণ আমেরিকানদের জন্য খুবই কঠিন এ সময়ের এই ছাঁটাই কর্মসূচি।

দুটি ক্ষেত্রেই বাজেট কমানোর পাশাপাশি নতুন কাজের শর্তও জুড়ে দেওয়া হচ্ছে। গবেষণা প্রতিষ্ঠান ‘সেন্টার অন বাজেট অ্যান্ড পলিসি প্রায়োরিটিজ’–এর হিসাবে, এসব পরিবর্তনের কারণে যুক্তরাষ্ট্রে প্রায় ১ কোটি ৬০ লাখ মানুষ স্বাস্থ্যসেবা সুবিধা হারাতে পারেন এবং প্রতি পাঁচ স্ন্যাপ গ্রহীতার একজন অর্থাৎ ৮০ লাখ মানুষ খাদ্যসহায়তা থেকে বঞ্চিত হতে পারেন। আমি বুঝতে পারছি না কীভাবে নিম্ন আয়ের মানুষেরা সামনের দিনগুলোতে সামলাতে পারবে তাদের জীবন ও সহায়ক ঝুঁকি বাস্তবতা।

বলা হচ্ছে স্টেট অ্যান্ড লোকাল ট্যাক্স বা ‘সাল্ট’–এ করছাড় কতটা দেওয়া হবে, তা বিলের অন্যতম বিতর্কিত বিষয়। অনেক মার্কিনকে ফেডারেল ট্যাক্সের পাশাপাশি নিজ নিজ অঙ্গরাজ্য ও স্থানীয় ট্যাক্সও দিতে হয়। ডেমোক্র্যাট-শাসিত অঙ্গরাজ্যগুলোর কয়েকজন রিপাবলিকান প্রতিনিধি সাল্টে করছাড়ের সীমা ১০ হাজার ডলার থেকে বাড়িয়ে ৪০ হাজার ডলার না করা পর্যন্ত বিলে নিজেদের সমর্থন দেননি। প্রতিনিধি পরিষদে এ দাবি মানা হলেও সিনেটে রিপাবলিকানরা জানিয়েছেন, এটি সাময়িক ব্যবস্থা।

জানা গেছে সিনেটের পদক্ষেপ অনুযায়ী, ২০২৮ সাল পর্যন্ত সাল্টে ছাড়ের সর্বোচ্চ সীমা ৪০ হাজার ডলার থাকবে।

যুক্তরাষ্ট্রের সরকারি ঋণের সীমা বা ‘ডেট লিমিট’ পাঁচ ট্রিলিয়ন (পাঁচ লাখ কোটি) ডলার বাড়ানো হচ্ছে। অর্থমন্ত্রী স্কট বেসেন্ট জানিয়েছেন, সরকার আগস্টের মধ্যেই বর্তমান ঋণসীমা ছাড়িয়ে যাবে এবং সময়মতো পদক্ষেপ না নিলে যুক্তরাষ্ট্র ঋণ খেলাপিতে পড়বে, যা বড় ধরনের আর্থিক সংকট ডেকে আনতে পারে।

ইয়েল বিশ্ববিদ্যালয়ের বাজেট ল্যাবের তথ্য অনুযায়ী, বিলটি ধনিক শ্রেণিকে তুলনামূলক বেশি সুবিধা দিচ্ছে। নিম্ন আয়ের শ্রেণির করদাতাদের গড় আয় ২ দশমিক ৫ শতাংশ কমবে। এটি হবে মূলত স্ন্যাপ ও মেডিকেইড কর্মসূচিতে সুবিধা কমার কারণে। অন্যদিকে উচ্চ আয়ের মানুষের আয় ২ দশমিক ৪ শতাংশ বাড়বে।

তবে শেষ মুহূর্তে সিনেটে যেসব সংশোধনী আনা হবে, তার ওপর ভিত্তি করে এসব প্রভাব কিছুটা বদলাতেও পারে। আশা করছি, অনেক কিছু সুবিবেচনা করে বদলাতে পারে।

যদিও সরকারি খরচে লাগাম টেনে ধরার উপায় হিসেবে এ বিলকে ব্যবহার করার চেষ্টা করছেন রিপাবলিকানরা। প্রকৃতপক্ষে বিলটি আইনে পরিণত হলে ২০৩৪ সালের মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রের বাজেট–ঘাটতি ৩ দশমিক ৩ ট্রিলিয়ন (৩ লাখ ৩০ হাজার কোটি) ডলার বাড়বে বলে হিসাব দিয়েছে কংগ্রেশনাল বাজেট অফিস। ঘাটতির বেশির ভাগ অংশ হবে ২০১৭ সালের করছাড়কে স্থায়ী করার খরচ।

এদিকে নিউইয়র্কের মেয়র পদের জন্য প্রাথমিক বাছাইয়ে জোহরান মামদানির চমকপ্রদ জয় যেন দুটি শহর ও দুই আমেরিকার গল্প পরিবর্তন ও নতুন উচ্চতায় পৌঁছে দেবার ইঙ্গিত মানুষের মুখে মুখে। আমার ধারণা তার অবস্থাও ইলন মাস্কের মতো বিপ্লবী হয়ে উঠবে। কারণ প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প কীভাবে বিবেচনা করছেন, তা দেখার বিষয়। তবে তিনি (জোহরান মামদানি) রাজ‍্যের বাঙালি কমিউনিটিতে খুবই জনপ্রিয় হয়েছেন।

একটু আগে জানা গেল যে, ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু সোমবার যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পকে নোবেল শান্তি পুরস্কারের জন্য একটি মনোনয়নপত্র হস্তান্তর করেছেন। ইরান ও ইসরায়েলের মধ্যে যুদ্ধবিরতির জন্য ট্রাম্পের প্রচেষ্টার স্বীকৃতি হিসেবে এই মনোনয়ন দেওয়া হয়েছে।

হোয়াইট হাউজে নেতানিয়াহুর এই সফর ছিল ইরানের পারমাণবিক স্থাপনায় যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েলের যৌথ হামলার পর ট্রাম্পের সঙ্গে তার প্রথম সরাসরি সাক্ষাৎ। এক নৈশভোজের সময় নেতানিয়াহু মনোনয়নপত্রটি বের করে ট্রাম্পকে দেন।


মাহবুব আহমেদ: লেখক, উদ্যোক্তা ও মানবাধিকার কর্মী।

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।