ঢাকা, বুধবার, ২৪ আষাঢ় ১৪৩২, ০৯ জুলাই ২০২৫, ১৩ মহররম ১৪৪৭

মুক্তমত

ইব্রাহিম ত্রাওরের মাঝে জিয়াউর রহমানকে খুঁজে পান বাংলাদেশিরা

মো. জুবাইর | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৮:২৯, জুলাই ৮, ২০২৫
ইব্রাহিম ত্রাওরের মাঝে জিয়াউর রহমানকে খুঁজে পান বাংলাদেশিরা

ইতিহাস কখনো কখনো এক অদ্ভুত প্রতিচ্ছবি তুলে ধরে। যেখানে থাকে নতুন চরিত্র, নতুন ভূখণ্ড।

কিন্তু নিদর্শন থাকে আগের মতো। দেখা যায় পরিচিত আবহ, পুরনো সংগ্রামের অনুরণন। আফ্রিকার সাহেল অঞ্চলের দেশ বুরকিনা ফাসোর বর্তমান সেনাশাসক ইব্রাহিম ত্রাওরে। তার কণ্ঠস্বর, পোশাক, দর্শন ও রাজনৈতিক অবস্থান বাংলাদেশের মানুষের মাঝে জাগিয়ে তুলছে আরেক সেনানায়কের স্মৃতি। যার নাম প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান।

মাত্র ৩৫ বছর বয়সে ক্ষমতায় আসা ত্রাওরে ও তরুণ সেনা কর্মকর্তা থেকে বাংলাদেশের শাসনক্ষমতায় উঠে আসা জিয়াউর রহমান দুই ভিন্ন মহাদেশের দুই নেতা। কিন্তু দুজনই এক ধরনের ঐতিহাসিক সাদৃশ্য বহন করেন। তাদের নেতৃত্বে উঠে আসার পেছনে রয়েছে নিরাপত্তাহীনতা, রাজনৈতিক দুর্বৃত্তায়ন, বিদেশি প্রভাবের বিরুদ্ধে তীব্র জনঅসন্তোষ এবং জাতিকে রক্ষার আহ্বান।

একনজরে ইব্রাহিম ত্রাওরে
বুরকিনা ফাসোর সামরিক শাসক ক্যাপ্টেন ইব্রাহিম ত্রাওরে মাত্র ৩৭ বছর বয়সে রাষ্ট্র ক্ষমতায় বসেছেন। ২০২২ সালে সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে তিনি ক্ষমতায় আসেন এবং তার পর থেকে আফ্রিকার বিভিন্ন দেশে এক নতুন নেতার উদয় হয়েছে বলে মনে হচ্ছে। তিনি আফ্রিকার রাজনীতিতে একটি নতুন বিপ্লবী ধারা শুরু করেছেন, এমন মতও দিয়েছেন অনেকে।

ত্রাওরে শুরু থেকেই পশ্চিমা সাম্রাজ্যবাদ ও নয়া উপনিবেশবাদের বিরুদ্ধে এক শক্ত অবস্থান গ্রহণ করেন। তার বক্তৃতায় তিনি বারবার আফ্রিকার দেশের সম্পদ নিজেদের নিয়ন্ত্রণে নেওয়ার কথা বলেন, এবং আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে নব্য উপনিবেশিকের বিরুদ্ধে কঠিন অবস্থান গ্রহণ করেন। তিনি পশ্চিমের প্রভাব থেকে মুক্তি পেতে রাশিয়ার সঙ্গে এক ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে তোলেন, যা তার সামরিক শাসনের ভিত্তিকে আরও শক্তিশালী করেছে।

