ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ৯ শ্রাবণ ১৪৩২, ২৪ জুলাই ২০২৫, ২৮ মহররম ১৪৪৭

মুক্তমত

তামাক নিয়ন্ত্রণ আইন: জনস্বার্থে সাহসী পদক্ষেপ প্রয়োজন

অধ্যাপক ডা. সোহেল রেজা চৌধুরী | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৯:১৭, জুলাই ২৩, ২০২৫
তামাক নিয়ন্ত্রণ আইন: জনস্বার্থে সাহসী পদক্ষেপ প্রয়োজন অধ্যাপক ডা. সোহেল রেজা চৌধুরী

তামাক বৈজ্ঞানিকভাবে প্রমাণিত এক নীরব ঘাতক, যার ভয়াল ছায়া ব্যক্তি থেকে সমাজ, অর্থনীতি ও ভবিষ্যৎ প্রজন্ম পর্যন্ত বিস্তৃত। প্রতিরোধযোগ্য মৃত্যুর শীর্ষতম কারণ হিসেবে তামাক বিশ্বে প্রতি বছর ৮০ লক্ষাধিক মানুষের প্রাণ কেড়ে নেয়।

বাংলাদেশেও প্রতি বছর প্রায় ১ লাখ ৬১ হাজারেরও বেশি মানুষের মৃত্যু ঘটে তামাক ব্যবহারজনিত কারণে (বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা)।

তামাকের কারণে যে অসংখ্য মানুষ দীর্ঘমেয়াদি অসুস্থতায় ভোগেন, তাদের চিকিৎসা ব্যয় ও শ্রমঘণ্টার ক্ষতি যোগ করলে এই ক্ষয়ক্ষতির আর্থিক পরিমাণ দাঁড়ায় বছরে প্রায় ৩০ হাজার কোটি টাকার সমান (বাংলাদেশ ক্যানসার সোসাইটি)। এর বিপরীতে তামাক খাত থেকে সরকার যে রাজস্ব আয় করে, তা তুলনামূলকভাবে অনেক নগণ্য। এই প্রেক্ষাপটে তামাক নিয়ন্ত্রণ আইন শক্তিশালী করার সরকারি উদ্যোগ কেবল সময়োপযোগী নয়, বরং তা জনস্বাস্থ্যের সুরক্ষায় একটি মৌলিক ও মানবিক দায়িত্বও বটে।

বাংলাদেশ ২০০৩ সালে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ফ্রেমওয়ার্ক কনভেনশন অন টোব্যাকো কন্ট্রোল (এফসিটিসি) স্বাক্ষর করে তামাক নিয়ন্ত্রণে বৈশ্বিক অঙ্গীকারে যুক্ত হয়। এই অঙ্গীকারের ধারাবাহিকতায় ২০০৫ সালে দেশে প্রথমবারের মতো তামাক নিয়ন্ত্রণ আইন প্রণীত হয়, যা তামাক ব্যবহারের ক্ষতিকর প্রভাব রোধে একটি যুগান্তকারী পদক্ষেপ হিসেবে বিবেচিত। পরবর্তীতে ২০১৩ সালে জনস্বাস্থ্য রক্ষায় আরও কার্যকর করার লক্ষ্যে আইনে সংশোধন আনা হয়, যা তামাকের প্রচার, প্রসার এবং ব্যবহার নিরুৎসাহিত করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। এর ফলে দেশে তামাক ব্যবহার কমছে, যা জাতীয় ও আন্তর্জাতিক জরিপে উঠে এসেছে। যেমন, ২০০৯ থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত তামাক ব্যবহারকারী প্রাপ্তবয়স্কের হার ৫৪ শতাংশ থেকে ৪৭ শতাংশে নেমেছে। ধূমপায়ীর হার ২৭ শতাংশ থেকে ২২ শতাংশে, এবং ধোঁয়াবিহীন তামাক ব্যবহারকারী ৩৬ শতাংশ থেকে কমে ৩১ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। আপেক্ষিক হারে এই হ্রাস একটি ইতিবাচক বার্তা বহন করে বটে, কিন্তু বর্তমানে যে গতিতে হ্রাস ঘটছে, তাতে ২০৩০ সালের মধ্যে তামাক ব্যবহারের হার ৩০ শতাংশ কমানোর বৈশ্বিক লক্ষ্য অর্জন সম্ভব নয় (বাংলাদেশ মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়)। এজন্য আইনকে আরও কার্যকর ও আধুনিক করা প্রয়োজন।

