ঢাকা, সোমবার, ৯ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৫ নভেম্বর ২০২৪, ২৩ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

মুক্তমত

শাহবাগ ও বিএনপি’র রাজনীতি প্রসঙ্গে

সৌভিক করিম | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৫৫৪ ঘণ্টা, মার্চ ১১, ২০১৩
শাহবাগ ও বিএনপি’র রাজনীতি প্রসঙ্গে

স্বাধীনতার পরে বাংলাদেশে রাজনীতির দুটি ধারা- আওয়ামী লীগ এবং অ্যান্টি আওয়ামী লীগ। বিএনপির রাজনৈতিক ভিত্তির উৎস অনুসন্ধান করলে অনেক প্রশ্ন হাজির হয়।

আর সেসব প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গেলে বিএনপিকে জামায়াতের রাজনীতির একটা সুশীল প্রদক্ষেপ, একটা সংহত ছায়া বলেই সন্দেহ হয়।

আওয়ামী লীগের জন্ম থেকে বিকাশের প্রতি পর্যায়েই তার সবচেয়ে বড় সমালোচনা হচ্ছে যে, তারা ভারতপন্থী, তারা ভারত রাষ্ট্রের স্বার্থ রক্ষা করে। এ সমালোচনা অনেকগুলো প্রশ্ন সামনে নিয়ে আসে। পাকিস্তান থেকে আলাদা হয়ে বাংলাদেশের জন্ম হওয়া কি শুধুই একটা রাজনৈতিক সংঘাতের ফল? অর্থনৈতিক শোষণের বিরুদ্ধতা? অর্থনৈতিক শোষণকে অনেকভাবে সামাল দেওয়া গেলেও পাকিস্তানের সঙ্গে থেকে সাংস্কৃতিক প্রশ্নগুলোর বেসামাল হওয়াটা অনিবার্য ছিল। এর মধ্যে ভাষা আর জাতীয়তার প্রশ্ন অন্যতম। তাই একাত্তরও অনিবার্য ছিল। ধর্ম এক হলেই যে একসঙ্গে থাকা যায় না, ভাষা আর জাতীয়তার প্রশ্ন যে মোকাবিলা করতেই হবে সেটা মুক্তিযুদ্ধ আমাদের বুঝিয়ে দেয়। মুসলমানিত্ব দিয়ে আমরা এক ছিলাম। বাঙালিত্ব দিয়ে আলাদা হই।
 
তাই ১৯৭১ ধর্ম আর বাঙালিত্বের মধ্যে একটা ফয়সালা করে। সে সময় স্লোগান হয় ‘ধর্ম যার যার, দেশ সবার’। আর এ স্লোগানই নিশ্চিত করে যে, বিভিন্ন ধর্মের লোকেরাও একই দেশে ভালোবেসে থাকতে পারে। তাই বাঙালি জাতিগোষ্ঠীর স্বাধীন ভূখণ্ড প্রতিষ্ঠার লড়াইয়ের স্বীকৃতি দিয়েও বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠী এ যুদ্ধে ছিল। ধর্ম আর বাঙালিত্বের ফয়সালা যারা করতে পেরেছিল, তারা হচ্ছে আওয়ামী লীগ। আর যারা করতে পারেনি তারা হচ্ছে- জামায়াত। এ ভুল আর ব্যর্থ রাজনীতির কাণ্ডারি জামায়াত স্বাভাবিকভাবেই তাই পাকিস্তান চেয়েছিল। তাই তারা বাংলাদেশের স্বাধীনতা বিরোধী, মুক্তিযুদ্ধ বিরোধী।
 
দুই.
এখানে অনেকগুলো বিষয় বিবেচনা জরুরি। প্রথমত, যে দলটা সঠিক রাজনৈতিক দিশা নিয়ে জনগণের আশা আকাঙ্ক্ষা পূরণের ডাক দিতে পারে যথার্থভাবে, জনগণের পালস বুঝতে পারে, জনগণ তার পেছনেই দাঁড়ায় অজস্র সমালোচনা সত্ত্বেও। তাই আওয়ামী রাজনীতির সমালোচক, বিরোধীরাও তার নেতৃত্ব মেনেই যুদ্ধে গেছে। তারা তখন বলেনি যে ‘আওয়ামী লীগরে দেখতারি না, যুদ্ধে যাইবাম না’।
 
