ঢাকা, রবিবার, ৯ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৪ নভেম্বর ২০২৪, ২২ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

মুক্তমত

সিটি নির্বাচন কি জাতীয় নির্বাচনের পথ রচনা করবে?

এরশাদুল আলম প্রিন্স, আইন ও মানবাধিকার সম্পাদক | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৭২৩ ঘণ্টা, জুন ১৫, ২০১৩
সিটি নির্বাচন কি জাতীয় নির্বাচনের পথ রচনা করবে?

রাজনীতির মাঠে এ সময়ের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা হচ্ছে চার সিটি করপোরেশন নির্বাচন। এ নির্বাচনের সবচেয়ে আশাব্যঞ্জক দিক হচ্ছে দেশের প্রধান দুই দল-আওয়ামী লীগ ও বিএনপি এ নির্বাচনে অংশ গ্রহণ করছে।

স্থানীয় জনসাধারণও অত্যন্ত উৎসাহ-উদ্দীপনার সাথে তাদের ভোটাধিকার প্রয়োগ করছে। এ নিবন্ধটি লেখার সময়ও চার সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনেই ভোটকেন্দ্রে ভোটারদের দীর্ঘ সারি প্রমাণ করে যে জনগণ ভোটের মাধ্যমেই ক্ষমতার পরিবর্তন চায়;সেটা স্থানীয় নির্বাচন হোক বা জাতীয় নির্বাচন।

গণতন্ত্রের মূল কথা হচ্ছে-সব ক্ষমতার মালিক জনগণ। তবে সব দেশের গণতন্ত্রের হাল যে এক রকম তা নয়। কোথাও আছে নামধারী গণতন্ত্র আবার কোথাও আছে পোশাকি গণতন্ত্র। আদর্শিক যে গণতন্ত্রের কথা আমার জেনেছি, তা পৃথিবীর খুব কম দেশেই আছে। বাস্তবে হয়তো সম্ভবও নয়। তবে সাধারণভাবে যে মানসম্মত গণতন্ত্রের কথা আমরা বলি, তা কয়েকটি দেশে এখনো টিকে আছে।  

গণতন্ত্রের সর্বনিম্ন যে বৈশিষ্ট্যটি থাকতে হবে তা হচ্ছে- জনগণের ভোটাধিকার। ভোটের মাধ্যমেই রচিত হয়ে গণতন্ত্রের পথ। ভোটই গণতন্ত্রের প্রথম পদক্ষেপ। ভোটর পর  ক্ষমতাশীল দল বা প্রতিনিধিরা কীভাবে সে ক্ষমতার চর্চা করবেন তার উপরে নির্ভর করে গণতন্ত্রের মান ও ভবিষ্যৎ।

দেশের জনগণের হাতে একটিমাত্র ক্ষমতাই আছে-তা হচ্ছে ‘ভোট’। সেই ভোটের ক্ষমতাও মাঝে মধ্যেই চ্যালেঞ্জের মধ্যে পড়ে যায়।

আমাদের গণতন্ত্রের হাল এমন হয়েছে যে, কোনো রকম একটি সুষ্ঠু নির্বাচন করতে পারলেই যেনো গণতন্ত্র কায়েম হয়ে গেলো। ফলে, যারা নির্বাচন করার দায়িত্বে থাকেন-অর্থাৎ সরকার, নির্বাচন কমিশন তথা স্থানীয় প্রশাসনের সবাই একটি সুষ্ঠু নির্বাচন পরিচালনা করার জন্য রাষ্ট্রের সব শক্তি নিয়োগ করেন। তবে এক্ষেত্রে সরকারের সদিচ্ছা থাকতে হবে। দল, জনগণ বা নির্বাচন কমিশনের ইচ্ছা এখানে কোনো বিবেচ্য বিষয় নয়।  

ভোটসর্বস্ব গণতন্ত্রের কারণে দেশের সব রাজনৈতিক কার্যক্রমও ভোটকেন্দ্রিক হয়ে গেছে। বিরাজমান এ রাজনৈতিক সংস্কৃতির জন্য দেশের গণতান্ত্রিক ও স্থানীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর শক্তিশালীকরণ, সুশাসন প্রতিষ্ঠা ইত্যাদি অধিকতর গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলো চাপা পড়ে গেছে।

বিদ্যমান এ রাজনৈতিক সংস্কৃতির জন্যই দেশে একটি ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনও আমাদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। কারণ, সারাজীবনের প্রজা যদি একদিনের জন্য রাজা হয়ে যায় তাহলে বিষয়টি গুরুত্ববহন করে বৈকি!

