ঢাকা, সোমবার, ৯ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৫ নভেম্বর ২০২৪, ২৩ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

মুক্তমত

প্রতিক্রিয়া: পাকিস্তানের ক্ষমা চাওয়া বা না চাওয়া প্রসঙ্গ

জিনিয়া জাহিদ, কন্ট্রিবিউটিং এডিটর | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৩৫৫ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ১৯, ২০১৩
প্রতিক্রিয়া: পাকিস্তানের ক্ষমা চাওয়া বা না চাওয়া প্রসঙ্গ

সম্প্রতি প্রকাশিত পাকিস্তানের প্রখ্যাত পরমাণু পদার্থবিদ, কলামিস্ট ও সমাজকর্মী পারভেজ হুদভয়ের একাত্তরে বাংলাদেশের উপর পাকিস্তানের ভূমিকার জন্য আনুষ্ঠানিক ক্ষমা চাওয়া নিয়ে লেখা নিবন্ধটি খুব মনোযোগ দিয়েই পড়লাম। লেখককে ধন্যবাদ তাঁর দেশের ঘৃণ্য বর্বরতামূলক আচরণ উপলব্ধি করেছেন সেজন্য।

যদিও, লেখক ব্যক্তিগতভাবে বাংলাদেশের মানুষের কাছে ক্ষমা চেয়েছেন কিনা তাঁর লেখায় তা থেকে সুস্পষ্ট নয়। তবে, বাংলাদেশের প্রতি একাত্তরের স্বাধীনতা যুদ্ধের বর্বরতার ক্ষমা চাওয়া প্রসঙ্গটি তিনি তাঁর লেখায় তুলে এনেছেন। এ প্রসঙ্গে কিছু বলার তাগিদ অনুভব করছি বলেই আজকের এই লেখার অবতারণা।

একাত্তরের গণহত্যা ও বর্বরতার জন্য ২০০২ সালে পাকিস্তানের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট জেনারেল পারভেজ মোশাররফ একবার `দুঃখ` প্রকাশ করেছিলেন। এর আগেও পাকিস্তানের ক্রিকেটার রাজনীতিবিদ ইমরান খান একাত্তরে গণহত্যাসহ মানবতাবিরোধী সব ধরনের অপরাধের জন্য বাংলাদেশের জনগণের কাছে পাকিস্তান সরকারের নিঃশর্ত ক্ষমা চাওয়ার দাবি করেছিলেন। গত বছর হিনা রাব্বানি খার বাংলাদেশে পাঁচ ঘণ্টার সফরে এলে, একাত্তরে গণহত্যার জন্য পাকিস্তানের আনুষ্ঠানিক ক্ষমা চাওয়ার “হালকা-পাতলা” দাবি তোলা হয়। হালকা-পাতলা দাবি বলছি, এজন্যই যে, হিনা খার-এর সফরের সময় বাংলাদেশ থেকে আসলেই জোরালো কোনো দাবি কখনোই তোলা হয় নাই। এই সেনসিটিভ ইস্যুটি সফরের পূর্বেই তাদের না জানিয়ে হুট করে দাবি তোলাটা কূটনৈতিকভাবে কতখানি গ্রহণযোগ্য তা ভেবে দেখার বিষয়। আর এরকম একটি ইস্যু নিজ দেশের সরকারকে ডিঙিয়ে হিনা খার বাংলাদেশে এসে তাত্ক্ষণিকভাবে ক্ষমা চাইবেন, সেটাও বোধহয় কূটনৈতিক আচরণ বিধির আওতায় পড়ে না। কাজেই, হিনা খার-এর ক্ষমা চাওয়া নিয়ে বাংলাদেশের দাবি তোলা কিংবা তাদের ক্ষমা চাওয়া অস্বীকৃতি জানান বিষয়টিকে তেমন একটা জোরালো নয় বলেই মনে করা হয়ে থাকে।

পাঠক, চলুন আপাতত পাকিস্তানের আনুষ্ঠানিক ক্ষমা চাওয়ার বিষয়টি কিছু সময়ের জন্য আলোচনার বাইরে রেখে পারভেজ হুদভয়ের নিবন্ধটির দিকে দৃষ্টিপাত করা যাক।

তিনি লিখেছেন যে, ইসলামাবাদের অনেক ছাত্রই শাহবাগ স্কয়ারের নাম শুনে নাই, কিংবা কাদের মোল্লার নাম শুনে নাই। এতে আদৌ কি কোনো অস্বাভাবিকতা আছে? তারা শাহবাগ কিংবা কাদের মোল্লার খবর রেখেই বা কি করবে? এটা বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়। সত্যি বলতে কি, পাকিস্তানে যেমন কোথায় কখন বোমা ফুটে কেউ মরছে নাকি হাসপাতালে কাতরাচ্ছে, সেটা নিয়ে যেমন আমাদের যেকোনো বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া কোনো ছাত্রের আগ্রহ বা মাথা ব্যথা নেই, ঠিক তেমনি শাহবাগ ও সেখানে চলমান আন্দোলন নিয়ে পাকিস্তানের কার আগ্রহ আছে বা নেই সেটা জানার আমাদেরও কোন আগ্রহ নেই। আর তাহরির স্কয়ারের সাথে শাহবাগের ঘটনা মোটেও এক নয়। পাকিস্তানি ছাত্ররা তাহরির স্কয়ার নিয়ে আগ্রহী হতেই পারে, কারণ তাদের অকার্যকর সরকারকে গদি থেকে নামাতে তা তাদের মাঝে প্রেরণার উত্স হতে পারে, কিন্তু আমরা শাহবাগে আমাদের নির্বাচিত সরকারের পতনের দাবি নিয়ে আসিনি, আমরা এসেছি যুদ্ধাপরাধীদের ফাঁসির দাবি নিয়ে এবং সেইসাথে পাকিস্তানের ছত্রছায়ায় গড়ে ওঠা ধর্ম নিয়ে রাজনীতি করা দল জাময়াতে-ইসলামীর নিষিদ্ধকরণের দাবি নিয়ে।