এরই মধ্যে, ত্রাওরেকে তুলনা করা হচ্ছে বুরকিনা ফাসোর প্রখ্যাত বিপ্লবী নেতা থমাস সাঙ্কারার সঙ্গে, যিনি আফ্রিকার ইতিহাসে চিরকালীন আইকন হিসেবে স্মরণীয়। সাঙ্কারার মতো ত্রাওরেও আফ্রিকার তরুণদের মধ্যে নতুন আশা এবং আত্মবিশ্বাস সৃষ্টি করেছেন। ত্রাওরেকে এখন ‘আফ্রিকার চে গেভারা’ হিসেবে দেখা হচ্ছে এবং তাকে আফ্রিকার বিভিন্ন দেশের তরুণরা একটি আদর্শ নেতা হিসেবে অনুসরণ করছেন।

ত্রাওরের সমর্থকরা দাবি করেন, তার নেতৃত্বে বুরকিনা ফাসো বর্তমানে একটি নতুন বিপ্লবের মুখোমুখি, যেখানে দেশের সম্পদ নিয়ে বিদেশি শক্তির নিয়ন্ত্রণ কমানো হচ্ছে। তিনি এমন একটি অর্থনৈতিক কাঠামো তৈরি করেছেন, যেখানে বিদেশি খনি প্রতিষ্ঠানগুলোকে ১৫ শতাংশ অংশীদারিত্ব দিতে বাধ্য করা হচ্ছে, এবং দেশীয় জনগণের জন্য প্রযুক্তিগত দক্ষতা বিকাশের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এই পরিবর্তনগুলি বুরকিনা ফাসোর স্বর্ণ খাতে বিপ্লবের সূচনা করেছে এবং বিদেশি খনি কোম্পানির নিয়ন্ত্রণও সরকার গ্রহণ করেছে।

বিভিন্ন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করেন, ত্রাওরের জনপ্রিয়তা তার তরুণ নেতৃত্বের কারণে বৃদ্ধি পেয়েছে। বুরকিনা ফাসোর মতো দেশে যেখানে গড় বয়স মাত্র ১৭.৭ বছর, সেখানে তার মতো তরুণ নেতার উত্থান একটি গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক পরিবর্তনকে প্রতিনিধিত্ব করে।

নেতৃত্বে উঠে আসা: সংকটকে রূপান্তরের হাতিয়ার
জিয়াউর রহমান উঠে এসেছিলেন ১৯৭৫-৭৭ সালের ভয়াবহ রাজনৈতিক শূন্যতা আর অস্থিরতার সময়। যেখানে শেখ মুজিবুর রহমানের হত্যাকাণ্ড, একের পর এক অভ্যুত্থান ও জাতির ভবিষ্যৎ নিয়ে অনিশ্চয়তা প্রেক্ষাপট হয়ে দাঁড়িয়েছিল। ঠিক একইভাবে, ইব্রাহিম ত্রাওরে ২০২২ সালে একাধিক অভ্যুত্থান ও সহিংসতায় জর্জরিত বুরকিনা ফাসোয় নেতৃত্বে আসেন। দুই নেতারই ক্ষমতায় আসা ছিল সেনাবাহিনীর ভেতরের বিদ্রোহ ও জাতীয় প্রয়োজনের এক বিস্ফোরক সংমিশ্রণ।

জাতীয়তাবাদ ও জাতীয় পরিচয়: নতুন সংজ্ঞার নির্মাতা
জিয়াউর রহমান বাংলাদেশের ইতিহাসে ‘বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদের’ প্রবর্তক। ভাষা, ধর্ম, অঞ্চল নির্বিশেষে একটি অন্তর্ভুক্তিমূলক জাতীয় পরিচয়ের ভিত্তি গড়ে তুলেছিলেন তিনি; যেখানে সংখ্যালঘু, উপজাতি, শহরবাসী ও গ্রামবাসী সবাইকেই স্থান দেওয়া হয়েছিল। ত্রাওরে একইভাবে নিজেকে গড়ে তুলছেন একজন প্যান-আফ্রিকান ও জাতীয়তাবাদী নেতা হিসেবে। যিনি ফরাসি ঔপনিবেশিক প্রভাবের বিপরীতে দাঁড়িয়ে আফ্রিকান সম্পদকে আফ্রিকান জনগণের অধিকারে ফিরিয়ে দিতে চান।

