ঢাকা, সোমবার, ৯ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৫ নভেম্বর ২০২৪, ২৩ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

মুক্তমত

সামাজিক বৈষম্য ও ‘অদ্ভুত আঁধার...’

ড. ফজলুল হক সৈকত | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ২৩৪৪ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ৬, ২০১২

প্রতিদিনের খবরের কাগজে, টিভির পর্দা কিংবা চারপাশের পরিচিত ভুবনে চোখ রাখলে আমরা মানবিক বিপণ্নতার কিছু ছবি হয়তো পাবো। ওইসব ছবি তথ্য হিসেবে খানিকটা মনের খোরাকও যোগায় বটে।

কিন্তু পথে ও প্রান্তরে যারা এক রকম জোর করে দেহ টেনে চলেছে নিত্যদিন, তাদের মনের ভেতরের খবর কতটুকু রাখতে পেরেছি আমরা? চাওয়া-পাওয়ার ফারাক যে দিনদিন বাড়ছে অপ্রতিরোধ্য গতিতে, সেদিকে কি সামান্যতম মনোযোগও আমরা স্থাপন করতে পেরেছি? বোধহয় পারিনি।

আর যদি সত্যি সত্যিই দায় ও দায়িত্ব থেকে খানিকটা সরে গিয়েও থাকি, তাহলে আজকের দৃশ্যমান সামাজিক বৈষম্যের জন্য হয়তো একদিন আমাদের শাস্তি পেতে হবে। কারণ, প্রকৃতি কোনো অন্যায় ক্ষমা করে না।

বাংলাদেশের শান্তিপ্রিয় মানুষের মনে আজ আর শান্তির সুবাতাস বয় না। অল্প আয়ের মানুষের পক্ষে পরিবার-পরিজন নিয়ে টিকে থাকাই এক রকম অসম্ভব হয়ে পড়েছে। প্রাণ খুলে হাসি সে তো সোনার হরিণ! মুক্তবাজার অর্থনীতি আর গণতন্ত্রের এই বুঝি ফলাফল! কিছু মানুষের ধন-সম্পত্তি বেড়ে চলেছে হু হু করে। বেশির ভাগ মানুষ সংসার চালাচ্ছে বড় কষ্টে।

আর অনেকের সামাজিক অবস্থান দারিদ্র্য সীমার নিচে। বর্তমান প্রজন্মের ভবিষ্যৎ হয়ে পড়েছে অনিশ্চিত। জীবন যুদ্ধের প্রতিযোগিতায় পিছিয়েপড়া সাধারণ ও নির্বিবাদী লোকেরা চারপাশের ধেয়েচলা জৌলুসময় জীবনধারার সঙ্গে ঠিক তাল মেলাতে পারছেন না। অপমান, ব্যর্থতা আর লজ্জায় তারা মাথা নত করে মেনে নিয়েছেন সমাজের এই অপ্রত্যাশিত বৈষম্যের ভয়াবহ বাস্তবতা।

সম্প্রতি মালয়েশিয়া থেকে পিএইচডি সম্পন্ন করে দেশে আসা একজন গবেষক ও বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকের ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার বিবরণ শুনতে শুনতে আমাদের দেশে চলমান জীবনধারার সামাজিক বৈষম্য বিষয়ে নতুন করে ভাবনা শুরু হলো। তার কথায় পেলাম চরম হতাশার আভাস। একটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে ৮ বছর চাকরি করেও তিনি পাননি কোনো প্রমোশন।

আশা করেছিলেন প্রমোশন পাবেন, গবেষণা করবেন, দেশমাতৃকার উন্নয়নে নিবিড় মনে কাজ করবেন। তাই বিদেশের মাটিতে অবস্থানের ভালো অফার পেয়েও, বোধকরি কেবল দেশপ্রেমের কারণে, ফিরে এলেন। কিন্তু প্রত্যাবর্তনের বছর খানেক পার হতে না হতেই তাকে ঘিরে ধরেছে বিষণ্নতা ও ব্যর্থতার গ্লানি। আর পরিবার-পরিজনের অভিযোগ তো নিত্য সঙ্গী।

তো ওই গবেষক তার সহপাঠী বন্ধু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক সহযোগী অধ্যাপকের সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে গেলেন একটু আশার বাণী শুনতে কিংবা কতক পরামর্শ করার জন্য। (অবশ্য ঠিকমতো পদোন্নতি পেলে তিনিও হতে পারতেন সহযোগী অধ্যাপক; কিন্তু বিধি বাম, তাঁর কর্মস্থলটিতে গত ২০ বছরে প্রমোশন হয়নি কোনো শিক্ষকেরই, তাই আজও তিনি প্রভাষক)। ভেবেছিলেন বন্ধুটি ভালো আছেন। আলাপ-সালাপ, চা-কফির ফাঁকে ফাঁকে জানা গেল, বন্ধুটি আমেরিকা কিংবা ইউরোপের পথে পা বাড়ানোর চেষ্টায় আছেন।

