ঢাকা, সোমবার, ৯ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৫ নভেম্বর ২০২৪, ২৩ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

মুক্তমত

রাজাকারের বচন

সালেক খোকন | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৭৪১ ঘণ্টা, মার্চ ১৮, ২০১৩
রাজাকারের বচন

একাত্তরে মানবতাবিরোধী অপরাধীদের বিচার চলছে। ইতোমধ্যে রায় ঘোষণা করা হয়েছে তিনজনের।

কাদের মোল্লার রায় ঘোষণার পর তিনি ভি চিহৃ দেখিয়ে একধরণের সন্তুষ্টি প্রকাশ করেন। ফলে রাজপথে নেমে আসে তরুণ প্রজন্ম। ব্লগার ও অনলাইন অ্যাকটিভিস্টদের একটি দলের নেতৃত্বে শাহবাগের প্রজন্ম চত্বরে জড় হয় লাখো মানুষ। যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবীতে গান, বক্তৃতা, স্মৃতিচারণ আর স্লোগানে স্লোগানে তৈরি হতে থাকে গণজাগরণ। যুদ্ধাপরাধীদের  সর্বোচ্চ শাস্তি, জামায়াত-শিবির নিষিদ্ধসহ ৬দফা দাবীতে তারা গড়ে তুলে অহিংস এ আন্দোলন। গণজাগরণ মঞ্চের এই আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ে সারাদেশে।

আমরা দেখলাম সাঈদীর রায় ঘোষণার পর সারাদেশে জামায়াত-শিবির নগ্ন তান্ডব্য চালাল। নিহত হল পুলিশসহ ৭০ জন। পতাকার অবমাননা, শহীদ মিনার ভাঙ্গা, হিন্দুদের ঘরবাড়ি, মন্দির ও উপাসনালয়, যানবাহন, ট্রেন, বিদ্যুৎকেন্দ্র ও সরকারি অফিস প্রকাশ্যে পুড়িয়ে দেয়া হল। দেশের নিরীহ ধর্মপ্রাণ মানুষকে উসকে দিতে তারা ব্যবহার করল ধর্মটাকে। অবলীলায় তারা একজনকে নাস্তিক ও মুরতাদ বলছে। চাঁদে যুদ্ধাপরাধীর চেহারা দেখা যাচ্ছে বলেও মিথ্যাচার করছে। বিরোধীদলের ছায়াতলে আস্তিক ও নাস্তিকের ধোয়া তুলে তারা যুদ্ধাপরাধীদের বিচার থেকে মানুষের দৃষ্টিটাকে অন্যদিকে সরিয়ে নেওয়ার প্রাণপণ চেষ্টা চালাচ্ছে।

জামায়াতে ইসলামের এই কৌশল অতি পুরোন। ধর্মকে রাজনৈতিক স্বার্থে ব্যবহার করতে গিয়ে সাম্প্রদায়িক বিভেদ সৃষ্টি করে তারা পাকিস্তানে কাদিয়ানী দাঙ্গার সময় নির্বিচারে নারী, শিশু, বৃদ্ধসহ শত-সহস্র নিরীহ মানুষকে হত্যা করেছে। ধর্মের দোহাই দিয়ে ১৯৭১ এ তারা পাকবাহিনীর নৃশংস গণহত্যাযজ্ঞে সক্রিয়ভাবে সহায়তা করেছে এবং নিজেরাও হত্যা, ধর্ষণ, গৃহে অগ্নিসংযোগ, লুটতরাজের মতো দুস্কর্মে অংশ নিয়েছে। যার প্রমাণ মিলে সে সময়কার বিভিন্ন সংবাদ পত্রিকায় প্রকাশিত খবর, বিবৃতি ও জামায়াত নেতাদের ভাষণ থেকে।

গোলাম আযমের বচন
rajakar-golam-azom১৯৭১ সালে গোলাম আযম ছিলেন তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান জামায়াতে ইসলামীর আমির। মুক্তিযুদ্ধের পুরো সময়টাতেই তিনি বাংলাদেশের স্বাধীনতা, জনগণ ও মুক্তিযোদ্ধাদের বিরুদ্ধে সম্ভাব্য সবধরণের কর্মকান্ড পরিচালনা করেছেন।