জিয়া যেমন বলেছিলেন, ‘আমরা ভাষায় বাঙালি, কিন্তু আমরা সবাই বাংলাদেশি’,  ত্রাওরেও বলছেন, ‘জনগণের স্বাধীনতা ও দেশের সম্পদ বিদেশিদের হাতে যেতে দেওয়া যাবে না। ’ দুই নেতার কাছেই জাতীয়তাবাদ মানে কেবল আবেগ নয়, বরং জনগণের মর্যাদা ও সম্পদের ওপর অধিকার নিশ্চিত করা।

‘বিদ্রোহ’ শব্দে জাতির জেগে ওঠা
মুক্তিযুদ্ধের প্রথম প্রহরে কালুরঘাট বেতার কেন্দ্র থেকে জিয়াউর রহমান বলেছিলেন, ‘We revolt’. এই ঘোষণাই একটি নতুন জাতির আত্মপ্রকাশে সংকেত হয়ে উঠেছিল। যখন জাতি দিশেহারা, স্বাধীনতার মহানায়ক শেখ মুজিবুর রহমান কোনো নির্দেশনা না দিয়ে পাকিস্তানিদের হাতে বন্দী হন। তখন জিয়ার স্বাধীনতার ঘোষণা দেশের মানুষের মধ্যে আলোকবার্তা নিয়ে আসে। ত্রাওরে তার ভাষণে সরাসরি ‘বিদ্রোহ’ শব্দটি ব্যবহার করেননি। তবে তার পুরো রাজনৈতিক কণ্ঠস্বর একটি প্রাতিষ্ঠানিক ও বিদেশি আধিপত্যবিরোধী বিদ্রোহের প্রতিধ্বনি হয়ে উঠেছে। রাষ্ট্রীয় খনিজ সম্পদ উদ্ধার, ফরাসি সেনা সরিয়ে দেওয়া, ও রাশিয়ামুখী কূটনীতি; সবকিছুই সেই বিদ্রোহের পরিণতি।

জনগণের স্বার্থে দৃঢ় অবস্থান
জিয়া ও ত্রাওরে; দুই নেতাই দুর্নীতি, অকার্যকর আমলাতন্ত্র ও রাজনৈতিক দুর্বৃত্তায়নের বিরুদ্ধে দৃঢ় অবস্থান নিয়েছেন। জিয়া যেমন যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশে কৃষি, শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও নারীর ক্ষমতায়নের ভিত্তি গড়েছিলেন, তেমনি ত্রাওরে সেনাশাসক হয়েও জনকল্যাণ ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করাকে অগ্রাধিকার দিয়েছেন। তাদের দুজনের নেতৃত্বেই স্পষ্টভাবে ফুটে উঠেছে— রাষ্ট্র মানে কেবল ভূমি নয়, জনগণের মর্যাদা রক্ষার ব্যবস্থা।

জনগণের ক্ষোভ ও আশা থেকে উঠে আসা জনপ্রিয়তা
জিয়াউর রহমান ও ইব্রাহিম ত্রাওরে; দুই জনের জনপ্রিয়তার ভিত্তিও যেন অভিন্ন: জনগণের ক্ষোভ, হতাশা এবং একটি বিকল্প নেতৃত্বের আশা। জিয়ার সময় মানুষ ছিল রাজনীতিকদের প্রতি আস্থাহীন। তারা ভবিষ্যৎহীন এক সমাজ নিয়ে ভয় পেত। ত্রাওরের সময়ের বুরকিনা ফাসোতেও জিহাদি হুমকি ও বিদেশি আধিপত্যে পরিপূর্ণ। জিয়া এসব মোকাবিলা করেছেন। ত্রাওরের কণ্ঠেও এমন পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার অঙ্গীকার এসেছে।  

এই প্রেক্ষাপটে, তারা নিজেদের শুধু নেতৃত্ব নয়, আস্থা ও আশার প্রতীক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছেন।

