ঢাকা, রবিবার, ৯ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৪ নভেম্বর ২০২৪, ২২ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

মুক্তমত

আন্দোলনের নামে সহিংসতা জাতি আগে দেখেনি

নিজামুল হক বিপুল | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৩২৭ ঘণ্টা, মার্চ ৩১, ২০১৩
আন্দোলনের নামে সহিংসতা জাতি আগে দেখেনি

ঢাকা: ১৯৯০সাল। পুরো দেশ তখন অচলাবস্থা।

স্বৈরাচার এরশাদ সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলন তখন তুঙ্গে। সেই আন্দোলনে আমিও একজন সক্রিয় কর্মী। বয়সে কিশোর হলেও রাজপথে ছিলাম সক্রিয়। বাম ধারার রাজনৈতিক সংগঠনের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত থাকায় নব্বইয়ের স্বৈরাচার বিরোধী গণআন্দোলনের প্রতি আমার আগ্রহও ছিল বেশি। মাধ্যমিক পরীক্ষা (এসএসসি) শেষে ফলাফলের অপেক্ষায় থাকা আমি তখন জেলা শহর মৌলভীবাজারে থাকি। সার্বক্ষণিক শহরে অবস্থানের কারণে মিছিল-মিটিং, সভা-সমাবেশ সবকিছুতেই উপস্থিতি ছিল সরব।

জেলা শহর থেকে আমাদের গ্রামের বাড়ি মাত্র ১৫ কিলোমিটার দূরের রাজনগর উপজেলায়। স্কুটারে যেতে সময় লাগে সর্বোচ্চ ২০ মিনিট। ভাড়াও ছিল মাত্র তিন টাকা। এখন অবশ্য যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নতির সঙ্গে সঙ্গে যানবাহনের সংখ্যা বেড়েছে, পাল্লা দিয়ে বেড়েছে পরিবহন ভাড়াও। এখন সিএনজি চালিত স্কুটারে যেতে ভাড়া গুণতে হয় ১৫ থেকে ২০ টাকা।

যাকগে, এই গল্প না হয় অন্য একদিন বলা যাবে। ১৯৮২ সালের ২৪ জুলাই যেদিন জেনারেল এইচ এম এরশাদ বন্দুকের নলের সাহায্যে ক্ষমতা দখল করলেন তারপর থেকেই তার বিরুদ্ধে আন্দোলন শুরু। বিভিন্ন সময়ে আন্দোলন হলেও এরশাদ নানা কৌশলে তখনকার প্রধান বিরোধী দল আওয়ামী লীগকে দুই দুই বার তার অধীনে নির্বাচনে নিতে সক্ষম হয়েছিলেন। একবার ১৯৮৬ সালে, আরেকবার ১৯৮৮ সালে।    কিন্তু এরশাদ সরকারের সব ধরণের ছলচাতুরি বলতে গেলে ভেঙ্গে পড়ে ১৯৮৭ সালে। বিভিন্ন সময়ে চলে আসা আন্দোলন ১৯৮৭ সালে তীব্র আকার ধারণ করে। ওই বছরের ১০ নভেম্বর ঢাকা ঘেরাও কর্মসূচি চলাকালে পুলিশের গুলিতে শহীদ হন নূর হোসেন। যিনি ‘স্বৈরাচার নিপাত যাক, গণতন্ত্র মুক্তিপাক’ শ্লোগান বুকে-পিঠে লিখে নেমেছিলেন ঢাকার রাজপথে। স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনের এই সৈনিক শহীদ হওয়ার পর থেকেই মূলত এরশাদ বিরোধী আন্দোলন চাঙ্গা হতে থাকে। সারাদেশে ছড়িয়ে পড়ে আন্দোলনের স্ফুলিঙ্গ। তারপর থেমে থেমে চলতে থাকে স্বৈরাচার বিরোধী সংগ্রাম।

