ঢাকা, রবিবার, ৯ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৪ নভেম্বর ২০২৪, ২২ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

মুক্তমত

ভেজালমুক্ত খাদ্য নিশ্চিতের কথা থাকুক ইশতেহারে

ডঃ কেএইচএম নাজমুল হুসাইন নাজির, অতিথি লেখক | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৯০৪ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ২৬, ২০১৩
ভেজালমুক্ত খাদ্য নিশ্চিতের কথা থাকুক ইশতেহারে

রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের কথাবার্তা-জনসভা, টক-শো, পত্র-পত্রিকা বা ইলেক্ট্রনিক মিডিয়ার নড়াচড়া দেখে মনে হয় আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পালে মৃদু হাওয়া লেগেছে। যদিও অনেকের সন্দেহ নির্বাচন আদৌ হবে কি না বা হলে কিভাবে হবে।

যাই হোক, দলগুলো কম বেশী ব্যস্ত যোগ্য প্রার্থী বাছাই করার কাজে। সাথে সাথে চলছে সম্ভাব্য প্রার্থীদের জনসংযোগ, জনগণের কাছে করছেন বিভিন্ন ধরনের ওয়াদা। চমক লাগানো নির্বাচনী ইশতেহার সাঁজাতে দলের নীতি নির্ধারণী পর্যায়ের নেতা, উপদেষ্টা বা থিঙ্কট্যাংকদের ঘুম হারাম হয়ে গেছে- বলা যায়।

দেশ ডিজিটাল না এনালগ হবে এ নিয়ে বিশ্লেষনের শেষ নেই। ক্ষমতার মসনদে অধিষ্ঠিত থাকা বা হওয়ার চেষ্টায় নেই গাফিলতি। অভিযোগ আছে- জেতার পর বেশীরভাগ নির্বাচিত প্রতিনিধি তাদের নিজ নির্বাচনী এলাকায় যান কদাচিৎ। নির্বাচিত প্রতিনিধিরা বলেন ভিন্ন কথা। তাঁদের ভাষায়- রাজধানীতে না থাকলে, আলোচনা-বাহাস না করলে এলাকার জন্য অর্থ বরাদ্দ কিভাবে আসবে। কথায় যুক্তি একেবারে নেই বলা যাবে না। যাহোক, গণতান্ত্রিক দেশ বলে কথা। জনগণের ভোটেই হবে চূড়ান্ত ফয়সালা।

দুঃখজনক হলেও সত্য, এদেশের গণতন্ত্র অনেকটা ভোটাভুটি পর্যন্তই সীমাবদ্ধ। জনগণের কথা যাদের ভাবার কথা তাঁরা খুব কমই ভাবেন বলে মনে হয়। বাংলাদেশের গণতন্ত্রকে অপরিপক্ক বললে অত্যুক্তি হবে না। অপরিপক্কতার পাশাপাশি সীমাহীন দূর্নীতি, সন্ত্রাস, অপশাসন, হত্যা, গুম, খুন ইত্যাদির কথা আমরা সবাই কমবেশী জানি। এত কিছুর পরেও দেশ ধারাবাহিকভাবে এগো্চ্ছে অনেক ক্ষেত্রে- এটা অস্বীকার করার উপায় নেই।

তথ্য-প্রযুক্তিতে এগিয়েছে দেশ। তিনবেলা না খেয়ে থাকতে রাজি কিন্তু এক ঘণ্টা মোবাইল ফোন, ফেসবুক টুইটার ছাড়া থাকতে পারি না। খাদ্যপণ্য সংরক্ষণে এসেছে যুগান্তকারী সাফল্য যার কল্যাণে দেশে এখন পঁচা ফল পাওয়া কঠিন। আবিস্কৃত হয়েছে ফরমালিন পদ্বতি, কার্বাইড পদ্বতি, কীটনাশক পদ্বতি আরো কত কি। সবগুলো পদ্বতির রয়েছে ক্যারিশমাটিক গুণ। তাই এগুলো দেদারছে ব্যবহার হচ্ছে আমাদের নিত্য প্রয়োজনীয় মৌসুমী ফল, শাক-শবজি, খাদ্যশস্য, শিশুখাদ্য, পানীয়, মুড়ি, বেকারি পণ্য, জিলাপি, ফার্স্ট ফুড, পশুখাদ্য, ওষুধ ইত্যাদিতে।

সম্প্রতি দেশ-বিদেশের বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় আমার লেখা ‘খাদ্যে ভেজালঃ একটি ভিন্ন রকম পর্যালোচনা ও করণীয়’ শীর্ষক একটি গবেষণাধর্মী প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়েছে। পাঠকের মন্তব্য অনুযায়ী নতুন করে আজকের এ লেখা।