তিনি লিখেছেন, কাদের মোল্লার ব্যাপারে কোনোরকম আগ্রহ  দেখায়নি পাকিস্তানি গণমাধ্যম এবং পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। ব্যাপারটাকে তিনি দু:খজনক হিসেবে প্রকাশ করলেও আমরা এখানে কোনরকম অস্বাভাবিকতা আছে বলে মনে করি না। পাকিস্তান বাংলাদেশের কাছে এমন কোনো গুরুত্বপূর্ণ কোনো রাষ্ট্র নয় যে, তাদের মন্ত্রণালয় থেকে কোনো রকম বিবৃতির অপেক্ষায় আমরা বসে আছি। তাছাড়া কূটনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে যদি ব্যপারটা দেখি, তাহলে আদৌ কি তাদের সরকার স্বাধীন একটি দেশের অভ্যন্তরীণ এরকম একটা ইস্যুর উপর কথা বলার অধিকার রাখে? বা রাখা উচিত কি? বাংলাদেশে আটকে পড়া বিহারিদের মতোই কাদের মোল্লাকে ভুলে না গিয়ে পাকিস্তানের মনে রাখা উচিত ছিল কি না আমি জানি না। মনে রাখলে কি একাত্তরের যুদ্ধের সময় "দ্বিজাতি তত্ত্বে বিশ্বাসী" এবং যুদ্ধে পাকবাহিনীকে সাহায্যকারী কাদের মোল্লা নামক এই পাকিস্তানি পরম বন্ধুকে তারা ফিরিয়ে নিয়ে গিয়ে ডিম-দুধ খাওয়াত? আর ওরা যদি কাদের মোল্লাকে ভুলে না গিয়ে মনেও রাখতো তাহলে কি কাদের মোল্লার মতো যুদ্ধাপরাধীকে আমরা ফাঁসি না দিয়েই ওদের কাছে ফিরিয়ে দিতাম?

পাকিস্তানে তাদের পাঠ্য বইয়ে ইতিহাস গোপন করা হচ্ছে তা জানানোর জন্য মিস্টার পারভেজকে ধন্যবাদ। স্কুলগুলোর পাঠ্যবইতে তারা তাদের ঘৃণ্য ইতিহাস গোপন করেছে, সামাজিক শিক্ষা বইতে হিন্দু ও মুসলিমদের ভেদাভেদ দিয়ে নিজেদের ভেতরে সাম্প্রদায়িকতার বিষ বপন করেছে। আর এর ফল তারা ইতোমধ্যে পেতেও শুরু করেছে। ধর্মযুদ্ধ চালিয়ে যাওয়ার গুরুত্ব বুঝিয়ে তারা ধর্মের নামে নিত্য বোমাবাজি করছে। সমগ্র বিশ্বের কাছে সাম্প্রদায়িক দেশ হিসেবে আজ পাকিস্তান পরিচিতি লাভ করেছে।

আজকের পাক তরুণরা যেমন কল্পনাও করতে পারছে না যে, তখনকার পশ্চিম পাকিস্তানিদের ভেতর কতোটা বাঙালি বিদ্বেষ ছিল, ঠিক তেমনি জনাব পারভেজ কল্পনাও করতে পারবেন না, আমাদের বাঙালি তরুণদের মনে কতখানি পাক বিদ্বেষ আছে!! পারভেজ হুদভয় যেমন তাঁর লেখায় অত্যন্ত লজ্জিতভাবে স্বীকার করেছেন যে, তরুণ বয়সে আমাদের দেশের ‘কালো’ও ‘বেঁটে’ লোকদের প্রতি তিনি করুণা অনুভব করতেন। ঠিক তেমনি তাকে আমরা জানাতে চাই যে, নিত্য বোমা হামলা কিংবা তালেবানের আগ্রাসী হামলায় জর্জরিত পাকিস্তানিদের দেখে আমরাও নিছক করুণা ছাড়া আজ আর কিছুই অনুভব করি না। পাকিস্তানের অনেক তরুণ তাদের ‘পূর্ব প্রদেশ’ হারানোর কারণে আজও ক্ষোভ প্রকাশ করেন বলে আমরা পারভেজ হুদভয়ের লেখাটি থেকে জানতে পারি। কিন্তু আমাদের বাঙালিদের মনে পশ্চিম পাকিস্তানের সাথে বিচ্ছিন্ন হয়ে কোনো ক্ষোভ কাজ করে না। কারণ, পাকিস্তান নামক সাম্প্রদায়িক দেশ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে আমরা পেয়েছি একটি স্বাধীন দেশ, একটি মানচিত্র, একটি পতাকা। আজ আমরা নিজেদের ভাষায় প্রাণ খুলে মনের ভাব বলতে ও লিখতে পারছি। আমাদের নিজেদের অর্থনীতি আমরা নিজেরাই গড়েছি।