কিন্তু শাসন ব্যবস্থায় যদি প্রতিনিয়ত জনমতের প্রতিফল বা খবরদারি থাকতো তাহলে হয়তো এমনটি ঘটতো না। সেক্ষেত্রে যেকোনো নির্বাচনই একটি ধারাবাহিক গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া হিসেবে বিবেচিত হতো।

চলমান রাজনৈতিক সংস্কৃতির জন্য চার সিটি কর্পোরেশন নির্বাচন চারটি মহানগরের জন্য যতোটা গুরুত্বপূর্ণ দেশের রাজনীতির জন্য তার চেয়ে আরো বেশি গুরুত্বপূর্ণ। এটি স্থানীয় ক্ষমতার হাত বদলের সাথে সাথে কেন্দ্রীয় ক্ষমতার পরিবর্তনের জন্যও ইঙ্গিতবাহী। তাই এ নির্বাচন সরকার, বিরোধীদল, নির্বাচন কমিশন তথা স্থানীয় প্রশাসন সবার জন্যই একটি এসিড টেস্ট।

সরকার যদি সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন উপহার দিতে পারে, তবে তাদের অধীনেই আগামী নির্বাচনের দাবিটি আরো পাকাপোক্ত হবে। সেই সাথে বিরোধী দলের ‘তত্ত্বাবধায়ক সরকার’ পুনর্বহালের দাবিটিও হালে পানি পাবে না।

এসব বিবেচনায় সরকারের কাছে তার সমর্থিত প্রার্থীদের জয়ের চেয়ে সুষ্ঠু নির্বাচন করাই বেশি গুরুত্বপূর্ণ। কারণ, স্থানীয় সরকার নির্বাচনে পরাজয়ে ক্ষমতার হাতবদল হয় না। জাতীয় নির্বাচনে ক্ষমতার পালাবদল হয়।

তাই সুষ্ঠু স্থানীয় নির্বাচনের ক্রেডিট নিয়ে যদি সরকারের অধীনেই জাতীয় নির্বাচনের পথ রচনা করা যায় সেটি সরকারের জন্য অনেক বেশি লাভজনক। বকরি (ছাগল) কোরবানি দিয়ে যদি উটের সওয়াব পাওয়া যায় তবে এর চেয়ে উত্তম আর কী আছে!

বিরোধীদলের জন্যও এ নির্বাচন একইভাবে গুরুত্বপূর্ণ। এ নির্বাচনের ফলাফলের ভিত্তিতে জাতীয় নির্বাচনে বিএনপির অবস্থান কী হবে এ রকম একটি জনমত জরিপ তারা করে নিতে পারবে। এ বিষয়টি সরকারের জন্যও প্রযোজ্য।

কৌশলগত কারণে এ নির্বাচনের বিরোধী দলের হারানোর কিছু নেই। বিএনপি যেখানে জয়ী হবে সেখানে তারা নির্বাচনের দাবী করবে আর যেখানে তারা পরাজিত হবে সেখানে কারচুপির অভিযোগ আনবে। অতীত অভিজ্ঞতা সে কথাই বলে। বিরোধী দলে থাকলে যেকোনো কথাই বলা যায়।
 
কিন্তু প্রশ্ন হলো, চার সিটি করপোরেশন নির্বাচনে যদি বিএনপির সব প্রার্থী জয়ীও হয়, কি বিএনিপি কি তার তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবী থেকে সরে আসবে?

অতীতের রাজনৈতিক অভিজ্ঞতা সেরকম সাক্ষ্য বহন করে না। বরং নির্বাচনে বিএনপি জয়ী হলে এর ফল পকেটস্থ করার পাশাপাশি তারা তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিকে আরো বেশি জোরালো ভাবে তুলে ধরবে। বিএনপি সিটি নির্বাচনে তাদের জয়কে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের পক্ষে জনগণের রায় হিসেবে প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা করবে।  

নির্বাচনের পরে সরকার ও বিরোধী দল কে কি কৌশল অবলম্বন করে সেটিই এখন দেখার বিষয়।

আমাদের গণতান্ত্রিক ও রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ নির্ভর করে সরকার ও বিরোধীদল ক্ষমতায় যাওয়া ও থাকার জন্য কে কি কৌশল ও পাল্টা কৌশল অবলম্বন করে তার ওপর। এসব নানামুখি কৌশল সমীকরণের যোগ-বিয়োগের ফলই হলো আমাদের গণতন্ত্র। আর এ যোগ-বিয়োগের খেলায় জনগণের তেমন বড় কোনো ভূমিকা নেই। নির্বাচন কমিশনের তফশিল অনুযায়ী ভোট দেওয়াই আমাদের মহান নাগরিক দায়িত্ব।  

