ঢাকা, সোমবার, ৯ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৫ নভেম্বর ২০২৪, ২৩ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

মুক্তমত

নব জাগরণ: একটি সময়োপযোগী গণ আন্দোলন

মো. রওশন আলম, অতিথি লেখক | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৮৪০ ঘণ্টা, মার্চ ১২, ২০১৩
নব জাগরণ: একটি সময়োপযোগী গণ আন্দোলন

গত ৫ ফেব্রুয়ারি থেকে শুরু হওয়া মাসাধিক সময় ধরে চলা যে নব জাগরণ চলছে শাহবাগ চত্বরে, সেই জাগরণ মুলতঃ যুদ্ধাপরাধীদের বিচারকে ঘিরে হলেও এটি আমাদের গতানুগতিক ধারার রাজনীতির প্রতি এক ধরণের নীরব চ্যালেঞ্জ বটে। আধুনিক মন মানসিকতায় গড়ে উঠা ১৯৭১ পরবর্তী তরুণ প্রজন্মের এই আন্দোলন অত্যন্ত পরিশীল, অহিংস, শান্তিপ্রিয় ও গতিশীল।

ব্লগারদের উদ্যোগে প্রথমে শুরু হয় এই গণ আন্দোলন। তাতে শরীক হয়েছেন ও সংহতি প্রকাশ করেছেন সারাদেশের বিভিন্ন শ্রেণী-পেশার মানুষ ও তরুণ সমাজ। এখানে না আছে তাঁদের মধ্যে কোনো লিডার হওয়ার স্বপ্ন বা ক্ষমতার লোভ, না আছে জানমালের ধ্বংস সাধনের জন্য হরতাল বা ধর্মঘটের ডাক। যারা এই আন্দোলনের ডাক দিয়েছেন তারা এ যুগেরই সন্তান-যাদের হাতে রয়েছে যোগাযোগ বিনিময়ের জন্য আধুনিক সব মাধ্যমগুলো- যেমন ফেইসবুক, টুইটার, ই-মেইল, স্কাইপি ও অনলাইন ব্লগিং। মুহূর্তের মধ্যেই যারা কানেকটেড হতে পারেন তাদের সুশৃঙ্খল সব বন্ধু-বান্ধব ও প্রিয়জনদের সঙ্গে। তদুপরি রয়েছে আমাদের দেশের উন্মুক্ত গণ মাধ্যমগুলো। এই মাধ্যমগুলোর দ্বারা তারা তাৎক্ষণিক জানতে পারেন তাদের সব অজানা তথ্য যা তারা জানতে চান।

৭১ পরবর্তী এই নতুন প্রজন্ম স্বাধীনতার ইতিহাস সম্পর্কে বেশ সচেতন। গত ৪২ বছরের সময়ের ব্যবধানে তারা জানতে পেরেছে ১৯৭১, স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস কি? স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে কোন কথা বা বাক্যটি বিকৃত আর কোনটি অবিকৃত? তাছাড়া মুক্তিযুদ্ধের পক্ষ ও বিপক্ষ নিয়েও তাঁদের মনে কোনো সংশয় নেই আর শুধু তাই নয়, তারা আরো জেনেছে স্বাধীনতা সংগ্রামে মুক্তিযুদ্ধের স্লোগান কি ছিল? জয়বাংলা যাদের ইতিহাসের স্লোগান সেই স্লোগানকে তারা বিকৃত বা পরিবর্তন দেখতে চায় না আর, আজ সময়ের ব্যবধানে।

তারা দেখেছে যে, গত ৪২ বছরে দেশে সুকৌশলে মানুষের মাঝে কিভাবে বিভাজনের দেয়াল তৈরি করা হয়েছে? শুধু কি তাই? মুক্তিযুদ্ধের বিপক্ষের শক্তিকে কিভাবে মাথা চাড়া দিয়ে উঠার সুযোগ করে দেওয়া হয়েছে? প্রিয় মাতৃভূমিতে ক্ষমতার জন্য দিনের পর দিন হানাহানি ও একে অপরের নামে কুৎসা রটনা কতটা না বিস্তৃত লাভ করেছে! বিভিন্ন সময়ে ক্ষমতার রাজনীতিতে দেশে কত না নৃশংসতাও হয়েছে! তদুপরি ক্যু- পাল্টা ক্যু, হত্যা, ধর্ষণ, হিন্দু সম্প্রদায়ের উপর আক্রমন, রাজনীতির নামে সেচ্ছাচারিতা, মাত্রাতিরিক্ত দুর্নীতি, অপশাসন, নির্লজ্জ দলীয়করণ, লোভনীয় ক্ষমতার জন্য স্বৈরাচার ও ১৯৭১ এর পরাজিত শক্তিদের সঙ্গে আঁতাত ও সরাসরি তাঁদের পক্ষ অবলম্বন তো রয়েছেই।