দ্বিতীয়ত, ভারত রাষ্ট্রের অবস্থান তার নিজ স্বার্থেই বাংলাদেশের জন্য জরুরি ছিল। ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থা এবং ভারত রাষ্ট্র বাংলাদেশের স্বাধীনতার পক্ষে ছিল। কষ্টকল্পনায় এ অবস্থানকে তাদের উপনিবেশিকরণের সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনার অংশ হিসেবেও যদি দেখা হয় তবু জরুরি প্রশ্নগুলো হাজির হয়। ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থা এবং ভারত রাষ্ট্রের এই আকাঙ্ক্ষার সঙ্গে কি মুক্তিকামী তৎকালীন বাংলাদেশের মানুষের আকাঙ্ক্ষার কোনো সংঘাত ছিল? যারা মনে করে ‘ছিল’ তাদের একটা বড় অংশ তাদের ভুল রাজনীতির ফলাফলে ঝরে গেছে বহু আগেই। বাংলাদেশের জন্ম এটা মোটা দাগে প্রমাণ করে যে ‘ছিল না’।
 
পাকিস্তানকে ত্যাগ করার প্রণোদনা হিসেবে যেই চেতনা আমাদের ভেতরে কাজ করেছিল সেটাই মুক্তিযুদ্ধের চেতনা। ফলে খুব স্বাভাবিকভাবেই তার ডাক ছিল ‘ধর্ম যার যার, দেশ সবার’। তার আহবান ছিল অসাম্প্রদায়িক দেশ গড়ার। সেই চেতনার ভিত্তির ওপর বাংলাদেশ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হয়। কিন্তু এর বিপরীত দিকটিও আছে। যারা এ চেতনার বিরোধী, যারা পাকিস্তান চেয়েছিল, তারা এবং তাদের রাজনীতি তো নির্মূল হয়নি। যারা আদর্শিক এবং সহিংসভাবে পাকিস্তান চেয়েছিল তাদের তো স্বাধীন বাংলাদেশে প্রতিষ্ঠা পাওয়ার কথা নয়। ‘সংগ্রাম’সহ অন্যান্য পত্রিকা আর দলিলে থরে থরে সাজানো তাদের মতাদর্শ থেকে আমরা জানি যে, তারা এটাকে ভারতের ষড়যন্ত্র, হিন্দুদের চক্রান্ত বলে আখ্যায়িত করেছিল। তারা রাজনৈতিক নীতি ও পদ্ধতির দিক থেকে এখনও ৭১ পূর্ববর্তী বাংলাদেশেই আছে। (যার দৃষ্টান্ত অস্পষ্টভাবে গত ৪০ বছরে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকলেও শাহবাগ সেটাকে একদম দৃশ্যমান, স্পষ্ট, জ্বলজ্বলে করে দিয়েছে। ) কিন্তু বাংলাদেশ তো ৭১ পূর্ববর্তী অবস্থায় নেই। এখন আমাদের একটা রাষ্ট্র আছে যার নাম ‘পাকিস্তান’ না। যারা আজকে দাবি করছে এটা সরকারি আন্দোলন, যাদের মনোবাসনা আজকে শাহবাগ আক্রান্ত হোক তাদের একটা অংশ সেটা ভুলে গেছে। শাহবাগ রাষ্ট্র উচ্ছেদের ডাক দেয় নাই, বরং রাষ্ট্রকে আরও মজবুত করার ডাক দিয়েছে। যারা রাষ্ট্র উচ্ছেদ করতে চেয়েছে বা চায় শাহবাগ আদর্শিক, চেতনাগত এবং প্রাতিষ্ঠানিকভাবে তাদের উচ্ছেদ করতে চায়।
 