১ সেপ্টেম্বর ১৯৭১। করাচীতে জামায়াত অফিসে এক সাংবাদিক সম্মেলনে ভাষণদান কালে পাকিস্তান রক্ষা ও মানুষের জীবনের নিরাপত্তার জন্য পাকিস্তান সেনাবাহিনীর প্রতি গভীর শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করে গোলাম আযম বলেন, ‘কোন ভাল মুসলমানই তথা কথিত ‘বাংলাদেশ আন্দোলনে’র সমর্থক হতে পারে না। তার ভাষায়,‘পূর্ব পাকিস্তানের বিচ্ছিন্নতাবাদীদের (মুক্তিযোদ্ধা) নির্মূল করার জন্য একমনা ও দেশ প্রেমিক লোকেরা একত্রে কাজ করে যাচ্ছে। রাজাকাররা খুবই ভাল কাজ করছে (দৈনিক পাকিস্তান, ২ সেপ্টেম্বর ১৯৭১)।

২৫ সেপ্টেম্বর হোটেল এম্পায়ারে ঢাকা শহর জামাত কর্তৃক প্রাদেশিক শিক্ষ মন্ত্রী জনাব আব্বাস আলী খান ও রাজস্ব মন্ত্রী মওলানা একেএম ইউসুফকে সংবর্ধনা প্রদান করা হয়। সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে গোলাম আযম বলেন, ‘জামাতে ইসলামীর কর্মীরা মুসলিম জাতীয়তাবাদের আদর্শকে বিসর্জন দিয়ে বাঙালী জাতীয়তাবাদকে মেনে নিতে রাজী নয়। ’ তিনি বলেন, ‘জামাতের কর্মীরা শাহাদাৎ বরণ করে পাকিস্তানের দুষমনদের বুঝিয়ে দিয়েছে যে তারা মরতে রাজী তবুও পাকিস্তানকে ভেঙ্গে টুকরো টুকরো করতে রাজী নয় ( দৈনিক পাকিস্তান, ২৬ সেপ্টেম্বর ১৯৭১)।

প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের সঙ্গে ৭০ মিনিট স্থায়ী এক বৈঠক হয় গোলাম আযমের। বৈঠকের পর আয়োজিত এক সাংবাদিক সম্মেলনে তিনি তথাকথিত মুক্তিবাহিনীকে শক্রুবাহিনী রূপে আখ্যায়িত করে বলেন,‘তাহাদিগকে মোকাবিলা করার জন্য রাজাকাররাই যথেষ্ট। ’ এ প্রসঙ্গে রাজাকারদের সংখ্যা বৃদ্ধি করার জন্য তিনি আহ্বান জানান।

১৪ আগষ্ট পাকিস্তানের আজাদী দিবস উপলক্ষে আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে সেনাবাহিনী ও শন্তিকমিটির মধ্যে যোগসূত্র প্রতিষ্ঠার ওপর বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করে জামায়াত নেতা গোলাম আযম বলেন, ‘দেশকে রক্ষার দায়িত্ব সেনাবাহিনীর, তাই মানুষকে বোঝানোর দায়িত্ব শান্তি কমিটির হাতে তুলে দিতে হবে। এছাড়া ঘরে ঘরে যেসব দুশমন রয়েছে তাদেরকে খুঁজে বের করার ওপরও তিনি গুরুত্বআরোপ করেন’(দৈনিক পাকিস্তান ১৬ আগষ্ট ১৯৭১)।