তাই নতুন প্রজন্মের মধ্যে দীর্ঘদিন ধরে জমে রয়েছে এক ধরণের চাপা ক্ষোভ, হতাশা ও রাজনীতিবিদদের প্রতি এক ধরণের বিশ্বাসের ঘাটতি। তাদের মনে অনেক প্রশ্নও রয়েছে। সবগুলির সমাধান তারা একবারে চায়ও না। তারা জানে যে সবগুলো সমস্যার জন্য সমাধান একসঙ্গে চেয়ে কোনো লাভও হবে না। তাই সবগুলি চাওয়াকে আপাততঃ দমিয়ে রেখে তারা একটি মাত্র দাবিকেই সামনে নিয়ে শাহবাগ চত্বরে এসে মিলিত হয়েছে। তা হচ্ছে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার অর্থাৎ ১৯৭১ সালে যারা বাংলাদেশের সূচনালগ্নে পূর্বপাকিস্তানের বাংলা ভাষাভাষী মানুষের সঙ্গে এক সীমাহীন বিশ্বাস ঘাতকতার মাধ্যমে হত্যা ধর্ষণ সহ নানাবিধ মানবতাবিরোধী অপরাধের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ছিল- সেইসব ঘাতক ও যুদ্ধাপরাধীদের সর্বচ্চ শাস্তি আইনের শাসনের মাধ্যমেই নিশ্চিত করা। আইনের ফাঁক ফোঁকর দিয়ে ৭১ এর পরাজিতরা কোনোভাবেই যেন ছাড়া পেয়ে না যায়! সেজন্য সরকারকে চাপে রাখার জন্য যতটুকু জনমত তৈরি তাদের দরকার ছিল, তারচেয়েও ঢেঁড়গুণ জনমত সৃষ্টি করতে সক্ষম হয়েছে এই নতুন প্রজন্ম।

আর এই জনমত তৈরির মোক্ষম প্রেক্ষাপট সৃষ্টি হল তখনি, যখন যুদ্ধাপরাধীর অপরাধে অভিযুক্ত ও মিরপুরের কসাই নামে খ্যাত কাদের মোল্লার গুরুপাপে লঘুদণ্ড অর্থাৎ যাবৎজীবন হল। অনেকে মনে করল যে, এই রায়ের আড়ালে হয়তো জামায়াতিদের সঙ্গে সরকারের আঁতাতও হয়ে থাকতে পারে।

সে যাই হোক, এর পরের ঘটনাগুলো আমাদের সবারই কমবেশি জানা। ব্লগার রাজীবকে একটা নির্দিষ্ট প্যাটার্নে তাঁর নিজ বাড়ীর সামনে হত্যা করা হল। সেই হত্যাকাণ্ডটিকে ধামাচাপা দিতে জামায়াতপন্থি ঢাকার দু একটি জাতীয় দৈনিক পত্রিকাতে উস্কানি দেওয়া শুরু হয়ে গেল। তারা আস্তিক, নাস্তিক ও আমাদের প্রিয় নবী হজরত মোহাম্মদ (সঃ) কে নিয়ে নানাবিধ কুরুচিপূর্ণ শব্দ লিখে ধর্ম প্রিয় মানুষের মধ্যে এক ধরণের ফিতনা সৃষ্টির চেষ্টায় মত্ত হল। শাহবাগের আন্দোলনকে বিভক্ত করার জন্য সুকৌশলে ধর্ম ও অধর্মের নামে অযাচিতভাবে একটি আবরণ তৈরি করতেও তারা পিছপা ছিলো না। তাঁর পরের ঘটনাগুলো ছিল আরো মর্মস্পর্শী! ২৮শে ফেব্রুয়ারি আরেক রাজাকার দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর ফাঁসির রায় ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গে সারাদেশে এক হত্যার তাণ্ডবলীলা বয়ে গেল। এখনো এইসব হত্যাকাণ্ড থেমে নেই। তদুপরি হিন্দু সম্প্রদায়ের উপরে অসভ্য আক্রমন চলতে থাকল। ৬ই মার্চ সংসদে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর বক্তব্য অনুযায়ী এসব ঘটনায় এ পর্যন্ত প্রায় ৬৭ জনের প্রাণহানি ঘটেছে (২৮শে ফেব্রুয়ারি থেকে ৪ মার্চ পর্যন্ত)। যদিও বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যমে প্রায় আশিরও অধিক মানুষের প্রানহানি ঘটেছে বলে প্রকাশিত হয়েছে। শিশু, পুলিশ থেকে শুরু করে নিরীহ মানুষ, পথচারী এবং জামায়াত শিবিরের ক্যাডাররাও তাতে বাদ যায় নি। এ যেন এক তাণ্ডবলীলা, বীভৎস মৃত্যুর হলিখেলা! সভ্য পৃথিবীতে অসভ্য আচরণ। উপরন্ত টেলিভিশনের চ্যানেল গুলোতে যখন ট্রেনের বগী ও বাস সহ জ্বালাও পোড়াওয়ের ধ্বংসাত্মক দৃশ্য দেখি গা শিহরে উঠে! দেশ বিদেশের সব বাংলাদেশি নাগরিকই এইসব তাণ্ডবে ভীষণ উদ্বিগ্ন ও উৎকণ্ঠিত।