ইতিহাসের এই মীমাংসা যদি আরও আগেই হতো তাহলে এখন যেটাকে বিভাজন বলা হচ্ছে, সেটা আগেই হতো। এ বিভাজন অনিবার্য ছিল। যারা এর অনিবার্যতাকে অস্বীকার করে তারা আসলে এই বিভাজনকেই স্বীকার করে না। এই মীমাংসা হয়ে যাওয়া উচিত ছিল। আগেই বলেছি, আওয়ামী লীগ-এর জন্ম থেকে বিকাশের প্রতি পর্যায়েই তার সবচেয়ে বড় আদর্শিক সমালোচনা হচ্ছে যে, তারা ভারতপন্থী, তারা ভারত রাষ্ট্রের স্বার্থ রক্ষা করে। ফলে অ্যান্টি আওয়ামী লীগ ধারার সবচে বড় হাতিয়ার হওয়ার কথা অবশ্যই ভারতবিরোধিতা। বিএনপি সেই ধারার গণতান্ত্রিক কাণ্ডারী। সেই জায়গা থেকে জামায়াতকেও সে পাশে পাওয়ার অধিকার রাখে। কিন্তু ভারত বিরোধিতার মুলে একটা পাকিস্তান চেতনার ইন্ধন আছে, যার নাম ধর্ম। বিএনপি ‘দেশ ভারতের দখলে চলে যাচ্ছে’ এই ডাক দিতে পারলে স্বাভাবিকভাবেই একটা বিরাট অংশের সমর্থন পায়। আর অসাম্প্রদায়িকতা, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা, জঙ্গিবাদ-মৌলবাদ বিরোধিতার ডাক দিতে পারলে আওয়ামী লীগ সেটা পায়।
 
তিন.
আওয়ামী লীগ ধর্ম এবং বাঙালিত্ব প্রশ্ন ফয়সালা করে মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্ব দিয়েছে। তারা নিজেদের মুক্তিযুদ্ধের চ্যাম্পিয়ন দাবি করে এবং এটাসহ আরও নানা কারণে জন্মের পর থেকেই ফ্যাসিবাদী চেতনায় নিমজ্জিত। পরিবারতন্ত্র, লুটেরাতন্ত্র, সাম্রাজ্জ্যবাদেরর দাসত্বকারী অর্থনীতি ও রাজনীতি, ভারত রাষ্ট্রের স্বার্থ রক্ষা এবং ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থার সঙ্গে সম্পর্ক ইত্যাদি বিষয় আওয়ামী লীগের সমালোচনা হিসেবে পরিচিত।

অসাম্প্রদায়িকতা, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা আর জঙ্গিবাদ-মৌলবাদ বিরোধিতার ডাক দিলেও নিজেদের সুবিধার জন্য ধর্মের রাজনৈতিক ব্যবহারে তারা অতি পারঙ্গম। মস্কোপন্থী বামপন্থীরা সাধারণত তাদের সমর্থন করে।
 
বিএনপি ধর্ম এবং বাঙালিত্ব প্রশ্ন এখনও ফয়সালা করতে পারেনি। এ প্রশ্ন যতদিন অমীমাংসিত থাকে ততদিন তাদের লাভ। মুক্তিযুদ্ধের চেতনার ধারকত্ব দিয়ে তারা জামায়াত থেকে আলাদা হয় বলে তাদের একটা সমর্থক গোষ্ঠী মনে করে। সেই গোষ্ঠী ভারত রাষ্ট্রের আধিপত্যের বিরোধী এবং অসাম্প্রদায়িক। তারা ভারত রাষ্ট্রের বিরোধিতা মূলত অর্থনৈতিক এবং সাংস্কৃতিক কারণে করে থাকে, ধর্মীয় কারণে না। অর্থাৎ এই কারণে করে না যে, ভারতকে তারা হিন্দুত্ববাদী রাষ্ট্র বলে মনে করে বা ভারতের বেশির ভাগ মানুষ হিন্দু ধর্মের অধিকারী। চীনপন্থী বামপন্থীদের একটা অংশের সমর্থন এই গোষ্ঠীর সঙ্গে। দ্বিতীয় ধারার সমর্থক গোষ্ঠীর কাছে অর্থনৈতিক এবং সাংস্কৃতিক কারণ গৌণ, ধর্মীয় কারণই মুখ্য। অর্থাৎ, তাদের বিরোধিতার একটা বড় জায়গা হচ্ছে যে ভারত হিন্দুত্ববাদী রাষ্ট্র বা ভারতের বেশির ভাগ মানুষ হিন্দু ধর্মের অধিকারী। তারা রাষ্ট্র ও জনগণের পার্থক্য করতে অসমর্থ। তাদের কাছে রাষ্ট্র আর জনগণ একাকার হয়ে থাকে। পরিবারতন্ত্র, লুটেরাতন্ত্র , সাম্রাজ্যবাদের দাসত্বকারী অর্থনীতি ও রাজনীতি, চেতনাগতভাবে পাকিস্তান পন্থা এবং মধ্যপ্রাচ্যসহ পাকিস্তানি, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রীয় গোয়েন্দা সংস্থার সঙ্গে সম্পর্ক ইত্যাদি বিষয় বিএনপি’র সমালোচনা হিসেবে পরিচিত।
 