স্বাধীনের পর গোলাম আযম তিন খন্ডের আত্মজীবনীমূলক গ্রন্থ রচনা করেন। ‘জীবনে যা দেখলাম’- নামক এই গ্রন্থে বাংলাদেশের সংগ্রাম, মুক্তিযুদ্ধসহ গুরুত্বপূর্ণ সময়ে তার ও জামায়াতে ইসলামীর অবস্থান তিনি তুলে ধরেছেন। বইটির তৃতীয় খন্ডের ২১১ পৃষ্ঠায় তিনি বলেছেন, ‘পাকিস্তান বিভক্তি ও বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের বিষাদময় কাহিনী। ’ ১৪৪ পৃষ্ঠায় তিনি মুক্তিযুদ্ধের সময় তৎকালীন সামরিক আইন প্রশাসক জেনারেল টিক্কা খানের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে সামরিক বাহিনীকে সহযোগিতার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন বলে স্বীকার করে নেন। মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানি বাহিনীর নানা অপকর্মের সহযোগী রাজাকার বাহিনীকে দেশপ্রেমিক এবং মুক্তিযুদ্ধকে নাশকতামূলক তৎপরতা উল্লেখ করে বইটির ১৫০ পৃষ্ঠায় গোলাম আযম লিখেন, ‘যে রেযাকাররা (রাজাকার) দেশকে নাশকতামূলক তৎপরতা থেকে রক্ষার জন্য জীবন দিচ্ছে তারা কি দেশকে ভালবাসে না? তারা কি জন্মভূমির দুশমন হতে পারে?

১৯৭০ সালের নির্বাচনের সময় আওয়ামী লীগকে ভোট না দেয়ার জন্য জনগনের প্রতি আহ্বান জানাত জামায়াতে ইসলামী। গোলাম আযমের তার গ্রন্থের তৃতীয় খন্ডের ১০৮ পৃষ্ঠায় এ প্রসঙ্গে লিখেছেন, ‘তারা ক্ষমতা পেলে পাকিস্তান থেকে পূর্ব পাকিস্তানকে আলাদা করে ফেলতে পারে। যদি তাই হয় তাহলে আপানারা পাকিস্তানের নির্বাচনে ভোট দেয়ার সুযোগই হয়তো পাবেন না। ’

মতিউর রহমান নিজামীর বচন
মুক্তিযুদ্ধের সময় জামায়াতে ইসলামীর ছাত্র সংগঠন ইসলামী ছাত্রসংঘের (বর্তমানে ইসলামী ছাত্রশিবির) সমগ্র পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সভাপতি ছিলেন মতিউর রহমান নিজামী। তার প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধানে মুক্তিযুদ্ধকে প্রতিহত এবং মুক্তিযোদ্ধাদের নির্মূল করার জন্য আলবদর বাহিনী গঠন করা হয়। তিনি ছিলেন এই বাহিনীর প্রধান। আলবদরের নেতারা বুদ্ধিজীবী হত্যার নীলনকশা প্রণয়ন করে এবং তাদের নির্দেশে ডিসেম্বর মাসে ঢাকাসহ সারা দেশে বহু বুদ্ধিজীবীকে হত্যা করা হয়।

১৪ নভেম্বর ১৯৭১। দৈনিক সংগ্রামে প্রকাশিত হয় নিজামীর লেখা একটি নিবন্ধ। ওই নিবন্ধে তিনি লিখেছেন, ‘আমাদের পরম সৌভাগ্যই বলতে হবে, পাকবাহিনীর সহযোগিতায় এ দেশের ইসলামপ্রিয় তরুণ সমাজ বদর যুদ্ধের স্মৃতিকে সামনে রেখে আলবদর বাহিনী গঠন করেছে। ’

২২ আগষ্ট পাকিস্তান সেনাবাহিনীর দোসর মাওলানা মাদানীর স্মরণ সভায় নিজামী বলেন, ‘পাকিস্তানকে যারা বিচ্ছিন্ন করতে চায় তারা এ দেশ থেকে ইসলামকেই উৎখাত করতে চায়’ ( ২৩ আগষ্ট, দৈনিক সংগ্রাম)। একই পত্রিকায় ৯ সেপ্টেম্বর প্রকাশিত ‘আলবদর’ শীর্ষক একটি লেখায় বলা হয়েছে, ‘আলবদর, একটি নাম! একটি বিস্ময়! আলবদর একটি প্রতিজ্ঞা! যেখানে তথাকথিত মুক্তিবাহিনী, আলবদর সেখানেই। ’

