ঢাকা, রবিবার, ৯ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৪ নভেম্বর ২০২৪, ২২ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

মুক্তমত

একজন ‘সম্মানিত নাগরিক’-এর খোঁজে!

এরশাদুল আলম প্রিন্স, আইন ও মানবাধিকার সম্পাদক | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৬১০ ঘণ্টা, অক্টোবর ২৭, ২০১৩
একজন ‘সম্মানিত নাগরিক’-এর খোঁজে!

ঢাকা: দেশে সংবিধান নিয়ে যতে আলোচনা হয়, সম্ভবত পৃথিবীর আর কোনো দেশেই তা হয়না। এখানে কোনো সরকার ক্ষমতায় এসেই সংবিধান সংশোধনকে তাদের পবিত্র দায়িত্ব হিসেবে মনে করে।



এ ধারাবাহিকতাতেই দেশে এ পর্যন্ত ১৫টি সংশোধনী হয়েছে এবং আজ পর্যন্ত কোনো একটি সংশোধনীতেও পুরোপুরি জনমতের প্রতিফলন হয়নি। বরং প্রতিটি সরকার তাদের রাজনৈতিক এজেন্ডা বাস্তবায়নের লক্ষ্য হিসেবে সংবিধান সংশোধন করেছে।

সরকার ক্ষমতায় এসে তাদের রাজনৈতিক এজেন্ডা বাস্তবায়ন করতে গিয়ে সংবিধানের যতটুকু সংশোধনের প্রয়োজন হয়, ততটুকুতেই হাত দেন। আগামী দিনের বাংলাদেশের দিকে তাকিয়ে তারা সংবিধান সংশোধন করেন না।
 
এ বিষয়গুলো কেবল পঞ্চদশ সংশোধনীর ক্ষেত্রেই নয়, অতীতের (দুই-একটি বাদে) সব সংশোধনীর ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য।

চতুর্দশ সংশোধনী থেকে পঞ্চদশ সংশোধনীতে উত্তরণের পেছনেও বতর্মান সরকারের সেই রাজনৈতিক আকাঙ্ক্ষাই কাজ করেছে। বিরোধীদলের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিও তাদের সেই পুরনো ও সংকীর্ণ রাজনৈতিক চিন্তা-চেতনারই বহির্প্রকাশ।

যদি তা না হতো, তাহলে পঞ্চদশ সংশোধনীর আরো বহু বিষয় রয়েছে যেগুলো সংশোধন করার দাবি তারা তুলতেন। কিন্তু, সেই বৃহৎ পরিসরে সংবিধান সংশোধনের কথা কেউ বলছেন না। সে কাজটি করলে গণতন্ত্র বেগবান হতো। গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলো শক্তিশালী হতো ও  সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানগুলো হতো গণমুখী।
 
বতর্মান সাংবিধানিক সংকটের মূল বিষয় ‘নির্বাচনকালীন সরকার’। বিষয়টি কেবল তত্ত্বাবধায়ক সরকার বিলুপ্ত করা বা না করার মধ্যেই নয়; সেটি বড়জোর বিরোধীদলের দাবি হতে পারে। কিন্তু পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে অনেকগুলো গুরুতর রাজনৈতিক সমস্যা ও সেই সঙ্গে সাংবিধানিক সংকটেরও সূচনা হয়েছে। রাষ্ট্র ও গণতন্ত্রের কথা বিবেচনায় নিয়ে একটি ভবিষ্যতমুখী সংবিধানই হয়ত এসব সমস্যার সুরাহা করতে পারবে।

তবে বিদ্যমান রাজনৈতিক সংকটের সূচনা এই সংবিধানের আলোকেই হতে পারে, যদি দুই দলই জনগণের আসল দাবিকে মূল্যায়ন করে।

জনগণ চায় একটি শান্তিপূর্ণ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের মাধ্যমে রাষ্ট্র ক্ষমতার পরিবর্তন।    

বিরোধীদল জনগণের এ দাবিকে ‘তত্ত্বাবধায়ক সরকার’র দাবি হিসেবে অনুবাদ করে নিয়েছে। এটি বিরোধীদলের মূলত একটি রাজনৈতিক কর্মসূচি এবং নিঃসন্দেহে এটি তাদের রাজনৈতিক সীমাবদ্ধতা।