লক্ষ্য করার বিষয় হচ্ছে, বিএনপির ভারত বিরোধিতা তারা যখন বিরোধী দলে থাকে, তখনই উজ্জ্বল থাকে। সরকারি দল হিসেবে ভারতীয় আধিপত্য মোকাবিলায় তাদের কোনো আগ্রহ দেখা যায় না। ভারতীয় পুঁজির প্রতি তাদের আনুগত্য (সরকারি এবং বিরোধীদল উভয় অবস্থাতেই) আওয়ামী লীগের চাইতে কোনো অংশেই কম থাকে না। তাহলে তাদের এই ভারত বিরোধিতার অবলম্বন কি? বিএনপি পন্থার ‘দেশ ভারত হয়ে যাচ্ছে, ভারত ঠেকাও’ এই রাজনৈতিক লাইন কোনো ধরনেরই ভারতীয় অর্থনৈতিক আধিপত্য প্রতিরোধ করে না। তাহলে কোন ধরনের আধিপত্য তারা প্রতিরোধ করে? ষড়যন্ত্র তত্ত্বের নানা প্রচারণা বাদ দিলে দেখা যায়, কোনো ধরনের ভারতীয় আধিপত্যই তারা প্রকৃতপক্ষে প্রতিরোধ করে না। কিন্তু তারা জনগণের ভারত বিরোধিতার যে ধর্মীয় প্রণোদনা, সেটাকে তৈরি করে, বিকশিত করে এবং ব্যবহার করে।

তাই, পূর্বে উল্লেখিত তাদের ২ ধরনের সমর্থক গোষ্ঠীর ভেতরে ২য় ধরনের গোষ্ঠী সংখ্যায় অনেক ভারি। কিন্তু এই ধর্মীয় ইন্ধন আসলে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার বিপরীতে পাকিস্তানের চেতনাকেই প্রশ্রয় দেয়। বিএনপি যেহেতু একটা গণতান্ত্রিক দল তাই তারা রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে কখনো ধর্মকে সরাসরি দাঁড় করায় না। তারা রাষ্ট্র মেনেই ছদ্ম ভারত বিরোধিতার ইন্ধন হিসেবে ধর্মকে ব্যবহার করে। কিন্তু রাষ্ট্র মানার অর্থ মুক্তিযুদ্ধের চেতনা মেনে নেওয়া, যেই চেতনা বলে ‘ধর্ম যার যার, দেশ সবার’, যেই চেতনা ধর্মের উদ্দেশ্যমূলক রাজনৈতিক ব্যবহারের বিরোধী।

তাই বাংলাদেশ রাষ্ট্রকে, তার জন্মকালীন সংবিধান আর মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে মেনে নিলে আসলে ধর্ম এবং বাঙালিত্ব প্রশ্নের ফয়সালা করে আসতে হবে। আর এটা ফয়সালা করে ফেললে আসলে বিএনপির একধরনের রাজনৈতিক পরাজয় হয়, তার রাজনীতি একভাবে বৈধতা লুপ্ত হয়। তাহলে ছদ্ম ভারত বিরোধিতার ধর্মীয় ইন্ধনকে তার বাতিল করতে হয়। তখন সে কী নিয়ে ভারত বিরোধিতা করবে? ভারতীয় অর্থনৈতিক, সহি-সাংস্কৃতিক আধিপত্যের বিরোধিতা করার তার তো কোনো ইচ্ছে নেই। তখন আসলে আওয়ামী রাজনীতির সঙ্গে তার রাজনীতির ছদ্ম পার্থক্য আর ছদ্ম থাকবে না, প্রকাশিত হবে এবং পর্যায়ক্রমে লুপ্ত হবে।
      
