ঢাকা, রবিবার, ৮ ভাদ্র ১৪৩২, ২৪ আগস্ট ২০২৫, ০০ রবিউল আউয়াল ১৪৪৭

মুক্তমত

এক বছরে কতটা এগোল বাংলাদেশ?

মোস্তফা কামাল। সৌজন্যে: কালের কণ্ঠ |
আপডেট: ০৯:২০, আগস্ট ২৩, ২০২৫
এক বছরে কতটা এগোল বাংলাদেশ? মোস্তফা কামাল।

এমনিতেই বাংলাদেশের রাজনৈতিক অস্থিরতা, অর্থনৈতিক চাপ, মানবাধিকার নিয়ে আন্তর্জাতিক উদ্বেগ ভালো বার্তা দিচ্ছে না। তার ওপর কারণে-অকারণে শুধুই পিছুটানের খবর।

তা স্থানিক-আঞ্চলিক-আন্তর্জাতিক সব কিছুতেই। বিশ্বশান্তিতে পেছাল।

রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতায় গণতন্ত্র সূচকেরও পেছনে নেতিয়ে পড়া। নানা সূচকে বাংলাদেশের অবস্থান দুর্বল হওয়ার কারণে উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে উত্তরণের পথেও পিছিয়ে যাওয়া। বৈশ্বিক নানা সূচকে অবনতি বা পিছিয়ে পড়া কেন বাংলাদেশের পিছু নিয়েছে—এ প্রশ্নের জবাব নিষ্পত্তিহীনই থেকে যাচ্ছে। স্বাভাবিকভাবেই পরিবর্তনের এ পরিস্থিতিতে একটি প্রশ্ন সামনে চলে আসে, তাহলে গত এক বছরে কতটা এগোল বাংলাদেশ? 

ঢের আশাবাদের মধ্যে হতাশার খবর ছিল গ্লোবাল পিস ইনডেক্স মানে শান্তি সূচকে অবনতি।

শান্তিতে নোবেলজয়ীর শাসনকালে তা সবার জন্যই কষ্টের। লজ্জারও। ইকোনমিস্ট ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের গণতন্ত্র সূচকেও বাংলাদেশের অবস্থান নেমে গেছে। তা প্রকৃতি সংরক্ষণেও।

সেখানে ১৮০টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ১৭৩তম। তলানিতে যাকে বলে।

ইকোনমিস্ট ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের প্রতিবেদনে গণতন্ত্র সূচকে ২৪ সালে ২৩ সালের তুলনায় বাংলাদেশের স্কোর কমেছে ১.৪৪। অপেক্ষা এখন ২৫ সালের। অস্ট্রেলিয়ার সিডনিভিত্তিক আন্তর্জাতিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান ইনস্টিটিউট ফর ইকোনমিকস অ্যান্ড পিস (আইইপি) গ্লোবাল পিস ইনডেক্স ২০২৫ সালে গতবারের চেয়ে ৩৩ ধাপ পিছিয়ে বাংলাদেশের বর্তমান অবস্থান ১২৩।

আগামী বছর ২৬ সালে কী হবে, এখনই হলফ করে বলা যাচ্ছে না।

গত বছর বাংলাদেশে ছাত্রদের ব্যাপক বিক্ষোভ এবং রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতার কারণে নিরাপত্তা ও সুরক্ষা ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য অবনতি দেখা যায়। তৎকালীন আওয়ামী সরকারের কঠোর অবস্থানের কারণে ব্যাপক সহিংসতা এবং বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড ঘটে। অনেক নিখোঁজের অভিযোগও ওঠে। বাংলাদেশ ছাড়াও শান্তিসূচকে সবচেয়ে বেশি পেছানো দেশগুলো হলো ইউক্রেন, রাশিয়া, মায়ানমার, কঙ্গো। ভিন্ন পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশ এখন স্বল্পোন্নত দেশের (এলডিসি) তালিকা থেকে উত্তরণের নির্ধারিত সময়সীমা পিছিয়ে দেওয়ার সিঁড়িতে। ব্যবসায়ীদের দাবি—এমনিতেই দেশ একটি বাজে সময় পার করছে। তার ওপর এ মুহূর্তে এলডিসি থেকে উত্তরণ হলে রপ্তানি খাতসহ নানা খাতে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে।