তামাক কোম্পানিগুলো নানা অজুহাতে এই আইন সংশোধনের বিরোধিতা করছে এবং বিভ্রান্তিকর প্রচার চালাচ্ছে। তারা বলছে, আইন সংশোধন হলে সরকারের রাজস্ব কমে যাবে। অথচ জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)-এর তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, ২০০৫ সালে আইন প্রণয়ন এবং ২০১৩ সালের সংশোধনের পরবর্তী অর্থবছরগুলোতে সিগারেট খাত থেকে রাজস্ব আয় ধারাবাহিকভাবে বেড়েছে। সুতরাং তামাক নিয়ন্ত্রণ আইনের শক্তিশালীকরণের সঙ্গে রাজস্ব কমে যাওয়ার কোনো সম্পর্ক নেই—এটি নিছক অপপ্রচার মাত্র। বাস্তবতা হলো, মানুষ ধূমপান ছাড়ে বা কমায় ধাপে ধাপে, কিন্তু তাৎক্ষণিকভাবে একেবারে পণ্য বাজার থেকে উঠে যায় না। বরং তারা ধীরে ধীরে কমাতে থাকে—এতে একদিকে যেমন স্বাস্থ্যসেবা খাতে ব্যয় কমে, তেমনি তামাকমুক্ত জনগোষ্ঠী গড়ে ওঠে যারা ভবিষ্যতে জাতীয় উৎপাদনে আরও বেশি অবদান রাখতে সক্ষম হয়।

আরেকটি প্রচলিত মিথ হলো—তামাক নিয়ন্ত্রণ আইন শক্তিশালী হলে বিপুল সংখ্যক মানুষের কর্মসংস্থান হুমকির মুখে পড়বে। অথচ পরিসংখ্যান বলছে ভিন্ন কথা। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর ২০২১ সালের জরিপ অনুযায়ী, দেশে প্রায় ১৫ লাখ ৩৯ হাজার খুচরা ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের মধ্যে মাত্র ১ লাখ ৯৬ হাজার দোকানে খাদ্য, পানীয় ও তামাক পণ্য বিক্রি হয়। এসব দোকানে তামাক সাধারণত অন্যান্য পণ্যের সঙ্গে বিক্রি হয়। অর্থাৎ, তামাক পণ্যের বিক্রি বন্ধ হলেও সেই দোকানগুলো পুরোপুরি বন্ধ হয়ে যাবে না বা কর্মসংস্থান একেবারে বিলীন হয়ে যাবে না—এমন ভয় একেবারেই অমূলক।

আরও একটি আশঙ্কা ছড়ানো হচ্ছে—পাবলিক প্লেসে ধূমপানের জন্য নির্ধারিত এলাকা (স্মোকিং জোন) বাতিল করা হলে ধূমপায়ীরা অন্যত্র ধূমপান করে পরোক্ষ ধূমপানের ঝুঁকি বাড়িয়ে তুলবে। অথচ বাস্তবতা হলো, এই ধরনের এলাকাগুলোয় ধোঁয়া নিয়ন্ত্রণ করা যায় না, বরং সেখানে প্রবেশ ও বের হওয়ার সময় ধোঁয়া ছড়িয়ে পড়ে পুরো রেস্তোরাঁজুড়ে। এতে নারী, শিশু, কর্মচারীসহ উপস্থিত সবাই ঝুঁকিতে পড়েন। তাই বিশ্বের ৭৯টি দেশ এই ব্যবস্থা বাতিল করেছে। বাংলাদেশেও ২০২২ সালের এক গবেষণায় উঠে এসেছে, তামাক কোম্পানিগুলো নগদ অর্থ ও সরঞ্জাম দিয়ে রেস্তোরাঁগুলোতে স্মোকিং জোন স্থাপনে উৎসাহ দিচ্ছে যাতে তরুণদের মধ্যে তামাক ব্যবহার বৃদ্ধির পথ সুগম হয়। এটি একটি সুপরিকল্পিত ব্যবসায়িক কৌশল, যা বন্ধে আইন সংশোধন করা প্রয়োজন।

তামাক কোম্পানির আরেকটি নতুন কৌশল হলো ই-সিগারেট ও ভ্যাপিং পণ্যকে নিরাপদ বিকল্প হিসেবে প্রতিষ্ঠা করা। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ই-সিগারেট ও এ জাতীয় ইমার্জিং টোব্যাকো প্রোডাক্টকে মারাত্মক স্বাস্থ্য হুমকি হিসেবে চিহ্নিত করেছে। এসব পণ্য তরুণদের মধ্যে নতুন করে আসক্তি তৈরি করছে। ফলে ভারত, থাইল্যান্ড, শ্রীলঙ্কা, সিঙ্গাপুরসহ অন্তত ৪২টি দেশ ইতোমধ্যে এসব পণ্য নিষিদ্ধ করেছে। এমনকি অতিসম্প্রতি যুক্তরাজ্যও ডিসপোজেবল ভ্যাপ নিষিদ্ধ করেছে। কিন্তু এসব নিষেধাজ্ঞার ফলে কোথাও ধূমপায়ীর হার বেড়ে গেছে এমন নজির পাওয়া যায়নি। বরং তরুণ সমাজকে সুরক্ষিত রাখতে দেশগুলো এমন সিদ্ধান্ত নিয়েছে।