চার.
তাই জামায়াতকে বিএনপি’র নানা কারণেই প্রয়োজন। ধর্ম এবং বাঙালিত্ব প্রশ্ন যতদিন অমীমাংসিত থাকে ততদিনই প্রয়োজন। আর এই প্রশ্নের মীমাংসা জামায়াতকে অন্তত আদর্শিকভাবে দ্বিতীয়বারের মতো পরাজিত করবে। অন্যদিকে তৈরি করবে বিএনপিতে অস্তিত্বের সংকট। বিএনপি জামায়াতকে দেয় তার গণভিত্তি আর জামায়াত-বিএনপিকে দেয় তার শক্তিশালী অর্থনৈতিক ভিত্তি এবং প্রশিক্ষিত পেশীশক্তি। ছদ্ম ভারত বিরোধিতা আর ধর্ম বেচার দিক থেকে তারা ধর্মভাই। একাত্তরে একবার ধর্ম এবং বাঙালিত্ব প্রশ্নের মীমাংসা হয়েছিল। আবার করতে হচ্ছে, কারণ তারা নিজেদের স্বার্থেই এর পরিপূর্ণ মীমাংসা চায় নাই। বিএনপি আর এরশাদের এ মীমাংসা চাওয়ার কোনো কারণ নেই। পাশাপাশি আওয়ামী লীগও চায়নি নানা কারণে। আওয়ামী লীগের অস্তিত্ব যেমন বিএনপি’র আওয়ামী বিরোধী রাজনীতির ধারা বজায় রাখার জন্য জরুরি, তেমনি জামায়াতের অস্তিত্বও আওয়ামী লীগের জামায়াত বিরোধী রাজনৈতিক ধারা বজায় রাখার জন্য জরুরি। নইলে আওয়ামী লীগ কার বিরুদ্ধে অসাম্প্রদায়িকতা, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা আর জঙ্গিবাদ-মৌলবাদ বিরোধিতার ডাক দেবে? আর লুটপাটের ভাগ-বাটোয়ারা, ভোটের হিসাব-নিকাশ তো আছেই। দালালি, লুটপাট, বিশ্বাসঘাতকতা, ভণ্ডামি, জননিপীড়ক আর গণবিরোধী চরিত্রের দিক থেকে আওয়ামী লীগ, বিএনপি, জামায়াত সবাই ধর্ম ভাইবোন।
 
পাঁচ.
বাংলাদেশের বাঙালিরা মুসলমান, হিন্দু, বৌদ্ধ , খ্রিস্টান। চাকমা, মগ, মুরং, মান্দি সহ অন্যান্য পাহাড়ি এবং আদিবাসী জাতিগোষ্ঠী সবাই বাংলাদেশি। এটা তাদের রাষ্ট্রীয় পরিচয়। খেয়াল করা দরকার যে, ধর্মের সঙ্গে বাঙালিত্বের কোনো সত্যিকার ঝগড়া নেই। এ ঝগড়া যারা তৈরির চেষ্টা করেছিল, সেই পাকিস্তানকে ত্যাগ করেই বাংলাদেশ জন্মেছে। বিএনপি যদি তাদের ঐতিহাসিক রাজনৈতিক লাইনের ওপরেই ভবিষ্যতেও ভরসা বজায় রাখতে চায়, তাহলে তাদের ভরসা করতে হবে এই ঝগড়া তৈরির দক্ষতার ওপরে। বারবার তাদের এই ঝগড়া তৈরি করে যেতে হবে, একে টিকিয়ে রাখতে হবে। নিতান্তই কৌশল হিসেবে প্রয়োজনমাফিক তারা রাষ্ট্রের ছদ্ম প্রতিপক্ষ হিসেবে ধর্মকে দাঁড় করাবে। এ ক্ষেত্রে আত্মঘাতী আওয়ামী লীগের মৌসুমি সহায়তাও তারা পাবে।         
 