অথচ গত প্রায় মাসব্যাপী ধরে শাহবাগে অবিরাম গতিতে চলা এই গণ আন্দোলন ছিল একেবারেই অহিংস। হরতাল বা ধর্মঘট বা জানমালের ক্ষতিসাধন ব্যতীত যে একটা গণ জাগরণ ও আন্দোলন তৈরি করা যায় এবং সেই আন্দোলনে সর্বস্তরের মানুষের নিকট থেকে স্বতঃস্ফূর্ত সাড়া পাওয়া যায়, ব্লগারদের এই গণ আন্দোলনই হচ্ছে তার একটি উৎকৃষ্ট উদাহরণ।

আমাদের দেশের পলিটিশিয়ানদের হয়তো এখন সময় এসেছে – ব্লগারদের এই আন্দোলন থেকে শিক্ষা গ্রহন করার- ধ্বংসাত্মক রাজনীতির অপকৌশল পরিহার করার।

ফিরে আসি মূল কথায়। যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিতে নতুন প্রজন্মের এই কণ্ঠস্বরকে উপেক্ষা করার কি কোনো সুযোগ রয়েছে? নিশ্চয় নয়। কারণ এই দাবিটি তো এখন আর তাদের একার নয়। তাদের সঙ্গে লক্ষ কোটি জনতা একাত্মতা প্রকাশ করেছে। সরকারেরও এই বিচার প্রক্রিয়া থেকে সরে আসার আর কোনো উপায়ই নেই। তদুপরি সামনে রয়েছে জাতীয় নির্বাচন। ভোটের হিসাব নিকাশের জটিল অংক। সবাই চায় ক্ষমতায় যেতে। আর এই ভোটের হিসাব নিকাশে জামায়াতের যে ৪ বা ৫% ভোট রয়েছে, সেই ভোটগুলো যেমন বিএনপি মাথা থেকে বাদ দিয়ে জামায়াতকে পুরাপুরি ত্যাগ করতে পাড়ছে না; তেমনি আওয়ামীলীগের জন্য এখন এই যুদ্ধাপরাধীদের বিচার না করে ফিরে আসাটাও হবে দায়। কারণ তাতে আওয়ামীলীগ শুধু যে নতুন প্রজন্মের ভোটগুলো থেকেই বঞ্চিত হবার সম্ভাবনা রয়েছে তা নয়, বরং মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষের ভোটাররাও তাদের ওপর থেকে মুখ ফিরিয়ে নেবার সম্ভাবনা রয়েছে। বিএনপির জন্য একই শংকা রয়েছে যদি শাহবাগের এই গণ আন্দোলন দীর্ঘায়িত হয়। সুতরাং সামনের জাতীয় নির্বাচনে এই আন্দোলনের যে একটা সমূহ প্রভাব পড়বে তা অনেকেই মনে করেন।

আর তাই, তরুণ প্রজন্মের উদ্যোগের এই আন্দোলনকে বিএনপি ও আওয়ামীলীগ যদি খাটো করে দেখেন বা অবমূল্যায়ন করেন, তাহলে তার খেসারত হয়তো তাঁদেরকে দিতে হতে পারে পরবর্তী জাতীয় নির্বাচনে। কারণ, এই লক্ষ লক্ষ তরুণ- তরুণীরাই তো আজকের ভোটার। যাদের ভোট ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য দুটি দলেরই দরকার হবে। তাছাড়া এই প্রজন্ম অনেক স্বপ্নও দেখেন একটি সুন্দর বাংলাদেশ গড়ার- সুস্থ, সুন্দর ও পরিশীল সমাজ গড়ার মাধ্যমে নিজেদের উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ গড়ার। তারা অনেকেই ছাত্র ও সমাজ গড়ার বিভিন্ন পেশার সঙ্গে জড়িত। তাদের চাওয়া, আবেগ ও যৌক্তিক দাবিকে উপেক্ষা করার কি কোনো অবকাশ আছে? তারা যেমন যুদ্ধাপরাধীদের বিচার চায়, তেমনি হানাহানির রাজনীতির চক্র থেকেও মুক্তি পেতে চায়। তাই অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ গড়ার ও একাত্তরের চেতনা ফিরে আনার জন্য তারা আজকে যে সোচ্চার হয়েছেন শাহবাগ চত্বরে এসে, তা একটি সময় উপযোগী দাবি বৈ কি!

লেখক: যুক্তরাষ্ট্রের ওহাইও স্টেটে একটি ইন্ডাস্ট্রিতে কর্মরত

বাংলাদেশ সময় ০৮৩৪ ঘণ্টা, মার্চ ১২, ২০১৩

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।