প্রকাশিত প্রবন্ধে বোঝানোর চেষ্টা করেছি খাদ্যে ভেজালের কারণে কিভাবে আমরা তিলে তিলে শেষ হয়ে যাচ্ছি। নিকষ-কালো অন্ধকারের দিকে গোটা জাতি কিভাবে একটু একটু করে ধাবিত হচ্ছে। বর্ণনা করেছি দেশে বর্তমানে ভেজালের মাত্রা কত ভয়ংকর আকার ধারণ করেছে। ভেজালের ব্যাপ্তি এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে, চার পাঁচ বা ছয়স্তর বিশিষ্ট কঠোর নিরাপত্তা বেষ্টনী বা দুর্ভেদ্য গ্রিন জোনও এর আওতামুক্ত নয়। এক নীরব ঘাতক হয়ে জাতির ওপর খড়গ হয়ে দেখা দিয়েছে।

অবস্থার ভয়াবহতা এমন যে ব্যক্তিগতভাবে অত্যন্ত সচেতন হয়েও ভেজালের হাত থেকে রেহাই পাওয়া অসম্ভব। মাঝে মাঝে মনে হয় আমরা বিষ-মিশ্রিত-খাবার নাকি খাবার-মিশ্রিত-বিষ খাচ্ছি। ভেজালের কারণে খাদ্য-চিকিৎসার সাথে অন্য সব মৌলিক চাহিদাও কোন না কোন ভাবে প্রভাবান্বিত হচ্ছে। চিকিৎসক ও গবেষকদের ভাষ্যমতে, অনেক সমস্যার কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়েছে খাদ্যে ভেজাল যা নৈতিকতার অবক্ষয় থেকে শুরু করে অর্থনৈতিক চাপ পর্যন্ত সুবিস্তৃত।

নির্বাচন আসলে জনগণ অনেক আশা নিয়ে তাদের পছন্দের প্রার্থীকে নির্বাচিত করে। খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা ও চিকিৎসার নিশ্চয়তা পেলেই জনগণ খুশি। অনেককে বলতে শুনেছি- জীবন ধারণে খাদ্যেরই যদি নিরাপত্তা না থাকলো তাহলে হাজার হাজার কোটি টাকার অস্ত্র কিনে কি হবে। সহজ সমীকরণে বলা যায় দেশের জনগণই যদি ভালোমত না বাঁচলো ডিজিটাল বা সমৃদ্ধ বাংলাদেশ দিয়ে কি হবে।

দেশের মানুষ যদি জটিল রোগে আক্রান্ত হয়ে শেষই হয়ে যায় তাহলে ভিশন-২১ বা মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত হয়ে কি হবে। ভবিষ্যৎ প্রজন্ম (দেশের শিশুরা) যদি স্টুপিড হয়ে বেড়ে উঠলো তাহলে দেশের প্রবৃদ্ধি বা রিজার্ভ গগণচুম্বি হলে কি লাভ।

গবেষণায় দেখা যায়, বর্তমান অবস্থা চলতে থাকলে ২০২১ সালে দেশের সিংহভাগ মানুষ ডায়াবেটিসসহ নানান জটিল রোগে আক্রান্ত হবে। দেশে জ্যামিতিকহারে বাড়ছে ক্যা্ন্সার রোগীর সংখ্যা। খাদ্যপণ্যে ভেজালের সাথে আপোস করার নজির পৃথিবীর কোথাও আছে বলে আমার জানা নেই। দুঃখজনক যে আমাদের দেশে শক্তিশালী সিন্ডিকেটের প্রভাবে ভেজাল বিরোধী অভিযান অনেক সময় বন্ধ হয়ে যায়।

রাজনৈতিক ছত্রছায়ায় পার পেয়ে যায় অপরাধীরা। আমাদের মধ্যে সচেতনতার অভাব রয়েছে। বুঝে না বুঝে আমরা যারা নিজ হাতে ভেজাল মেশাই, খাদ্যপণ্যে বিভিন্ন ক্ষতিকর কেমিকেল বা কীটনাশক ব্যবহার করি কেউই ভেজালের বিস্তৃত জাল থেকে রেহাই পাচ্ছি না- এটা সত্যিকারভাবে আমরা কদাচিৎ অনুধাবন করি।

বিষয়টা এমনও নয় যে, সরকারি দলের সমর্থকবৃন্দ ক্ষমতার জোরে সমস্ত রাষ্ট্রযন্ত্রকে ব্যবহার করে খাদ্যে ভেজালের ভয়াবহ পরিণতি থেকে বেঁচে যাবে আর বিরোধীদল ভেজাল খেয়ে মরবে। সেরকম হলে সবার আগে আমাদের দেশে সে চর্চা শুরু হতো- অবস্থাদৃষ্টে সেরকমই মনে হয়। বস্তুত দল-বেদল, ধর্ম-বর্ণ সবার স্বার্থ এখানে সমানভাবে জড়িত। তাই বিষয়টি অনেক বেশী গুরুত্ব পাবার দাবি রাখে। খাদ্যে ভেজালের অন্তর্নিহিত কারণসমুহকে গুরুত্ব দিয়ে অগ্রাধিকারভিত্তিতে সমাধান করার বাস্তবসম্মত অঙ্গীকার হতে পারে আগামী নির্বাচনের একটি উল্লেখযোগ্য দিক।

