ঢাকা, রবিবার, ৯ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৪ নভেম্বর ২০২৪, ২২ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

মুক্তমত

আমরা ৭১’র মতো আপোষহীন

ড. ফরিদ আহমেদ | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১২২২ ঘণ্টা, অক্টোবর ৩১, ২০১৩
আমরা ৭১’র মতো আপোষহীন

মেলবোর্ন মেট্রো ট্রেনে বসে ভাবছিলাম মেলবোর্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের লিঙ্কন স্কয়ারে বসে আমার বাংলা মায়ের কথা ভাববো এবং সেখানে বসেই এবার লিখব। কারণ বাংলাদেশে গণতন্ত্র বিষয়টি আবার জটিল হয়ে উঠেছে।



মেলবোর্নে এখন বসন্ত। তথাপি একটি সুন্দর দিনের অপেক্ষায় ছিলাম। কারণ গত ক’দিন মেঘ আর বৃষ্টি, সেই সঙ্গে দক্ষিণ মেরু থেকে আসছে শীতল বাতাস। এবার প্রকৃতি যেনো একটু অন্যরকম। কিছুদিন পরেই সামার। গাছপালা আবার সবুজ পাতায় ও রঙিন ফুলে ভরে গেছে। এক অদ্ভুত সুন্দর যেনো এ পৃথিবী!

যারা দাবি করেন মেলবোর্ন বিশ্বের সেরা শহর তারা সত্যি কথাটাই বলেন। তবে এত সুন্দরের মাঝেও মনটা ছুটে যায় বাংলাদেশে। আমার দেশও এমন সুন্দর ছিলো!  খুব কষ্ট হলেও বলতে হলো মেলবোর্ন সুন্দর, মানতে হলো বাংলাদেশ এর চেয়েও সুন্দর ছিলো। সেই যে পাকিস্তানি হানাদাররা পুড়িয়ে দিলো, আর বুঝি আমরা ফিরে পেলাম না বাংলা মায়ের সেই সবুজ-সোনালী-কোমল শান্তির বুক। যেখানে মাথা পেতে নিশ্চিন্তে ঘুমাতে পারি।

গত কয়েক দিন বিক্ষিপ্ত বৃষ্টি বসন্তের আমেজ নষ্ট করে দিচ্ছে। তথাপি এদেশের মানুষ খুশি। কারণ মিষ্টি পানির অভাব আছে দেশটিতে। বৃষ্টিকে তাই সব সময় সুস্বাগতম। মিষ্টি পানি- এই একটি জিনিশের অভাব আমার বাংলা মায়ের ছিলো না। এখন সার-কীটনাশক-ফারাক্কাপ্রভাব-ট্যানারি ও গার্মেন্টস বর্জ্য সেটিকে ধ্বংস করে দিচ্ছে।

ভাবছিলাম আধুনিক দর্শনের জনক রেনে ডেকার্টের সংশয় পদ্ধতি প্রয়োগ করে বাংলাদেশ নিয়ে ভাববো আর লেখার চেষ্টা করবো। কারণ ইতোমধ্যে আবার ধ্বংসের হরতাল শুরু হয়েছে। প্রধানমন্ত্রীর ফোন কোনো প্রভাব বিরোধীদলীয় চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার মধ্যে পড়েনি। তিনি বলিষ্ঠ কণ্ঠে ‘না’ বলেছেন।

ইতোমধ্যে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের পরীক্ষা স্থগিত হয়েছে। সব স্কুল কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ। তবে বিদেশি ডিগ্রি পরীক্ষা চলবে! হরতালেও ধনীরা মাফ পাবেন!! জননেত্রী বটে।

নিজেকে প্রশ্ন করেছি আর জানতে চেষ্টা করেছি- এভাবে কি একটি জাতি চলতে পারে? একবার বাঙালি, আরেকবার বাংলাদেশি! একবার বঙ্গবন্ধু, আরেকবার জিয়া। একবার দেশনেত্রী, আরেকবার জননেত্রী। আমরা জনগণ এভাবে আর কত নিষ্পেষিত হব? আব্রাহাম লিঙ্কন কি এই গণতন্ত্রের জনক? যদি গণতন্ত্র মানে হরতাল দিয়ে নিপীড়ন হয়, তবে আমরা কি ওই গণতন্ত্র চাই?
 