৭ নভেম্বরকে আলবদর দিবস পালন ও আলবদর বাহিনীতে যোগ দেয়ার আহ্বান জানিয়ে ইসলামী ছাত্রসংঘের নেতারা বলেন, ‘যারা পাকিস্তান চায় না, তারা আমাদের শক্র। পাকিস্তানের অখন্ডতা রুখতে হবে ও শক্রদের প্রতিহত করতে হবে। ’

যশোর রাজাকার সদর দফতরে সমবেত রাজাকারদের উদ্দেশ্য করে নিজামী বলেন, ‘জাতির এই সন্কটজনক মুহূর্তে প্রত্যেক রাজাকারের উচিত ইমানদারীর সাথে তাদের উপর অর্পিত এ জাতীয় কর্তব্য পালন করা এবং ঐ সকল ব্যক্তিকে খতম করতে হবে যারা সশস্ত্র অবস্থায় পাকিস্তান ও ইসলামের বিরুদ্ধে যুদ্ধে লিপ্ত রয়েছে’ (দৈনিক সংগ্রাম, ১৫ সেপ্টেম্বর ১৯৭১)।

১৯৭১ সালের ২ আগষ্ট। চট্টগ্রাম শহর ইসলামী ছাত্রসংঘের উদ্যোগে স্থানীয় মুসলিম ইনস্টিটিউটে আয়োজিত এক সমাবেশে মতিউর রহমান নিজামী বলেন, ‘দেশপ্রেমিক জনগণ যদি ১ মার্চ থেকে দুস্কৃতকারীদের মোকাবিলায় এগিয়ে আসত তবে দেশে এমন পরিস্থিতি সৃষ্টি হতো না। আল্লাহ্ তাঁর প্রিয় পাকিস্তানকে রক্ষা করার জন্য ঈমানদার মুসলমানদের দায়িত্ব দিয়েছিলেন। কিন্তু মুসলমানরা যখন ব্যর্থ হলো, তখন আল্লাহ্ সেনাবহিনীর  মাধ্যমে দেশকে রক্ষা করেছেন’ (দৈনিক সংগ্রাম, ৫ আগষ্ট ১৯৭১)।

তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান সরকারের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের পাক্ষিক প্রতিবেদনে ( ফোর্ট নাইটলি নিক্রেট রির্পোট অন দ্য সিচুয়েশন ইন ইস্ট পাকিস্তান) একাত্তরের ১৪ জুন জামালপুরে ইসলামী ছাত্রসংগের এক সভায় নিজামীর বক্তব্য এভাবে ছাপা হয়, ‘ইসলাম রক্ষায় পাকিস্তান সেনাবাহিনীকে সার্বিকভাবে সহযোগিতা করতে হবে। এজন্য তিনি দলীয় নেতাকর্মীদের ঝাঁপিয়ে পড়ার নির্দেশ দেন। ’ ওই গোপন প্রতিবেদনে মতিউর রহমান নিজামী, আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদ, এটিএম আজহারুল ইসলাম মুক্তিযোদ্ধাদের শায়েস্তা করতে তৎপর ছিলেন বলে উল্লেখ করা হয়।

আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদের বচন
১৯৭১ সালে পূর্ব পাকিস্তান ইসলামী ছাত্রসংঘের সভাপতি এবং আলবদর বাহিনীর ঢাকা মহানগরীর প্রধান ছিলেন আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদ। তার প্রধান আড্ডা ছিল ফকিরাপুল গরম পানির গলিতে ফিরোজ মিয়ার ১৮১ নং (বর্তমান ২৫৮নং) বাড়িটিতে। ফিরোজ মিয়া ছিলেন ওই এলাকার রাজাকার কমান্ডার। তার বাড়ি থেকেই পরিচালিত হতো রাজাকারদের বিভিন্ন সভা,সশস্ত্র ট্রেনিং, বিভিন্ন অপারেশন, রাজাকার রিক্রুটমেন্ট ইত্যাদি। এখানেই মুক্তিযোদ্ধা ও মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষের লোকদের ধরে এনে নির্যাতন চালানো হতো। ফিরোজ মিয়া গংয়ের নীতিনির্ধারক ছিলেন মুজাহিদ।