ধীরে ধীরে এই আন্দোলনই চূড়ান্ত রূপ নেয় ১৯৯০ সালের শেষার্ধে। অর্থাৎ ওই বছরের সেপ্টেম্বর, অক্টোবর ও নভেম্বর জুড়ে চলতে থাকে নানা কর্মসূচি। হরতাল, অবরোধ, সচিবালয় ঘেরাওসহ বিভিন্ন কর্মসূচির মাধ্যমে সরকার বিরোধী আন্দোলন তুঙ্গে উঠে। স্বৈরাচার এরশাদ সরকারও বিভিন্ন রকম কৌশল অবলম্বন করেন। কিন্তু জনগণের আন্দোলনের মুখে তার সব কৌশলই মুখ থুবড়ে পড়ে। সর্বশেষ এরশাদ সরকার মোটা অংকের টাকার বিনিময়ে নীরু-অভিদের মত সন্ত্রাসী বাহিনী লেলিয়ে দেয় আন্দোলনকারীদের ওপর। আন্দোলনের চূড়ান্ত পর্যায়ে ২৭ নভেম্বর এই সন্ত্রাসী বাহিনীর গুলিতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসি এলাকায় শহীদ হন ডা. শামসুল আলম খান মিলন। তার মৃত্যুর মধ্য দিয়েই মূলত ৬ ডিসেম্বর চূড়ান্ত বিজয় অর্জন করে স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলন।    

এই লেখাটি মূলত ৯০-এর স্বৈরাচার বিরোধী গণআন্দোলনের সঙ্গে বর্তমান সরকার বিরোধী প্রকারান্তরে যুদ্ধাপরাধীদের রক্ষার যে আন্দোলন চলছে তার একটা মৌলিক পার্থক্য নিয়ে। ‘৯০ এর গণঅভূত্থ্যান পূর্ব হরতাল, অবরোধসহ বিভিন্ন কর্মসূচি চলাকালে সারাদেশের মানুষ একাট্টা ছিল। স্বতঃস্ফূর্ত ভাবে আন্দোলনে মানুষের অংশগ্রহণ ছিল। সাধারণ মানুষ এরশাদের স্বৈরাশাসন থেকে মুক্ত হতে যার যার অবস্থান থেকে আন্দোলনের সঙ্গে যেমন একাত্ম হয়েছিল, ঠিক তেমনি হরতাল-অবরোধ কর্মসূচিতেও অংশ নিয়েছিল। আন্দোলন করতে কিংবা হরতাল অবরোধ কর্মসূচি পালন করতে কাউকে জোর করা কিংবা বাধ্য করা হয়নি।

এরশাদ বিরোধী আন্দোলন চলাকালে দিনের পর দিন বিরতি দিয়ে হরতাল অবরোধ পালন করলেও আজকের মতো এতো ধ্বংসাত্বক কর্মকাণ্ডে জড়িত হয়নি রাজনৈতিক দলগুলো। হরতাল-অবরোধের সময় মোটের ওপর রাস্তায় গাড়ি চলেনি। মাঝে মধ্যে দু’একটা চললেও সেগুলো পিকেটাররা থামিয়ে দিতেন, যা ঠায় দাঁড়িয়ে থাকতো হরতাল বা অবরোধ কর্মসূচি চলাকালীন সময় পর্যন্ত। তবে জরুরি খাদ্যবাহী কিংবা সংবাদপত্রবাহী যানবাহনকে নিরাপদে যেতে সহযোগিতা করতেন খোদ পিকেটাররা। রেল লাইন উপড়ে ফেলা, রেল লাইনে আগুন দেওয়া, রেলগাড়িতে আগুন দেওয়া, গণহারে যানবাহন পুড়িয়ে ফেলা, গাড়িতে আগুন লাগিয়ে বা পেট্টোল বোমা মেরে মানুষ হত্যার চেষ্টা, ব্রীজের পাটাতন খুলে ফেলা, রাস্তা কেটে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করে ফেলা, মাইলের পর মাইল রাস্তার উপর গাছ কেটে অবরোধ করা, থানায় হামলা চালানো, অগ্নিসংযোগ করা, পুলিশ হত্যা, বোমা হামলা চালানো, থানা লুটপাট, সরকারি স্থাপনা বা অফিস আদালতে আগুন ধরিয়ে দেশের সম্পদ নষ্ট করা, বিদ্যুৎ কেন্দ্র পুড়িয়ে দেওয়া, সংখ্যালঘুদের বাড়িঘর ও ধর্মীয় উপসনালয়ে হামলা ও অগ্নিসংযোগ করার মত এহেন কোনো সহিংস কর্মকাণ্ড ছিল না।