আবার সরকার তাদের সংশোধিত সংবিধান ও অধীনস্ত প্রশাসনের অধীনে যে নির্বাচন করতে চায়, তাও তাদের রাজনৈতিক অদূরদর্শীতারই ফল। কারণ, আমাদের গণতন্ত্র এখনো যথেষ্ট প্রাতিষ্ঠানিকরূপ লাভ করেনি। প্রশাসন ও রাষ্ট্রের অন্যান্য প্রতিষ্ঠানগুলোও দল ও সরকার নিরপেক্ষ হতে পারেনি।

মাননীয় প্রধানমন্ত্রী এ রকম একটি রাজনৈতিক উপলব্ধি থেকেই জাতির উদ্দেশে তার ভাষণে বিরোধীদলকেও নির্বাচনকালীন সরকারে অংশীদারিত্ব দেওয়ার অঙ্গীকার করেছেন। প্রধানমন্ত্রীর এ অবস্থান আগের অবস্থান থেকে ভিন্নতর এবং একই সঙ্গে এটি সংবিধান সম্মতও বটে।

প্রধানমন্ত্রীর প্রস্তাব নিঃসন্দেহে সরকারের পক্ষে একটি বড় ছাড় আর বিরোধীদলের জন্য তা না চাইতেই অনেক বড় পাওয়া। তাঁর এ প্রস্তাবের ফলে আলোচনার পথ উন্মুক্ত হয়েছে। যদিও বিরোধী দল বলছে, প্রধানমন্ত্রীর ভাষণে অনেক কিছুই অস্পষ্ট। খুবই স্বাভাবিক। কারণ, প্রধানমন্ত্রী একটি প্রস্তাবমাত্র দিয়েছেন। আলোচনার মাধ্যমেই অস্পষ্ট বিষয়গুলো সুনির্দিষ্ট করা সম্ভব। কিন্তু বিরোধীদল সে প্রস্তাবে কোনো রকম কর্ণপাত না করেই একটা পাল্টা প্রস্তাব দিয়েছে।

অন্যদিকে, প্রধানমন্ত্রীর ভাষণে কয়েকজন আইনজ্ঞ ও বিশেষজ্ঞরা শতকরা ৯৫ ভাগ সমস্যার সমাধান খুঁজে পেয়েছেন। আসলে তারা বাস্তবতার বাইরে গিয়ে আবেগপ্রবণ হয়ে এ রকম মন্তব্য করেছেন। কারণ, আমাদের সংবিধান ও রুলস অব বিজনেস এ ব্যাপারে খুবই কট্টর। সে আলোচনায় পরে আসছি।

তার আগে, বিরোধীদলীয় নেতার প্রস্তাবটি একটু উল্লেখ করা প্রয়োজন। তাঁর প্রস্তাবের দুটি দিক আছে। প্রথমত, তিনি ১৯৯৬ ও ২০০১ সালের তত্ত্বাবধায়ক সরকার থেকে দুই দল কর্তৃক মনোনীত সমসংখ্যক সদস্যদের নিয়ে অন্তর্বর্তী সরকার গঠন করার প্রস্তাব করেছেন। দ্বিতীয়ত, অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান হিসেবে তিনি একজন ‘সম্মানিত নাগরিক’কে মনোনীত করার প্রস্তাব করেছেন।

খালেদা জিয়ার বক্তব্যের প্রথম অংশে তিনি তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিই তুলে ধরেছেন। বলা বাহুল্য, তার এ প্রস্তাবটি নাগরিক সমাজ গ্রহণ করতে পারেনি। এমনকি তার দলের ও জোটের অনেকেই এ প্রস্তাবে বিব্রত হয়েছেন। কারণ, এটি বাস্তবসম্মত নয়ই। এমনকি বিরোধী দলের নেতা নিজেই এটি বাস্তবায়ন করতে পারবেন কিনা সন্দেহ।  

বিরোধীদলের নেতার বক্তব্যের দ্বিতীয় অংশটিই বতর্মান সমস্যার মূল কেন্দ্র। বিরোধীদলের নেতা এ বিষয়টি সুস্পষ্ট করেছেন ‘সম্মানিত নাগরিক’ নিয়োগের প্রস্তাব করে। আর প্রধানমন্ত্রী এ বিষয়ে কিছুই বলেননি। ফলে, এখানে আলোচনা ও দেন-দরবারের সুযোগ রয়েছে।

প্রধানমন্ত্রী এ বিষয়টি সচেতনভাবেই উল্লেখ করেননি। আর বিরোধীদলীয় নেতা এ বিষয়ে একটি প্রস্তাব দিয়েছেন। কাজেই, একজন ‘সম্মানিত নাগরিক’ পেলেই বিরোধী দল নির্বাচনে যাবে; যদি তাঁর বক্তব্যকে জাতির উদ্দেশে প্রতিশ্রুতি হিসেবে গ্রহণ করি! যদিও রাজনীতিতে শেষ কথা বলে কিছুই নেই!