এবার আসি স্বাধীনতার বিয়াল্লিশ বছর পর পাকিস্তানের আনুষ্ঠানিক ক্ষমা চাওয়া না চাওয়া প্রসঙ্গে। পাকিস্তান আমাদের কাছে ক্ষমা চেয়ে নিলে দুই দেশের উন্নয়নে কি এমন সিগনিফিক্যান্ট প্রভাব পড়বে, তা নিয়ে সত্যি গবেষণা করে দেখা যেতে পারে। আর, পাকিস্তান ক্ষমা চাইলেই কি আমরা ক্ষমা করে দেব? তারা ক্ষমা চাইলেই কি জহির রায়হান, মুনির চৌধুরী, শহীদুল্লাহ কায়সারের মতো বুদ্ধিজীবীরা আবার ফিরে আসবেন? ওর ক্ষমা চাইলেই কি আমার প্রিয়ভাষিণী, তারামন বিবি, সেতারা বেগম বীরাঙ্গনা মায়ের ওপর হানাদার বাহিনীর নির্মম নৃশংসতার দায় মুছে যাবে? ওরা ক্ষমা চাইলেই কি আমার সন্তানহারা মায়ের বুকের মানিক ফিরে আসবে? এ যেন অনেকটা ধর্ষিতার সাথে ধর্ষকের বিয়ে দিয়ে ঘর সংসার করার মতই!!!

ক্ষমা নয়, আমরা চাই কূটনৈতিক যে অমীমাংসিত বিষয় আছে সেগুলা নিয়ে বাংলাদেশ-পাকিস্তানের মধ্যে ফলপ্রসূ আলোচনা হোক। পাক সেনাবাহিনীর নিষ্ঠুর নির্যাতনের শিকার আওয়ামী লীগের সক্রিয় কর্মী, বুদ্ধিজীবী ও স্বাধীনতাকামী সকল মুক্তিযোদ্ধাদের যে হত্যা করেছিল, সে ইতিহাস তারা প্রকাশ করুক। পাকিস্তানে আশ্রয় নেওয়া সকল যুদ্ধাপরাধীকে বিচারের আওতায় আনার জন্য তাদের ওরা আমাদের কাছে ফিরিয়ে দিক। তারা ১৯৭১ সাল কখনোই ভুলে যাবে না, ভুলতে পারবে না। ইতিহাস বিকৃতি আসলে নতুন কিছু নয়। আংশিক ও বিকৃত ইতিহাস আমাদের দেশের পাঠ্য বইতেও আছে। কিন্তু যাদের সত্য জানার আগ্রহ আছে, তাদের কখনোই দমিয়ে রাখা যায়নি। সত্য ইতিহাস কখনোই চাপা থাকেনি, থাকবেও না। ইতিহাস বিকৃতি করে রাজাকারদের গাড়িতে লাল-সবুজ পতাকা উঠলেও মানুষ সঠিক ইতিহাস জেনেছে, তাইতো শাহবাগে গড়ে উঠেছে প্রজন্ম চত্বর। এই চত্বরের সাথে সংহতি প্রকাশ করা সবাই আজ জানে সত্য ইতিহাস। আর জানে বলেই বলছি, পাকিস্তানের বর্বরতার ক্ষমা আমরা চাই না।

পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর চালানো অত্যাচার-নির্যাতনের কথা  বাংলাদেশের আনুষ্ঠানিক ক্ষমা নামক নাটকের পরেও কেউ কি পারবে পাকিস্তানকে বন্ধু বলে স্বীকার করতে?

পাকিস্তানীদের সাথে ভ্রাতৃপ্রতীম সম্পর্ক গড়তে? পাকিস্তানের ঘৃণ্য কাজের ক্ষমা হতে পারে না, হবেও না। আর আমরাও এই প্রজন্মের কেউই ওদের আসলে কখনোই ক্ষমা করতে পারব না। এসব নাটকীয় ক্ষমা চেয়ে পরদিন থেকে আমরা ভাই-ভাই হয়ে যাব তা কখনোই হবার নয়, কখনোই নয়। পাকিস্তানের সাথে কূটনৈতিক সম্পর্ক ব্যতিরেকে কোনও রকম নৈকট্য আমরা চাই না।
zinia-zahid-sm20
জিনিয়া জাহিদ: বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক, অর্থনীতিবিদ, গবেষক, কলামিস্ট এবং ব্লগার,

বাংলাদেশ সময়: ১৩৪০ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ১৯, ২০১৩

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।