অবশেষে নির্বাচনি ট্রেন প্ল্যাটফর্ম ছাড়ল। শুক্রবার বিকালে জুলাই সনদ স্বাক্ষরের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ আগামী নির্বাচনের পথে আনুষ্ঠানিক যাত্রা করল।
জুলাই যোদ্ধারা কিছু দাবি সনদে অন্তর্ভুক্তির দাবিতে বিক্ষোভ করেন। তাদের বিক্ষোভ সহিংসতায় রূপ নেয়। কিন্তু জাতীয় ঐকমত্য কমিশন এবং সরকার দ্রুততম সময়ের মধ্যে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করতে সক্ষম হয়। জুলাই যোদ্ধাদের দাবি মেনে কমিশন জুলাই সনদ বাস্তবায়নসংক্রান্ত অঙ্গীকারনামায় সংশোধন আনে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী বিচক্ষণতার সঙ্গে পরিস্থিতি সামাল দেয়। এসব প্রতিকূলতা মোকাবিলা করেই শেষ পর্যন্ত জুলাই সনদ স্বাক্ষর অনুষ্ঠান সফলভাবে সম্পন্ন হয়। এ অনুষ্ঠানটি যেন বাংলাদেশের প্রতিটি অর্জনের জন্য ত্যাগ এবং বৈরিতাকে পরাস্ত করার গৌরবময় ইতিহাসের এক প্রতীক। আমাদের কোনো অর্জনই সহজলভ্য নয়, জুলাই সনদ স্বাক্ষরের আগের ঘটনা তা আমাদের আরেকবার মনে করিয়ে দিয়েছে।
প্রতিকূলতা জয় করেই বাংলাদেশ এগিয়ে যায়, তা আবারও প্রমাণ হলো। জুলাই সনদে স্বাক্ষর ছাড়া নির্বাচন অভিযাত্রা সম্ভব ছিল না। এটিই হচ্ছে আগামী নির্বাচনের ভিত্তি। এ স্বাক্ষরের মধ্য দিয়ে নির্বাচন প্রক্রিয়ার শেষ বাধা অতিক্রম করল বাংলাদেশ। অনুষ্ঠানে বক্তব্য দিতে গিয়ে প্রধান উপদেষ্টা নির্বাচনের বিষয়টি তুলে ধরেন। জুলাই সনদের ভিত্তিতে আগামী নির্বাচন উৎসবমুখর পরিবেশে অনুষ্ঠিত হবে বলে আশাবাদ ব্যক্ত করেন ড. ইউনূস।
অস্বীকার করার কোনো কারণ নেই যে এ অনুষ্ঠানের কিছু অপূর্ণতা আছে। বিশেষ করে জুলাই আন্দোলনের অগ্রসৈনিকদের গড়া নতুন রাজনৈতিক দল এনসিপির অনুপস্থিতি সবাইকে পীড়া দিয়েছে। এনসিপির এখনকার জনপ্রিয়তা যা-ই হোক না কেন, এ সনদের প্রেক্ষাপট তারাই তৈরি করেছিল-এ সত্য অস্বীকার করার কোনো উপায় নেই। দীর্ঘ ১৫ বছর ক্ষমতায় থাকা একটি দানব সরকারের পতনের চূড়ান্ত আন্দোলনের ভিত্তি রচনা করেছিলেন এ তরুণরাই। কোটা সংস্কার আন্দোলনই শেষ পর্যন্ত স্বৈরাচার পতনের আন্দোলনে রূপ নেয়। তরুণদের পক্ষে রাজপথে নেমে আসে সর্বস্তরের মানুষ। এ তরুণরা ইতিহাসের সূর্যসন্তান। অনেকে মনে করেন, জুলাই বিপ্লবের পর এ তরুণদের অন্তর্র্বর্তী সরকারের অংশ হওয়া উচিত হয়নি। আবার কেউ কেউ মনে করেন, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের প্ল্যাটফর্ম থেকে এত তাড়াতাড়ি রাজনৈতিক দল গঠনের সিদ্ধান্ত সঠিক ছিল না। আমি এ বিতর্কে যেতে চাই না। আমি মনে করি বাংলাদেশের রাজনীতিতে তারুণ্যের রক্তসঞ্চালন জরুরি। নতুন চিন্তাভাবনা রাজনীতিকে আরও বিকশিত করবে। এনসিপির নেতৃত্বে যাঁরা আছেন, তাঁরা সবাই তরুণ। বেশির ভাগই হয় এখনো ছাত্র কিংবা সদ্য শিক্ষাজীবন শেষ করা তরুণ। এঁদের সামনে অনেক পথ। তাঁদের তাড়াহুড়া করার কিছু নেই। ক্ষমতায় যাওয়ার চেয়ে তাঁদের জাতির বিবেক হিসেবে দেখতেই জনগণ বেশি আগ্রহী। জুলাই আন্দোলনের পর তাঁরা যদি ক্ষমতা থেকে দূরে অবস্থান করে সরকার ও রাজনৈতিক দলগুলোর ভুলত্রুটি ধরিয়ে দিতেন, তাহলে জনগণ যে তাঁদের মাথায় তুলে রাখত তা হলফ করেই বলা যায়। যখনই তাঁরা সরকারের অংশ হলেন, রাজনৈতিক দল গঠন করলেন তখন তাঁদেরও প্রচলিত ধারার ক্ষমতার কাঙাল রাজনীতিবিদদের কাতারে ভাবতে শুরু করল মানুষ। সাধারণ মানুষের মধ্যে তাঁদের প্রতি আবেগ, ভালোবাসা ধীরে ধীরে থিতিয়ে পড়ল। এর চেয়েও বড় কথা হলো, এ দেশ জোয়ারভাটার দেশ। এখানে সব দিন সবার সমান যায় না।