কাজেই, সমস্যাটি অন্তবর্র্তী সরকারের প্রধান কে হবেন, সেটি নিয়ে। এ সমস্যার সমাধান হলে বোধ করি আসন্ন নির্বাচনকেন্দ্রিক সমস্যার আপাত একটি সমাধান হবে; যদি বিরোধীদল মাঠ গরম রাখার রাজনীতি না করে।
    
সংবিধান অনুযায়ী, প্রজাতন্ত্রের সকল ক্ষমতা প্রধানমন্ত্রীর ওপর ন্যস্ত। সংবিধানের ৫৬ অনুচ্ছেদ প্রধানমন্ত্রীকে সর্বময় ক্ষমতা দিয়েছে। তাই, অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে কে দায়িত্ব পালন করবেন, সেটিই আলোচ্য বিষয়। সংসদ থেকে ওয়াকআউট করে এম কে আনোয়ারও সে বক্তব্যই তুলে ধরেছেন। আমরা ধরে নিতে চাই, বিরোধী দলের আন্দোলনের মূল বিষয়ও এটি।

শুধু সংবিধান নয়, রুলস অব বিজনেসও প্রধানমন্ত্রীকে সর্বময় ক্ষমতা প্রদান করেছে। তাই, বিরোধীদল প্রধানমন্ত্রীকে তাঁর পদে বহাল রেখে বা তার ক্ষমতাকে বিকেন্দ্রীকরণ না করে নির্বাচনে যেতে অনিচ্ছুক। সেই সঙ্গে প্রশাসন ও রাষ্ট্রযন্ত্র তো আছেই।

কিন্তু, এ সমস্যার সমাধানও সম্ভব সংবিধান মেনেই এবং তা করতে হবে সংসদ বহাল থাকতেই।    

৫৬ (৩) অনুচ্ছেদ অনুযায়ী, রাষ্ট্রপতি যে সংসদ-সদস্যকে সংসদের সংখ্যাগরিষ্ঠ সদস্যের আস্থাভাজন বলে মনে করবেন, তিনি তাঁকে নিয়োগ প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নিয়োগ দেবেন।

আমাদের সাংবিধানিক প্রথা অনুযায়ী, সাধারণত নির্বাচনের পর যে দল সর্বাধিক আসন পায়, ওই দলের প্রধানকে রাষ্ট্রপতি সরকার গঠনে আমন্ত্রণ জানান এবং স্বাভাবিকভাবেই তিনি প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।  

তবে, সংসদের কাছে আস্থাভাজন কে, সেটি সংসদের সব সদস্যরা মিলেও ঠিক করতে পারেন। তাই, সংসদের সব সদস্য (সরকার ও বিরোধীদলের) যদি সংবিধানের ভাষায় একজন ‘আস্থাভাজন’ ও বিরোধী দলের নেতার ভাষায় একজন ‘সম্মানিত ব্যক্তি’কে মনোনীত করেন, তাহলে সংকটের সমাধান সম্ভব। কারণ, বিরোধীদলের নেতা ‘সম্মানিত ব্যক্তি’যে অনির্বাচিত ব্যক্তি হতে হবে, এমন কথা বলেননি। তিনি সংসদ সদস্যও হতে পারেন। আবার প্রধানমন্ত্রী তাঁর ভাষণে তিনি যে প্রধানমন্ত্রীর পদে কোনো ছাড় দেবেন না, এমন কথা বলেননি। বরং এখন তো শোনা যাচ্ছে, প্রধানমন্ত্রী তাঁর পদ থেকে সরে যেতে পারেন।

তাই, ৫৬ অনুচ্ছেদই সংকটের কারণ ও এ অনুচ্ছেদের মাধ্যমেই সমাধান সম্ভব। তবে তা করতে হবে সংসদ বহাল থাকাবস্থাতেই।

আমরা কি সংসদ বা সংসদের বাইরে একজন ‘সম্মানিত নাগরিক’কে খুঁজে পাবোনা?

বাংলাদেশ সময়: ১৬০০ ঘণ্টা, অক্টোবর ২৭, ২০১৩
এবি/জিসিপি

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।