বিশেষজ্ঞদের চোখে জিয়া ও ত্রাওরে
বিশেষজ্ঞরা অবশ্য এ দুই নেতার তুলনায় প্রেক্ষাপটের ভিন্নতার কথাও বলেছেন। বাংলাদেশের ক্ষেত্রে ১৯৭১-এর মুক্তিযুদ্ধ ও ভারত-পাকিস্তান উত্তেজনা বড় প্রভাব ফেলেছিল। বুরকিনা ফাসোর ক্ষেত্রে সাহেল অঞ্চলের জঙ্গি সন্ত্রাস, ফরাসি উত্তরঔপনিবেশিক প্রভাব ও প্যান-আফ্রিকান প্রতিরোধ। কিন্তু সবার আগে তাদের মূল দর্শন, ‘দেশ আগে, বিদেশি প্রভাব নয়’। এই জায়গায় তাদের মধ্যে স্পষ্ট মিল রয়েছে।

ত্রাওরের সামরিক পোশাক, দৃপ্ত উচ্চারণ, আর দৃঢ় বার্তা মনে হয় যেন কালুরঘাট থেকে ভেসে আসা জিয়ার সেই কণ্ঠের প্রতিধ্বনি। জিয়া বলেছিলেন, ‘আমরা কুকুরের মতো মরবো না, বরং বাংলা মায়ের যোগ্য নাগরিক হিসেবে মরবো। ’ এমন ভাষাই জনতার মাঝে অদম্য এক আত্মবিশ্বাস জাগিয়ে তোলে, যা ত্রাওরেও সৃষ্টি করতে পেরেছেন। তিনি বলেছেন, ‘আমার দেশ আমার অধিকার’।  

৭ নভেম্বর জিয়াউর রহমান ক্ষমতাসীন হওয়ার আগে বাংলাদেশ এক ভয়াবহ গৃহযুদ্ধের মুখোমুখি হয়। কর্নেল ফারুক ও রশিদের ১৫ আগস্টের ট্র্যাজেডিক অভ্যুত্থান; ৩ নভেম্বর থেকে ৭ নভেম্বর পর্যন্ত সেনা বিদ্রোহ এবং এতে খালেদ মোশাররফ, শাফায়েত জামিলসহ সেনাকর্মকর্তাদের মৃত্যু ও পরে খন্দকার মোশতাকের ক্ষমতা ছাড়ার প্রেক্ষাপট তৈরির মতো অনেক নাটকীয় পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। এরপরে ঘটে সিপাহী বিদ্রোহ। ক্যান্টনমেন্টে সংঘটিত এ বিদ্রোহে সিপাহিরা বন্দী জিয়ার মুক্ত করে বসান ক্ষমতার প্রাদপ্রদীপে।  

সেনা বিদ্রোহ দমন ও দেশ গঠনে খুব দ্রুত সিদ্ধান্ত নেন জিয়া। দেশে শৃঙ্খলা ফেরে। এরপর দেশ গঠনে জিয়ার নতুন উদ্যোর আজকের ত্রাওরের কথা মনে করিয়ে দেয়। জিয়ার প্রতিটি ভাষণই যেন প্রতিদ্বন্দ্বিত হচ্ছে ২০২৫ সালের ত্রাওরের কণ্ঠে। দেশের স্বাধীনতা রক্ষা ও জনগণের মুক্তির আন্দোলনে জিয়ার মতোই ঝাঁপিয়ে পড়েছেন ইব্রাহিম ত্রাওরে।

জিয়াউর রহমান আজও বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদের প্রতীক। ইব্রাহিম ত্রাওরে কি হতে পারেন আফ্রিকার নতুন জিয়া? গুরুত্বপূর্ণ এ প্রশ্নের সঠিক উত্তর ভবিষ্যৎ দেবে। তবে সাধারণ চোখে দেখলে, ত্রাওরে যদি তার দেশের জনগণের মর্যাদা রক্ষা করতে পারেন, তবে ইতিহাসে তিনিও হয়তো নিজ জাতির জিয়া হয়ে উঠবেন।

এমজে

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।