ওই সময়ে যেটা হত তারমধ্যে একটা ছিল এরশাদ সরকারের কোনো মন্ত্রী হরতাল বা অবরোধ চলার সময় গাড়ি নিয়ে ঢাকার বাইরে কোথায়ও গেলে সেই বহরে বাধা দিতেন পিকেটররা। কিন্তু এখন হরতালের আগের দিন দুপুর থেকেই শুরু হয় জ্বালাও-পোড়াও, থানায় হামলা চালানো, ট্রেনে আগুন দেওয়াসহ নানা সহিংস কর্মকাণ্ড। আগের দিনই একটা আতংক সৃষ্টি করা হয়, হরতালের দিন যাতে লোকজন বাসা-বাড়ি থেকে বের না হন। কিন্তু হরতাল সফল করতে এই সহিংসতা ও ধ্বংসাত্বক কর্মকাণ্ড কতোটা কার্যকর ও যুক্তিসঙ্গত ভেবে দেখার সময় এসেছে।

একটা বিষয় খুবই পরিস্কার যে, গণতান্ত্রিক সরকার ব্যবস্থায় সহিংস আন্দোলন করে সরকারের পতন ঘটানো যায় না। এর উজ্জ্বল উদাহরণ রয়েছে। ১৯৯১ সালে দেশ গণতান্ত্রিক ধারায় ফিরে আসার পর তৎকালীন বিএনপি সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলন করে আওয়ামী লীগ। কিন্তু সরকারের মেয়াদ শেষ হওয়ার একদিন আগেও ক্ষমতা থেকে নামানো যায়নি বিএনপিকে। বরং তারা ১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি একটা প্রহসনের নির্বাচন করে আরেকবার মাত্র ১৫ দিনের জন্য সরকার গঠন করে। একইভাবে ১৯৯৬ থেকে ২০০১ সাল পর্যন্ত দেশ চালায় আওয়ামী লীগ। সরকারের শেষ দিকে বিএনপি ব্যাপক আন্দোলন করে। কিন্তু তৎকালীন সরকার নির্ধারিত সময়ের একদিন আগেও ক্ষমতা ছাড়েনি। ২০০৬ সালেও বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের বিরুদ্ধে লাগাতার কর্মসূচি দিয়েও নির্ধারিত সময়ের একদিন আগেও এই সরকারের পতন ঘটাতে পারেনি বিরোধী দল আওয়ামী লীগ। তাই আজ আন্দোলনের নামে যে জ্বালাও-পোড়াও হচ্ছে, সহিংস তাণ্ডব চলছে তার মধ্যদিয়ে মেয়াদ পূর্ণ হওয়ার একদিন আগেও বর্তমান সরকারকে ক্ষমতা থেকে নামানো যাবে না। বরং সহিংস আন্দোলনের কারণে জনগণের আস্থা হারাবে প্রধান বিরোধী দল বিএনপি। তাই সহিংসতার পথ পরিহার করে বিএনপির উচিত হবে গণতান্ত্রিক উপায়ে গণমানুষের সম্পৃক্ততার মধ্য দিয়ে হরতাল-অবরোধসহ আন্দোলন কর্মসূচি পালন করা। কিন্তু তারা সেটা না করে যুদ্ধাপরাধী রাজনৈতিক দল জামায়াতে ইসলামীর পাল্লায় পড়ে সহিংসতার দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। আর এই সুযোগে বিএনপির ডাকা হরতালে জামায়াতে ইসলাম ও ইসলামী ছাত্র শিবির দেশের বিভিন্ন স্থানে সহিংসতা সৃষ্টি করে ধ্বংসাত্বক কর্মকাণ্ড চালিয়ে একটা ভয়ঙ্কর অবস্থার দিকে ঠেলে দিচ্ছে দেশকে। তাই এখনই এই অবস্থার অবসান হওয়া উচিত। এ জন্য প্রধান বিরোধী দল বিএনপিকে আরো দায়িত্বশীল ও সতর্ক হতে হবে। যেন তাদের ঘাড়ে বন্দুক রেখে জামায়াত ফায়দা লুটে না নেয়।

মনে রাখতে হবে, যদি আমরা ধরে নেই রাজনীতি হচ্ছে গণমানুষের কল্যাণের জন্য, তাহলে তাদেরকে জিম্মি করে কোনো আন্দোলনে সফলতা আসতে পারে না। আন্দোলনে সহিংসতা থাকলে সেই আন্দোলন গণমূখীও নয়, গণতান্ত্রিকও নয়। জনগণের ভালোবাসা অর্জন করার জন্য সহিংসতা পরিহার করা প্রত্যেক রাজনৈতিক দলের জন্যই শুভ ফলাফল নিয়ে আসতে পারে। নচেৎ সেই আন্দোলন হবে গণবিরোধী।

লেখক- সিনিয়র রিপোর্টার, বাংলাদেশ প্রতিদিন

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।