আওয়ামী লীগ যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করতে চায়নি। তাদের সর্বোচ্চ শাস্তি দিতে চায়নি। এতে তাদের খুব বেশি লাভ নেই। রাজাকারদের বিচার করবে, এই ইস্তেহার প্রদর্শন করে তারা নির্বাচিত হয়। কিন্তু এই মুলা ঝুলিয়ে তাদের আরও কয়েক টার্মের পরিকল্পনা থাকার কথা। আওয়ামী লীগ তার শেষ সময়ে এসে বিচারের নাটক করে জনগণ এবং জামায়াত দুই পক্ষকেই খুশি রাখতে চেয়েছিল। তাহলে পুনর্বার জামায়াতকে হাতে রাখা যায় এবং সুবিধা নেওয়া যায়। যা তারা বহু বছর ধরে করে আসছে। জামায়াতের সঙ্গে আওয়ামী লীগের আঁতাতের সম্ভাবনা স্পষ্ট হচ্ছিল। রায়ের আগে পুলিশের মার খাওয়া থেকে শুরু করে বাচ্চুর দেশ ত্যাগ পরবর্তী ফাঁসির রায় এবং কাদের মোল্লার যাবজ্জীবন কারাদণ্ড শীর্ষক রায়ের মাধ্যমে। শাহবাগ সে হিসেব পাল্টে দেয়। শাহবাগে লাখ লাখ মানুষের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ এ আঁতাতকে সন্দেহ করেই হয়। তারা সন্দিহান হয়ে হাজারে হাজারে লাখে লাখে সমাবেশে উপস্থিত হয়। বিএনপি’র এতে বিভ্রান্তি বাড়তেই থাকে। তারা একের পর এক স্ববিরোধী বক্তব্য দিতে থাকে। বিএনপি আসলে একভাবে শাহবাগে আসতে পারে না। কিন্তু এর দায় শাহবাগের তো নাই-ই, এমনকি আওয়ামী লীগেরও না। এ দায় তাদের ভুল রাজনীতির। ইতিহাসের এ মীমাংসার আবেদন আওয়ামী লীগের কাছে করার কারণই বেশি।
 
বিএনপি যদি নিজেকে প্রতিপক্ষ মনে করে, সেটার কারণও এই যে, ইতিহাস কে অমীমাংসিত রাখার দায় তাদের অনেক বেশি, লাভও তাদের অনেক বেশি। যতদিন এই ইতিহাস অমীমাংসিত থাকে, ততদিনই আসলে তাদের রাজনীতি জীবিত থাকে। এখন বিএনপি যদি শাহবাগকে আওয়ামী লীগের পকেটস্থ আন্দোলন মনে করে, এটাও বিএনপির’ই দায়। বিএনপি’র রাজনৈতিক দৈন্য আর অপরিণামদর্শিতা শাহবাগ প্রকট করছে। তাদের প্রাক্তন চৈনিক বাম মস্তিষ্করা ক্রমাগত হাস্যরস উদ্‌গিরণ করে যাচ্ছেন। শাহবাগ তো বিএনপিকে আলিঙ্গন করতে চেয়েছিল, তারা তাদের ভুল রাজনীতির মাশুল হিসেবে সেই ডাকে সাড়া দিতে ব্যর্থ হয়েছে। তারা ধর্ম আর জাতীয়তার প্রশ্ন মোকাবিলা করতে সমর্থ হয়নি। শাহবাগের বিরোধিতা না করলে তাদের রাজনীতি থাকে না এটাতো তারাই রাজনৈতিকভাবে প্রতিষ্ঠা করেছে। জামায়াত দেশব্যাপী যে তাণ্ডব চালাচ্ছে আওয়ামী লীগের তা যথাযথভাবে সামাল দিতে না পারার অন্যতম কারণ তার সোনার ছেলেমেয়েদের, নেতাদের মাঠপর্যায়ে সংগঠিত থাকতে না পারা, জনবিচ্ছিন্নতা। এর মূল্য আওয়ামী লীগকে দিতে হবে। কিন্তু জামায়াতের প্রশিক্ষিত পেশিশক্তির ওপর ভরসা করেই যদি বিএনপি নিস্তার চায়, এর মূল্য বিএনপিকে আরও অনেক বেশি দিতে হবে।
 
ছয়.
শাহবাগকে আওয়ামী লীগের দিকে ঠেলে দেওয়া ছাড়া এখন হয়ত কোনো উপায় নেই বিএনপির। এখন তারা যা করছে তা উপায়হীন, অসহায় হয়ে করছে বলে ধরে নিতে পারি। এটা আপাতত সত্যিও। তাদের এখন নিজেদের রাজনৈতিক লাইন পাল্টানো ছাড়া কোনো উপায় নাই। সাময়িকভাবে হঠকারিতা করে তারা হয়ত টিকতে পারে। দীর্ঘযাত্রায় তারা টিকতে ব্যর্থ হবে সর্বাংশে।