অনেকের মতে, অন্য অনেক ইশতেহারের চেয়ে এর গুরুত্ব কোন অংশেই কম নয় বরং অনেক ক্ষেত্রে বেশী। কাজেই ১৪ বা ১৮ দলীয় জোটের সবাইকে সত্যিকারভাবে বিষয়টির গুরুত্ব অনুধাবণ করতে হবে এবং নির্বাচনী ইশতেহারের মধ্যে বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। সত্যিকারভাবে অনুধাবন করতে পারলে নিশ্চয় তা শুধু ওয়াদার মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকবে না। সবার স্বতঃস্ফুর্ত অংশগ্রহণে সহজেই বাস্তবায়িত হবে।

কয়েকদিন আগে মাননীয় বিরোধীদলীয় নেতা একটি জনসভায় সমাজ থেকে মাদক নির্মুলের ঘোষণা দিয়েছেন। মাদক সমাজকে ঘুনপোকার মত কুড়ে কুড়ে খাচ্ছে- সন্দেহ নেই। অবশ্যই মাদকের কবল থেকে সমাজের ঐশীদেরকে বাঁচাতে হবে। সময়োচিত এ ধরনের ওয়াদা বা সিদ্ধান্তের জন্য সাধুবাদ জানাই। মাদকের মাধ্যমে বিশেষ করে দেশের যুব সমাজের একাংশ ধ্বংস হচ্ছে।

অন্যদিকে ভেজালের মাধ্যমে মাদকসেবীর সাথে অন্য সবাই ধ্বংস হচ্ছে। গর্ভের শিশু থেকে শুরু করে বৃদ্ধ সবাই দারুণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। কাজেই ভেজালের গুরুত্ব কোন অংশেই কম নয়। ইচ্ছে করলে অনেক কঠিন কাজও যে অসম্ভব নয় তা বিগত জোট সরকারের শিক্ষাঙ্গনকে নকলমুক্ত করার কৃতিত্ব থেকেই বোঝা যায় যা সব মহলে হয়েছিল প্রশংসিত।

মাননীয় বিরোধীদলীয় নেতার সময়োপযোগী ওয়াদার সূত্র ধরে আপামর জনসাধারণের একজন হয়ে আশা করতে চাই ১৮ দলীয় জোট যদি ক্ষমতায় আসে তাহলে সমাজ থেকে সত্যিকারভাবে মাদক দুর হবে। তেমনিভাবে আশা থাকবে আগামীতে যে জোটই ক্ষমতায় আসুক খাদ্যে ভেজালরুপী জাতীয় বিপর্যয়কে সমাজ থেকে দুর করতে প্রয়াস পাবেন।

দলগুলো নির্বাচনী ইশতেহার তৈরি করে জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ সমস্যাকে সামনে রেখে, মানুষের চাহিদা বা দেশের সার্বিক উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রার নিরীখে এককথায় তাৎক্ষণিক বা সুদূর-প্রসারী জন-কল্যাণকে প্রাধান্য দিয়ে। খাদ্যে ভেজাল একটি বড় ধরণের জাতীয় সমস্যা- এটা অনস্বীকার্য। সার্বিক বিবেচনায় খাদ্যে ভেজালরোধ দেশের সচেতনমহলের গণদাবিতে পরিণত হয়েছে বলে অনেকের মত আমারও মনে হয়।

পাশাপাশি অচেতনদেরও দরকার সমানভাবে। দারুন এ সুযোগকে যেকোন দলের লুফে নেবার কথা। আশা করবো রাজনৈতিক দলগুলো তাদের নির্বাচনী ইশতেহারের মধ্যে বিষয়টি অনেক বেশী গুরুত্বের সাথে স্থান দেবেন। সাথে সাথে সত্যিকারভাবে সে ওয়াদা বাস্তবায়ন করার জন্য দৃঢ় প্রতিজ্ঞ হবেন অন্তত নিজের স্বার্থের কথা ভেবে হলেও।

লেখক: বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, ময়মনসিংহ’র মাইক্রোবায়োলজি ও হাইজিন বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক। বর্তমানে দক্ষিণ কোরিয়ার ইয়াংনাম ইউনিভার্সিটিতে গবেষণারত। ই-মেল: nazirbau@gmail.com

বাংলাদেশ সময়: ১৮৪০ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ২৬, ২০১৩
এনএস/জিসিপি

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।