২৫ অক্টোবর ইসলামী ছাত্রসংঘের এক সম্মেলনে মুজাহিদ ‘পাকিস্তানের ছাত্র-জনতাকে দুস্কৃতকারী (মুক্তিযোদ্ধা) খতম করার দৃঢ় অঙ্গীকার নিয়ে এগিয়ে আসার আহ্বান জানান। ’  (দৈনিক সংগ্রাম, ২৬ অক্টোবর ১৯৭১)। ওইদিন এক বিবৃতিতে আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদ ১৭ রমজান বদর দিবস পালনের আহ্বান জানিয়ে বলেন,‘আমরা আজ ইসলামবিরোধী শক্তির চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন। এই পবিত্র দিবসে আমরা জাতির স্বার্থে এবং এ দেশে ইসলাম প্রতিষ্ঠার জন্য আত্মোৎসর্গের শপথ গ্রহণ করবো। ’

৭ নভেম্বর ‘ঐতিহাসিক বদর দিবস’ উদ্যাপন করতে গিয়ে ঢাকার বায়তুল মোকাররমে ইসলামী ছাত্র সংঘের এক সমাবেশে আলী আহসান মুজাহিদ তার চার দফা ঘোষণায় বলেন, ‘যতদিন পর্যন্ত দুনিয়ার বুক থেকে হিন্দুস্তানের নাম মুছে দেয়া না যাবে ততদিন পর্যন্ত আমরা বিশ্রাম নেবো না। আগামীকাল থেকে হিন্দু লেখকদের বই অথবা হিন্দুদের দালালী করে লেখা পুস্তকাদি লাইব্রেরীতে কেউ স্থান দিতে পারবে না, বিক্রি বা প্রচার করতে পারবে না। যদি করেন তবে পাকিস্তানের অস্তিত্বে বিশ্বাসী স্বেচ্ছাসেবকরা তা জ্বালিয়ে ভস্ম করে দেবে’ (দৈনিক পাকিস্তান, ৮ নভেম্বর ১৯৭১)।

২৩ নভেম্বর প্রকাশিত জামায়াতের এক প্রচারপত্রে বলা হয়, ‘মনে রাখবেন আপনারা পাকিস্তানকে টিকিয়ে রাখার জন্যই কেবল যুদ্ধ করছেন না, এ যুদ্ধ ইসলামের। নমরুদের হাত থেকে মাতৃভুমিকে রক্ষার জন্য আমাদের আমীরের (গোলাম আযম) নির্দেশ পালন করুন।

একেএম ইউসুফের বচন
১৯৭১ সালের মে মাস। খুলনার খানজাহান আলী সড়কের একটি আনসার ক্যাম্পে ৯৬ জন জামায়াত কর্মী নিয়ে মওলানা আবুল কালাম মোহাম্মদ ইউসুফ (একেএম ইউসুফ) প্রথম রাজাকার বাহিনী প্রতিষ্ঠিত করেন।
২৮ নভেম্বর’ ৭১ করাচিতে সাংবাদিকদের সাথে আলোচনাকালে তিনি বলেন, ‘রাজাকাররা আমাদের বীর সেনাবাহিনীর সাথে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে ভারতীয় হামলার মোকাবিলা করেছেন। ’ তিনি দুস্কৃতকারীদের (মুক্তিযোদ্ধাদের) দমনের জন্য রাজাকারদের হাতে আরও আধুনিক অস্ত্রশস্ত্র দেয়ার দাবি জানান। তিনি বলেন, ‘বর্তমানে আলবদর-আলশামস বাহিনীর সদস্যসংখ্যা প্রায় এক লাখে দাঁড়িয়েছে। এছাড়া মুজাহিদ বাহিনীও তো রয়েছে। এরা সবাই আমাদের সেনাবাহিনীর সহায়তায় সীমান্ত রক্ষার কাজে নিয়োজিত। দুস্কৃতকারী দমনে রাজাকাররা বিশেষ সাফল্যের পরিচয় দিচ্ছে এবং এজন্যই বর্তমানে দুস্কৃতকারীদের কার্যকলাপে ভাটা পড়েছে। ’
 ২৫ অক্টোবর’৭১ সিলেটের এক জনসভায় মিত্রবাহিনীকে হুঁশিয়ার করে দিয়ে মওলানা ইউসুফ বলেন, ‘আমাদের ওপর যদি কোনো যুদ্ধ চাপিয়ে দেয়া হয়, তবে বীর সেনাবাহিনী ও বীর রাজাকাররা অবশ্যই তার পাল্টা আঘাত করবে। ’