কারণ, তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘মাস্টারি’ করে যা পয়সাপাতি পান, তাতে সংসার চালানো কঠিন। ভবিষ্যতের জন্য সঞ্চয় তো অকল্পনীয়। ইমিগ্রেশন নিয়ে চলে যাওয়ার মানসিক প্রস্তুতি নিয়ে সময় পার করছেন এখন। হতাশাগ্রস্ত ওই প্রভাষকের প্রত্যাশার বারান্দায় ভিড় করলো গভীর অপ্রকাশ ভাব। মশা নিয়ন্ত্রণ বিষয়ে উচ্চতর ডিগ্রি অর্জন করেছেন তিনি। মশার শহর ঢাকা এবং আবর্জনায় পরিপূর্ণ বাংলাদেশে তিনি মশা নিয়ন্ত্রণে তাৎপর্যপূর্ণ কিছু কাজ করার অভিপ্রায় নিয়ে দ্বারে দ্বারে ঘুরেও পাচ্ছেন না  আশার আলো।

গত প্রায় তিন দশকে বাংলাদেশ থেকে বিদেশে স্থায়ীভাবে বসবাসের জন্য পাড়ি জমিয়েছেন কয়েক হাজার ‘স্কিল্ড অ্যান্ড কোয়ালিফাইড’ মানুষ। উন্নত বিশ্বে এসব অভিজ্ঞ ও যোগ্য নাগরিকরা বিভিন্ন ক্ষেত্রে ভালো ভূমিকাও রাখছেন। দুর্ভাগ্য যে, বাংলাদেশ তার তৈরি করা যোগ্য নাগরিককে ধরে রাখতে পারছে না। সম্ভাবত যোগ্যতা অনুযায়ী সামাজিক মর্যাদা ও বেতন না পাওয়া এবং রাজনৈতিক অস্থিরতা এর পেছনের মূল কারণ।
যুক্তরাজ্য, আমেরিকা, কানাডা, অস্ট্রেলিয়া, সুইডেনসহ সারা দুনিয়ায় ছড়িয়ে পড়ছে বাংলাদেশের উচ্চশিক্ষিত-অভিজ্ঞ ও যোগ্য লোকেরা। আমরা হারাচ্ছি প্রতিভাবান ও সম্ভাবনাময় মানুষ। ক্রমাগত দেশটি হয়ে পড়ছে নেতৃত্বহীন। শিক্ষা-দীক্ষা দান করতে পরিবার ও রাষ্ট্র কতো সময় ও টাকা বিনিয়োগ করেছে তাদের পেছনে! হয়তো তাদের আমরা দোষারোপ করতে পারি অকৃতজ্ঞতার দায়ে।

কিন্তু যদি স্বস্তি ও নিরাপত্তার প্রশ্নটি ওঠে? ওইসব দেশে অসম্মানজনক কাজ করতেও তাদের আপত্তি নেই। তার মানে এই দাঁড়ায় যে, কোনো রকমে বাংলাদেশ ছাড়তে পারলেই যেন ‘প্রাণে পানি আসে’। স্বদেশের মমতা ছেড়ে কেবল একটু প্রশান্তির প্রত্যাশায় প্রশিক্ষিত জনগোষ্ঠীর এই বিদেশ প্রীতি। তবে কি বিজয়লাভের পর  স্বাধীন দেশে মানুষের সামাজিক-আর্থিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করা যায়নি? শিক্ষিত, যোগ্য ও অভিজ্ঞ লোককে কি আমরা যথাযোগ্য সম্মান জানাতে পারছি না? চারদিকে কি দাপটের সঙ্গে বিচরণ করছে অযোগ্যরা? এসব কথা ভাবতে গেলে আজকাল কবি ও কথানির্মাতা জীবনানন্দের লেখা একটি কবিতার কথা মনে পড়ে।

তিনি লিখেছিলেন: ‘অদ্ভুত আঁধার এক এসেছে এ পৃথিবীতে আজ,/যারা অন্ধ সবচেয়ে বেশি আজ চোখে দেখে তারা;/যাদের হৃদয়ে কোনো প্রেম নেই /প্রীতি নেই/ করুণার আলোড়ন নেই/পৃথিবী অচল আজ তাদের সুপরামর্শ ছাড়া/যাদের গভীর আস্থা আছে আজো মানুষের প্রতি,/এখনো যাদের কাছে স্বাভাবিক বলে মনে হয়/মহৎ সত্য বা রীতি, কিংবা শিল্প অথবা সাধনা/শকুন ও শেয়ালের খাদ্য আজ তাদের হৃদয়/এই আঁধার থেকে কি আমাদের কোনো মুক্তি নেই?


বাংলাদেশ সময়: ২৩২১ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ০৬, ২০১২
সম্পাদনা: প্রভাষ চৌধুরী, নিউজরুম এডিটর

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।