এই প্রেক্ষাপটে স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয় বিদ্যমান তামাক নিয়ন্ত্রণ আইন সংশোধনের যে উদ্যোগ গ্রহণ করেছে, তা অত্যন্ত যৌক্তিক ও সময়োপযোগী। মন্ত্রণালয়ের উল্লেখযোগ্য প্রস্তাবনার মধ্যে রয়েছে—পাবলিক প্লেস, কর্মক্ষেত্র ও যানবাহনে ধূমপানের জন্য নির্ধারিত স্থান বিলুপ্ত করে শতভাগ ধূমপানমুক্ত পরিবেশ নিশ্চিত করা; বিক্রয়স্থলে তামাক পণ্যের প্রদর্শন নিষিদ্ধ করা; শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, হাসপাতাল ও শিশু পার্কের আশপাশে এবং ভ্রাম্যমাণ দোকানে তামাক বিক্রি নিষিদ্ধ করা; ই-সিগারেটসহ সব ইমার্জিং টোব্যাকো প্রোডাক্টের উৎপাদন, আমদানি, বিক্রি ও ব্যবহার নিষিদ্ধ করা; খুচরা বা একক শলাকা বিক্রি বন্ধ করা এবং তামাক পণ্যের মোড়কে সচিত্র স্বাস্থ্য সতর্কবার্তার আকার ৯০ শতাংশে উন্নীত করা।

আন্তর্জাতিকভাবে এই প্রস্তাবিত সংশোধনীর বৈধতা ও কার্যকারিতার যথেষ্ট নজির রয়েছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সাম্প্রতিক গ্লোবাল টোব্যাকো কন্ট্রোল রিপোর্ট অনুযায়ী, ব্রাজিল, তুরস্ক, মরিশাস এবং নেদারল্যান্ডস তামাক নিয়ন্ত্রণে সর্বোচ্চ রেটিংপ্রাপ্ত দেশ। বিশেষ করে ব্রাজিল ২০১১ সালে শতভাগ ধূমপানমুক্ত পাবলিক প্লেস নিশ্চিত করে এবং ই-সিগারেট নিষিদ্ধ করে। তার ফলস্বরূপ, মাত্র ২০ বছরে প্রাপ্তবয়স্ক ধূমপায়ীর হার ৩৪.৮ শতাংশ থেকে কমে মাত্র ৯.১ শতাংশে নেমে এসেছে। বাংলাদেশের জন্য এ অভিজ্ঞতা অত্যন্ত শিক্ষণীয় ও অনুকরণীয়।

এ ছাড়াও বিশ্ব তামাক নিয়ন্ত্রণ সম্মেলন ২০২৫-এ গৃহীত ডাবলিন ঘোষণায় বিশ্ব নেতারা তামাককে বৈশ্বিক জনস্বাস্থ্যের জন্য অন্যতম বড় হুমকি হিসেবে চিহ্নিত করে জরুরি পদক্ষেপ নেওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন। তারা তামাক ও নিকোটিন পণ্যের ওপর কর বৃদ্ধি, তামাক শিল্পের প্রভাব প্রতিহত করা, সব ধরনের বিজ্ঞাপন ও প্রচার নিষিদ্ধ করা, পরিবেশগত ক্ষতি মোকাবিলা এবং সুশীল সমাজ ও আন্তর্জাতিক সংস্থার সঙ্গে যৌথভাবে কাজ করার ওপর গুরুত্ব দেন। এই ঘোষণার লক্ষ্য হলো বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ফ্রেমওয়ার্ক কনভেনশন অন টোব্যাকো কন্ট্রোল (ডব্লিউএইচও এফসিটিসি) পূর্ণ বাস্তবায়নের মাধ্যমে তামাক ব্যবহার হ্রাস ও জনস্বাস্থ্য সুরক্ষা নিশ্চিত করা।

তামাক নিয়ন্ত্রণ আইন সংশোধন এখন সময়ের দাবি। তামাক কোম্পানির বিভ্রান্তিকর প্রচারণার চক্র থেকে বেরিয়ে এসে আমাদের সবাইকে জনস্বার্থের পক্ষে দাঁড়াতে হবে। কারণ ধূমপান কেবল ব্যক্তির নয়, আশপাশের মানুষের জীবনও ঝুঁকির মুখে ফেলে। তাই শক্তিশালী, আধুনিক ও কার্যকর আইনই আমাদের একমাত্র সুরক্ষা। আন্তর্জাতিক অভিজ্ঞতা প্রমাণ করেছে—দৃঢ় নীতি ও কঠোর প্রয়োগে তামাকের ক্ষতি কমানো সম্ভব। তাই আসুন, দেরি না করে সবাই মিলে এগিয়ে যাই তামাকমুক্ত বাংলাদেশ বিনির্মাণের পথে।

অধ্যাপক ডা. সোহেল রেজা চৌধুরী: বিভাগীয় প্রধান, রোগতত্ত্ব ও গবেষণা বিভাগ, ন্যাশনাল হার্ট ফাউন্ডেশন হাসপাতাল অ্যান্ড রিসার্চ ইনস্টিটিউট।

এমজেএফ

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।