এও সত্যি যে, ধর্মকে কৌশল হিসেবে ব্যবহার না করে যদি বিএনপি সহি তরিকায় ভারত রাষ্ট্রের অর্থনৈতিক আর সাংস্কৃতিক আধিপত্যের মোকাবিলা করতে সক্ষমই হতো, তাহলে সে আর বিএনপি’ই থাকতো না। সে জনগণের সত্যিকার রাজনৈতিক শক্তির প্রতিনিধিত্বকারী সংগঠন হতো। তার নিয়তও সেটা না, তার শরীরও সেটা না। তাকে ইতিহাসের মীমাংসা করেই এগোতে হবে। ধর্ম এবং বাঙালিত্ব প্রশ্ন ফয়সালা এখনও না করতে পারলে তাদের আর কোনো রাজনৈতিক সম্ভাবনা থাকবে না। বিএনপি’র একটা বড় সমর্থক গোষ্ঠী আছে যারা ধর্ম আর জাতীয়তার প্রশ্ন ফয়সালা করে ফেলেছে। যারা আওয়ামীবিরোধী, যারা রাষ্ট্র আর জনগণের পার্থক্য জানে, যারা ধর্মের ইন্ধন ছাড়াও ভারত রাষ্ট্রের অর্থনৈতিক আর সাংস্কৃতিক আধিপত্যের বিরোধী, তাদেরকে বিএনপি পুরোপুরিভাবে হারাবে। শাহবাগের অগুনতি জনতা, যারা আওয়ামী লীগ সমর্থক না, তাদেরকে ধারণ করতে বিএনপি সর্বতোভাবে ব্যর্থ। প্রতারক আওয়ামী লীগেরও তাদের দীর্ঘদিন ধারণ করতে না পারার সম্ভাবনাই বেশি। বিপুল এ জনতার সাময়িকভাবে রাজনৈতিক উদ্বাস্তুতে পরিণত হওয়ার সম্ভাবনা থাকলেও আরও বেশি সম্ভাবনা থাকবে নতুন রাজনৈতিক শক্তিতে উদ্দীপ্ত হওয়ার।

তবে তার আগ পর্যন্ত এবং বিএনপির সুবুদ্ধি উদয় না হলে, অনেক ক্ষেত্রে পরেও তাদের আওয়ামী লীগের সঙ্গে ঐক্য পোষণ করা ছাড়া কোনো উপায় নেই। উপায়হীন হয়েই বিএনপির বুদ্ধিজীবীরা এখন ভাঁড়ে পরিণত হয়েছে সেটা বোঝা গেলেও যথাযথ উপায় খোঁজার নূন্যতম সৎ চেষ্টাও কেন নাই, সেটা দুর্বোধ্য। কৌশলই যখন নীতি তখন ভুল কৌশল অবলম্বনে সর্বনাশই অনিবার্য নিয়তি। বিএনপি যদি জামায়াতের ওপর ভরসা না করে জনগণের ওপর ভরসা করতে পারতো, তাহলে জনগণকে পাশে পেত। বিএনপি’র কৌশলী নীতিনির্ধারকরা যদি একদিনের জন্যও রঙিন চশমাটা খুলে শাহবাগে যেতেন (অনেক সমর্থকই অবশ্য গোপনে এসেছে, অনেকে প্রকাশ্যেও) তাহলে প্রত্যক্ষ আর অনির্বচনীয় অভিজ্ঞতায় তারা টের পেতেন যে শাহবাগ কোনো ইতিহাসহীন,তাৎক্ষণিকতাতাড়িত তারুণ্যের সাময়িক সমাবেশ না। সহিংসতা, জরুরি অবস্থা, সামরিক শাসন ,ধর্মের গণবিরোধী ব্যবহার শাহবাগকে একটা ঘটনা হিসেবে শান্ত রাখতে পারে, কিন্তু শাহবাগের চেতনা প্রক্রিয়া হিসেবে এবং অতিঅবশ্যই রাজনৈতিক প্রক্রিয়া হিসেবে জারি থাকবে।

সৌভিক করিম: সঙ্গীতজ্ঞ, লেখক ও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক

 

বাংলাদেশ সময়: ১৫২৫ ঘণ্টা, মার্চ ১১, ২১০৩
সম্পাদনা: এম জে ফেরদৌস ও আবু হাসান শাহীন, নিউজরুম এডিটর

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।