একাত্তরের দৈনিক সংগ্রাম
rajakar-saydiএছাড়া জামায়াতে ইসলামীর মুখপত্র ‘দৈনিক সংগ্রাম’ ২৭ মে ঘোষণা দেয়, ‘মুক্তিবাহিনীকে ধরিয়ে দিতে পারলে পুরস্কার দেয়া হবে। ’ একই তারিখে ওই পত্রিকা আওয়ামী লীগ নেতাদের বিশেষ ট্রাইব্যুনালে বিচার করার জন্য পাকিস্তান সেনাবাহিনীর কাছে আবেদন জানায়। ১৫ জুনের ‘সংগ্রাম’-এ মুক্তিবাহিনীকে খতম করার জন্য শুধুমাত্র সেনাবাহিনীর দিকে তাকিয়ে না থেকে পাকিস্তানপন্থিদের পথ বেছে নিতে বলা হয়। ১৬ জুলাই পত্রিকাটি লিখেছে, ‘যারা মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছে পাকিস্তানপন্থীরা তাদের কোনদিনই ক্ষমা করবে না। ’ ১৭ জুলাই মুক্তিযোদ্ধাদের তারা, ‘দেশদ্রোহী’ হিসেবে আখ্যায়িত করে আবারও নির্মূলের আহ্বান জানায়।

জামায়াত-শিবিরের দর্শন হিসেবে হিটলারের নাৎসীবাদ ও মুসোলিনির ফ্যাসিবাদ অনুসরণের কথা বলেছে। কোরআন ও ইসলাম সম্পর্কে তাদের মনগড়া সুবিধাবাদী ব্যাখ্যা উপমহাদেশের আলেম সম্প্রদায়ের দ্বারা সর্বদা নিন্দিত হয়েছে। কিন্তু তবুও দেশের প্রধান দুই রাজনৈতিক দলের আশ্রয় প্রশ্রয়ে জামায়াত-শিবির আঙ্গুল ফুলে হয়েছে কলাগাছ। একাত্তরের এ পরাজিত শক্তি কেবল একটি রাজনৈতিক দল হিসেবেই আর্বিভূত হয়নি, সমাজ-অর্থনীতিতেও তারা শক্ত ভিত তৈরি করে নিয়েছে। আর তাই গণজাগরণ মঞ্চ থেকে যখন তাদের নিয়ন্ত্রণাধীন প্রতিষ্ঠান বর্জনের আহ্বান আসে তখন তাদের অস্তিত্বের টানাপোড়ন তৈরি হয়। জামায়াত-শিবির তখন ফিরে আসে তাদের পূর্বের চেহারায়। নাস্তিকতার ধোয়া তুলে একাত্তরের মতোই ধর্মের চাদরে নিজেদের অপকর্ম ঢাকার চেষ্টা করে জামায়াত-শিবিরের নেতারা। ফলে জামায়াত-শিবির সম্পর্কে মানুষের মনে একটি বিষয় বারবারই স্পষ্ট হয়- এই রাজাকারই সেই রাজাকার।

সালেক খোকন : লেখক ও গবেষক

ছবি : সংগৃহীত

বাংলাদেশ সময়: ১৭২০ ঘণ্টা, মার্চ ১৮, ২০১৩
সম্পাদনা: শেরিফ সায়ার

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।