চব্বিশের জুলাই-আগস্টে এনসিপির তরুণদের যে জনপ্রিয়তা ছিল তা এখন আর নেই। এটাই পৃথিবীর নিয়ম। আমার মনে হয়, তরুণরা এ বাস্তবতা উপলব্ধি করতে পারেননি। গত বছরের আগস্ট থেকে ধীরে ধীরে তাঁদের জনপ্রিয়তার নিম্নমুখী ধারা হয়তো তাঁদের মেনে নেওয়া কঠিন হয়ে যাচ্ছে। এ কারণেই এনসিপির তরুণদের অনেকে অসহিষ্ণু আচরণ করছেন, যা তাঁদের কাছে মানুষ প্রত্যাশা করে না। কারও কলিজা ছিঁড়ে ফেলার হুমকি কিংবা কাউকে অশালীন ভাষায় গালিগালাজ করা অধিকাংশ মানুষই পছন্দ করে না। রাজনীতি ধৈর্য এবং ত্যাগের পরীক্ষা। এখানে এলাম, দেখলাম, জয় করলামের মতো ঘটনা ঘটে না। রাজনীতিতে জনগণেই হলো আসল বিচারক। তাদের পছন্দ-অপছন্দই আসল কথা। এজন্যই এনসিপির উচিত ধীরস্থিরভাবে রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত নেওয়া। তাঁদের প্রতিটি পদক্ষেপ নিতে হবে চিন্তাভাবনা করে। জুলাই সনদে স্বাক্ষর না করার সিদ্ধান্ত কতটা রাজনৈতিক বিবেচনাপ্রসূত আর কতটা আবেগতাড়িত, তা এক বড় প্রশ্ন। রাজনৈতিক বিবেচনা থেকে যদি এনসিপি জুলাই সনদে স্বাক্ষরের বিষয়টি দেখত তাহলে নিশ্চয়ই এ ধরনের আবেগতাড়িত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করত না। কারণ জুলাই সনদ এবং এর বাস্তবায়ন, দুটি সম্পূর্ণ ভিন্ন বিষয়। জুলাই সনদ সম্মিলিতভাবে অনুমোদন করলেই না তা কীভাবে কার্যকর করা হবে, সে প্রশ্ন আসবে। জুলাই সনদে সব দল স্বাক্ষর করার পর নিশ্চয়ই এ নিয়ে দলগুলোর মধ্যে আলোচনা হবে।
সরকার সবার মতামত নিয়ে একটি যৌক্তিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ করবে। জুলাই সনদের জন্য গণভোট করতে হবে, এ ব্যাপারে ইতোমধ্যে ঐকমত্য হয়েছে। কখন গণভোট হবে, গণভোটে কীভাবে প্রশ্ন উপস্থাপন করা হবে, সেসব বিষয় এখনো অমীমাংসিত। আলোচনার মাধ্যমেই এর সমাধান করা সম্ভব। এ কারণেই জামায়াত জুলাই সনদে স্বাক্ষর করেছে। এ সই করার অর্থ এটা নয় যে তারা নভেম্বরে গণভোট এবং পিআর পদ্ধতিতে নির্বাচনের দাবি থেকে সরে এসেছে। এনসিপিও তাদের দাবি বহাল রেখে জুলাই সনদে স্বাক্ষর করতে পারত। এতে তাদের দাবি আরও জোরদার হতো। এনসিপির মূল দাবির সঙ্গে কারও দ্বিমত নেই। সব রাজনৈতিক দলই চায় জুলাই সনদের আইনি ভিত্তি। এ আইনি বৈধতা কোন পদ্ধতিতে হবে তা নিয়ে দলগুলোর মধ্যে মতবিরোধ আছে। এটাই স্বাভাবিক। দলগুলো যদি আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে জুলাই সনদ তৈরি করতে পারে তাহলে তারা আলোচনার মাধ্যমেই এর বাস্তবায়ন প্রক্রিয়া ঠিক করতে পারবে। তাই জুলাই সনদের স্বাক্ষর অনুষ্ঠান বর্জন এনসিপির একটি ভুল সিদ্ধান্ত। একে আমি বলব তারুণ্যের ভ্রান্তিবিলাস। তবে আশার কথা, জাতীয় ঐকমত্য কমিশন জানিয়েছে, পরেও দলগুলো এ সনদে স্বাক্ষর করতে পারবে। ৩০ অক্টোবরের মধ্যে এ সনদে স্বাক্ষরের সুযোগ আছে। তাই আমরা আশা করি তরুণদের আবেগ প্রশমিত হলে নিশ্চয়ই তাঁরা বাস্তবতা অনুধাবন করবেন। জুলাই সনদে সই করে এনসিপি গণতন্ত্র উত্তরণের পথ প্রশস্ত করবে। জুলাই বিপ্লব পাবে পূর্ণতা।
অদিতি করিম : লেখক ও নাট্যকার
Email : auditekarim@gmail.com