ব্যবসায়ীদের এই দাবির পর এলডিসি উত্তরণের বিষয়টি নতুন করে আবারও আলোচনায় এসেছে। এলডিসি উত্তরণের সময় পেছানো কতটা যৌক্তিক ও বাস্তবসম্মত, তা নিয়ে নানাজনের নানা মত। সরকারের পক্ষ থেকে সময় বৃদ্ধির আবেদন করার জন্য কী কী যৌক্তিক কারণ আছে, সরকার চাইলেই কি সময় পেছাতে পারবে—এমন প্রশ্ন সামনে এসেছে। কারণ গত মার্চে অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা পরিষদ ২০২৬ সালে এলডিসি থেকে উত্তরণের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। গত আট বছরের নানা প্রক্রিয়া ও একাধিক মূল্যায়ন শেষে ২০২৬ সালের ২৪ নভেম্বর এলডিসি থেকে বের হবে বাংলাদেশ—সিদ্ধান্তটি ছিল জাতিসংঘের। সেই হিসাবে এলডিসি থেকে উত্তরণে বাংলাদেশের সামনে সময় আছে ১৫ মাস। এই সময়ে এসে উত্তরণের সময় পেছানোর প্রসঙ্গ।

গেল এক বছরে বাংলাদেশের সামগ্রিক পরিস্থিতি এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে, যেখানে অর্থনীতি, ব্যবসা-বাণিজ্য, উন্নয়ন কার্যক্রম, আইন-শৃঙ্খলা এবং সামাজিক অবস্থা সবকিছুতেই চরম অচলাবস্থা। সবই চলছে বা চালাতে হচ্ছে টেনেটুনে। এত পেছানোর ঘটনার মাঝে এগোনোর খবর আছে রিজার্ভে। দেশের রিজার্ভ কিছুটা বেড়েছে এবং প্রবাসী আয়ের প্রবাহ (রেমিট্যান্স) টিকে আছে। দেশের অর্থনীতি এখন প্রায় পুরোটাই বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ও রেমিট্যান্সের ওপর নির্ভরশীল। একসময় যেখানে দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ৪৮ বিলিয়ন ডলারের বেশি ছিল, তা এখন ৩০ বিলিয়ন ডলারের নিচে নেমে এসেছে। এই বিপুল পরিমাণ রিজার্ভ কমে যাওয়ায় সরকারের আমদানি ব্যয় মেটানো কঠিন হয়ে পড়েছে। জ্বালানি তেল, গ্যাস ও খাদ্যশস্যের মতো নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের আমদানি কমে গেছে। এই ঘাটতি পূরণে একমাত্র ভরসা এখন প্রবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্স। তবে এটি কোনো স্থায়ী সমাধান নয়। কারণ দেশীয় উৎপাদন ও রপ্তানি খাতে বৈচিত্র্য না এলে এই নির্ভরশীলতা আরো বাড়বে।

আমদানি-রপ্তানির জন্য এলসি  প্রক্রিয়া এখনো স্বাভাবিক হয়নি। ফলে ব্যবসা-বাণিজ্য ও বিনিয়োগ কার্যক্রম শুধুই পেছানো। ব্যবসায়ীরা কাঁচামাল আমদানি করতে পারছেন না, উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে, আর বিনিয়োগকারীরা নতুন উদ্যোগ নিতে অনিশ্চয়তায় ভুগছেন। ব্যাংকিং খাতের অবস্থা আরো করুণ। তিন-চারটি ব্যাংক ছাড়া প্রায় সব ব্যাংকই দেউলিয়াত্বের দ্বারপ্রান্তে। গ্রাহকরা ন্যূনতম টাকাও উত্তোলন করতে পারছেন না, যা সাধারণ মানুষের জীবনে মারাত্মক অনিশ্চয়তা তৈরি করেছে। ব্যাংকিং ব্যবস্থার প্রতি আস্থা ভেঙে পড়া মানে পুরো অর্থনীতির ভিত্তি নড়বড়ে হয়ে যাওয়া। উন্নয়ন প্রকল্পগুলো একে একে বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। বাজেট সংকটের কারণে অনেক প্রকল্পের কাজ সময়মতো শেষ করা সম্ভব হচ্ছে না।