বেশ শীত। গুড়ি গুড়ি বৃষ্টি। তাই নেমেছি প্রশান্ত মহাসাগরের পাড়ে নর্থ মেলবোর্ন রেল স্টেশনে। সেখানে দাঁড়িয়ে শহরটাকে যেমন দেখা যায় তেমনি প্রশান্ত মহাসাগর। মেলবোর্ন রেল স্টেশনের প্ল্যাটফর্মে দাঁড়িয়ে প্রশান্ত মহাসাগরের দিকে তাকিয়ে ভাবছি- আমরা গণতন্ত্র চাই, আবার উন্নয়নও চাই। আবার রাজাকার মুক্ত বাংলাদেশ চাই। এসব যেমন চাই, তেমনি চাই নিরপেক্ষ নির্বাচনকালীন সরকার যা বারবার ব্যর্থ হয়েছে।

কোথাও গিয়ে থামতে হয়। হিলারী বুদ্ধিমতি। তিনি থেমেছেন। তিনি ওবাবমাকে ২০০৮ সালের দুই জুলাই পর্যন্ত চ্যালেঞ্জ করেছেন। অতঃপর থেমেছেন। ওবামা দ্বিতীয় দফায় দেশের রাষ্ট্রপতি হয়েছেন, এবং রাষ্ট্রপতি পদে থেকেই রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হয়েছেন।

জনগণ যদি চায় তবে বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আবার প্রধানমন্ত্রী হবেন। কেন বিরোধীদলীয় নেত্রী খালেদা জিয়া সেখানে অন্তরায় হয়ে দাঁড়াবেন? কেন সুশীল সমাজ একটি ভুল পথে দেশকে নিয়ে যাবেন? কেন খালেদা জিয়া বিজয়ের পথ তৈরিতে যুদ্ধাপরাধীদের মুক্তির দাবি করবেন ঐতিহাসিক রেসকোর্স ময়দানে দাঁড়িয়ে? কেন একটি স্বাধীন দেশের অগ্রযাত্রায় ৬০ ঘণ্টা হরতালের ডাক দেবেন এবং সমগ্র দেশকে একটি বিশাল জেলখানায় পরিণত করবেন? এটা কি দেশপ্রেম না ক্ষমতা প্রেম?  

স্টেশন ছেড়ে বাসে চড়লাম। বিশ্ববিদ্যালয় সার্ভিস। বাস গিয়ে থামবে লিঙ্কন স্কয়ারে। আমি আবার ভাবছি- আমরা জানি খালেদা জিয়া বীরাঙ্গনা সম। তিনি ১৯৭১ সালে সেনানিবাসে বন্দি জীবনযাপন করেছেন। তিনি সন্তানদের নিয়ে সেই সময় কষ্টে দিন কাটিয়েছেন। বিগত ৬ বছর তিনি পরিবার থেকে বিচ্ছিন। সরকারের দায়িত্ব খালেদা জিয়ার (যার প্রায়ত স্বামী একজন মুক্তিযোদ্ধা সেক্টর কমান্ডার ছিলেন- যার অবদান কোনো অংশেই কম নয় মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনা ও দেশ গড়ায়) জন্য একটি ব্যবস্থা করা যাতে তিনি আবার পরিবারের সঙ্গে মিলিত হতে পারেন। একজন লন্ডন আর আরেকজন থাইল্যান্ড। তিনি বাংলাদেশে। সবাইকে যাতে একসঙ্গে পান সেজন্য সরকারের উচিত লন্ডনে সবার জন্য চিরস্থায়ী বসবাসের সুযোগ করে দেওয়া অথবা তারেক ও আরাফাত রহমানকে দেশে ফিরে আসতে অভয় দেওয়া। সেক্ষেত্রে সরকার নিরপেক্ষ থাকবে। কোনোভাবেই বিচার প্রক্রিয়াকে প্রভাবিত করবেন না এবং যতদিন ওনাদের অপরাধ প্রমাণিত না হবে ততদিন কোনো হয়রানির শিকার হবেন না। সরকার যদি এমন একটি অফার বেগম জিয়াকে দিতে পারেন তবেই হয়তো একটি ঐকমত্য প্রতিষ্ঠা সম্ভব হবে।

এমন অফার খালেদা জিয়া নেবেন কি? হয়তো বলবেন- না- আমি দেশকে ভালবাসি। বিদেশে আমার কেউ নেই। এই কেউ মানে আমরা নই- এই কেউ হল রাজাকার-আলবদর-আলশামস- শিবির-যুদ্ধাপরাধী। তিনি তাদের ভালোবাসেন। বন্ধু ভাবেন। বিশ্বাস করেন। তিনি কোথাও যাবেন না।