আমাদের দেশের গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলো একরম মুমূর্ষু অবস্থায় দিনপাত করে। যে স্থানীয় সরকার নির্বাচন আজ হচ্ছে তার ক্ষমতায়ন কতটুকু হয়েছে সেটা নিয়ে আমাদের কোনো উচ্চবাচ্য নেই। আমাদের স্থানীয় সরকারগুলো নখ-দন্তহীন কাগুজে বাঘে পরিণত হয়েছে।

এখানে স্থানীয় ও কেন্দ্রীয় শাসনের মাঝে ক্ষমতার ব্যবধান বিশাল। কিন্তু গণতন্ত্রে তার বিপরীতটাই হওয়ার কথা। কোনো দেশের স্থানীয় শাসন যত বেশি শক্তিশালী সেই দেশের গণতন্ত্র ততো বেশি শক্তিশালী। এ কারণে অধিকাংশ গণতান্ত্রিক দেশই তাদের স্থানীয় সরকারকে শক্তিশালী করার জন্য নানা উদ্যোগ নিচ্ছে। আর আমরা চলছি উল্টো পথে-উল্টো রথে।

অন্যান্য দেশে নির্বাচন পরিচালনা করে নির্বাচন কমিশন আর আমাদের দেশে করে সরকার। সরকারের নির্দেশেই পরিচালিত হয় নির্বাচন কমিশনের কার্যক্রম। কিন্তু সংবিধান অনুযায়ী সরকার নির্বাচন কমিশনকে যেকোনো বিষয়ে সহায়তা করতে বাধ্য। কিন্তু আমরা বাস্তবে তা দেখি না। সরকারের কথা হচ্ছে, সুষ্ঠু নির্বাচন করাই আমাদের দায়িত্ব। সরকার প্রয়োজন মনে করলে সেনাবাহিনী নিয়োগ করবে, অতিরিক্ত পুলিশ নিয়োগ করবে ইত্যাদি। কিন্তু এ প্রয়োজনবোধ করার এখতিয়ার হচ্ছে নির্বাচন কমিশনের। সরকারের নয়। সরকারের কাজ হচ্ছে নির্বাচন কমিশনের কাজে সর্বপ্রকার সাহায্য-সহায়তা প্রদান।

সরকার চেয়েছিল একটি সুষ্ঠু নির্বাচন পরিচালনা করতে। সে জন্যই স্থানীয় পর্যায়ে সরকারি বাহিনীর আস্ফালন দেখা যায়নি। আর আইন-শৃংখলা বাহিনীর নজরদারির জন্য বিরোধীদলও নৈরাজ্য সৃষ্টি করতে পারে নি। ফলে, এ পর্যন্ত যতটুকু সাফল্য আছে, তা সরকার ও বিরোধী দলের কৌশলগত অবস্থান ও ভূমিকার জন্য।

কিন্তু নির্বাচন পরিচালনায় সরকার ও নির্বাচন কমিশনের ভূমিকাকে আমাদের পৃথক করে ভেবে দেখতে হবে। তাহলেই আমরা বুঝতে পারবো আগামী নির্বাচনে নির্বাচন কমিশনের ভূমিকা কী হবে আর সরকারই বা কী ভূমিকায় অবতীর্ণ হবে।

এখন প্রশ্ন হলো, সরকার সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে নির্বাচন সুষ্ঠু করার ব্যাপারে যে সদিচ্ছা দেখিয়েছে জাতীয় নির্বাচনে সে সদিচ্ছা দেখাবে কি-না। অথবা সরকার বিরোধী দলের কাছে সেই আস্থা অর্জন করতে পেরেছে কি-না। যদি এর উত্তর ইতিবাচক হয় তাহলেই আগামী নির্বাচন  সরকারের বেঁধে দেওয়া ছকেই হবে। অর্থাৱ সংবিধান অনুযায়ী বর্তমান সরকারের অধীনেই নির্বাচন হবে-কোনো রকম সংবিধান সংশোধন ছাড়াই। সেই আস্থা অর্জিত না হলে বিধি বাম।

চার সিটি করপোরেশন নির্বাচন হয়তো সেই আস্থা অর্জনে সরকারকে কিছুটা সাহায্য করবে। কিন্তু বিরোধী দল গণতন্ত্রের জন্য কতটা নেক-নজর সম্পন্ন সেটাই দেখার বিষয়।

বাংলাদেশ সময়: ১৭০১ ঘণ্টা, জুন ১৫, ২০১৩
সম্পাদনা: জুয়েল মাজহার, কনসালট্যান্ট এডিটর

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।