সরকার ঘোষিত বড় বড় অবকাঠামো প্রকল্পের অনেকই থমকে আছে অর্থ সংকট ও দুর্নীতির কারণে। একই সঙ্গে চাকরির বাজার স্থবির হয়ে পড়েছে। যুবসমাজ হতাশায় দিন কাটাচ্ছে। পুরনো বেকারের সঙ্গে নতুন বেকারত্ব মিলে কর্মহীনতা চরম মাত্রায় পৌঁছেছে। পাশাপাশি সমাজে চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি ও মাদক ব্যবসা মহামারির আকার নিয়েছে। তরুণসমাজ মাদকাসক্ত হয়ে পড়ছে। আইনের শাসনের দুর্বলতা ও রাজনৈতিক অস্থিরতার সুযোগে অপরাধী চক্ররা প্রভাব বিস্তার করছে। দেশের আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতিও ভয়াবহ রূপ নিয়েছে। গ্রামীণ জনপদ থেকে শুরু করে শহরাঞ্চল পর্যন্ত মানুষ নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছে। চুরি, ডাকাতি, খুন, ধর্ষণসহ নানা অপরাধ বাড়ছে। একটি দেশের সামগ্রিক উন্নয়ন নির্ভর করে অর্থনীতি, সামাজিক স্থিতিশীলতা, কর্মসংস্থান, উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়ন ও সুদৃঢ় ব্যাংকিং ব্যবস্থার ওপর। কিন্তু বাংলাদেশের বর্তমান চিত্র উল্টো। অচল অর্থনীতি, ব্যর্থ ব্যাংকিং খাত, স্থবির বিনিয়োগ ও উন্নয়ন, মাদক-চাঁদাবাজির দৌরাত্ম্য এবং আইন-শৃঙ্খলার অবনতির কারণে দেশ গত এক বছরে পিছিয়ে পড়েছে অন্তত ১০ বছর! সময় ব্যক্তি চেনে না। কারো জন্য অপেক্ষা করে না। কিন্তু রাষ্ট্র যদি নিজের অদক্ষতা, দুর্নীতি ও অব্যবস্থাপনায় বন্দি হয়, তবে এক বছরের অল্প সময়েও দেশ পিছিয়ে যেতে পারে এক দশক। বাংলাদেশের সাম্প্রতিক পরিস্থিতি সেই বাস্তবতার নির্মম প্রতিচ্ছবি।

পেছানোর এ রোগ থেকে বেরিয়ে আসতে দ্রুত ও কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া জরুরি। অন্যথায় বাংলাদেশের উন্নয়নের চাকা আরো পিছিয়ে যাবে এবং সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রা আরো দুর্বিষহ হয়ে উঠবে। পিছিয়ে যাওয়া-পিছিয়ে পড়ার মন্দ খবরের জন্য মোটেই প্রস্তুত নয় দেশটির মানুষ। তাও দুনিয়াকে তাক লাগিয়ে ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের পর বিশ্বজোড়া যশ-খ্যাতিমান নোবেল লরিয়েট প্রফেসর ড. ইউনূসের আমলে। পেছাতে পেছাতে স্থানিক পর্যায়ে এখন বাংলাদেশের একাডেমিক কার্যক্রমেও পেছানোর পালা। সময়মতো ক্লাস, পরীক্ষা, ভর্তি ইত্যাদি শুরু ও শেষ না হওয়ায় এখন একাডেমিক শিক্ষাবছরই পিছিয়ে যেতে বসেছে। শিশুশ্রেণি থেকে উচ্চশিক্ষা পর্যন্ত এক বিতিকিচ্ছি দশা।

সব কিছুতে এই পেছানো বাতিকের জন্য অভিযোগের তীর ড. ইউনূসের অনির্বাচিত সরকারের দিকে। দেশের বড় দল বিএনপি নেতারা এ তীর নিয়মিতই ছুড়ছেন। মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর তো বলছেনই। ব্যবসা-অর্থনীতি ভালো বোঝা দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী তা যেকোনো অনুষ্ঠানেই বলে চলছেন। নির্বাচিত সরকার ক্ষমতায় এলে আর পেছানোর কোনো পর্ব বা সূচক থাকবে না, এটি তাঁদের সারকথা। তাঁদের মতে, নইলে বাংলাদেশ শুধু পেছাতেই থাকবে। বিনিয়োগ আসবে না। মবোক্রেসি আরো বাড়বে। জুডিশিয়াল সিস্টেম ভেঙে পড়বে। আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি আরো ভেঙে পড়বে। মন্তব্য হিসেবে এগুলো নিশ্চয়ই শুধু কথার কথা নয়। একেকটি গুরুত্বপূর্ণ বার্তা।  

লেখক: সাংবাদিক-কলামিস্ট; ডেপুটি হেড অব নিউজ, বাংলাভিশন

এনডি

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।