সরকার কেবল এক তরফা সহযোগিতা দিলেই চলবে?  খালেদা জিয়াকেও কি বলতে হবে  না তিনি যুদ্ধাপরাধীদের পক্ষ কখনোই নেবেন না। তিনি আর কোনোদিন হরতাল দেবেন না। তিনি জনগণের জন্য জনগণের পাশে থাকবেন।

তিনি জাতির কাছে প্রতিশ্রুতি দেবেন ক্ষমতায় গেলে আবার সংবিধানে কাঁটাছেড়া করবেন না। জাতির জনকের নাম মুছে দিতে মাঠে নামবেন না, তিনি ১৫ আগস্ট জাতির জনকের মাজারে গিয়ে শ্রদ্ধা জানিয়ে তবে কেক কাটবেন।

জম্মদিন পালনের অধিকার সবারই আছে, তবে সেটি কাউকে আঘাত করতে নয়। আমরা প্রতিটি জম্মদিন সুন্দরভাবে পালন করতে চাই, তেমনি সব হত্যাকাণ্ডকে নিন্দা জানাতে চাই। আমরা জিয়াকে আর খুনি বলে অভিযুক্ত করবো না, আমরা বলবো না ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলায় তারেক রহমান জড়িত ছিলেন।

ইতোমধ্যেই লিঙ্কন স্কয়ারে পৌছে গেছি। লিঙ্কন স্কয়ার। অনেকগুলো বটগাছ। সবচেয়ে বড় গাছটির নিচে দাঁড়ালাম। মনে পড়লো রমনা বটমূল। সেখানেও পহেলা বৈশাখে হামলা। মনে পড়লো প্রিয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বটতলা। সেখানে ১৯৮২-৮৩তে এরশাদের হামলা। আমি ভাবছি দেশকে নিয়ে।   এইমাত্র যা ভেবেছিÑ জানি এমনটি হবে না। কারণ একথা সত্য জাতির জনক বঙ্গবন্ধুকে টেক্কা দিয়ে মেজর জিয়া ১৯৭১ সালে রাষ্ট্রপতি ও মুক্তিযুদ্ধের ঘোষক হতে চেয়েছিলেন। তিনি সেদিন ব্যর্থ হয়ে ষড়যন্ত্রকারীদের হাত মিলিয়ে  ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুর হত্যাকাণ্ডের দায় গ্রহণ করেছেন এবং দেশে অবৈধ্য শাসনের দ্বার উম্মোচন করেছেন এবং সেই পথে এরশাদ-মঈন হেঁটেছেন।

তিনি যতদিন ক্ষমতায় ছিলেন ততদিন পত্রিকার পাতায় বঙ্গবন্ধুর নামটিও ছাপা যেতো না। আমরা কি করে ভুলে যাব জেলে চার নেতার হত্যার কথা, কেন ভুলে যাব কর্নেল তাহেরকে হত্যা করার বিষয়টি? কেন ভুলে যাব আমরা জেনারেল মঞ্জুর হত্যা ও ১২ জন সামরিক অফিসারের ফাঁসির কথা!

সেদিনতো খালেদা জিয়া ওই ১২ জন সামরিক অফিসারকে বাঁচাতে আসেননি। তিনি জেদ ও লোভ তাড়িত হয়ে ১২ ফেব্রুয়ারি একক নির্বাচন করেছেন। তিনি কিভাবে ২৫ ফেব্রুয়ারির হত্যাকাণ্ডের দায় এড়াবেন? কারণ তিনি আবারও বলেছেন ক্ষমা করে দিয়েছি। কিন্তু তিনি ক্ষমা চাননি। তিনি কোনদিন বলেননি ১৫ আগস্ট যারা বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করেছিল তারা খুনি।

আবার ঝম ঝম করে বৃষ্টি এল। আমার আর বটতলায় বসে ভাবা হলো না। তবে যাওয়ার আগে চিৎকার করে বললাম- লিঙ্কন, আমরা ওই বাংলাদেশ আর চাই না যেখানে রাজাকার ও খুনি শাসকের আসনে বসে। ১৯৭১ সালে যেমন আমরা আপোষহীন ছিলাম তেমনি চিরদিন আপোষহীন থাকবো গণতান্ত্রিক সরকারের জন্য। লিঙ্কন তোমাকে ধ্যবাদ, বঙ্গবন্ধু তোমাকে অভিবাদন।     

লেখক: অধ্যাপক ফরিদ আহমেদ, দর্শন বিভাগ
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
farid_ahmed_ss@yahoo.com

বাংলাদেশ সময়: ১২২১ ঘণ্টা, অক্টোবর ৩১, ২০১৩
এসএটি/জিসিপি

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।