ঢাকা, রবিবার, ৯ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৪ নভেম্বর ২০২৪, ২২ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

মুক্তমত

‘স্বপ্নের গাড়ি’ বাঁচান

রফিকুল বাহার | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১১৫৩ ঘণ্টা, নভেম্বর ১, ২০১৩
‘স্বপ্নের গাড়ি’ বাঁচান

প্রায় ১৬ কোটি জনসংখ্যার ছোট্ট বাংলাদেশের ৬৪টি জেলার একটি হলো এই চট্টগ্রাম। রাজধানী ঢাকার পর চট্টগ্রামকে গুরুত্ব দেওয়া হয় অনেক কারণে।



দেশের প্রধান সামুদ্রিক বন্দর এখানে; ২. দেশের আমদানি-রপ্তানি বাণিজ্যের প্রায় ৯০ শতাংশই এ চট্টগ্রাম দিয়ে আনা-নেওয়া হয়; ৩. দেশের শীর্ষ পর্যায়ের ব্যবসায়ী-শিল্পপতিরাও থাকেন এ অঞ্চলে; ৪. জাতীয় বাজেটের মোট রাজস্ব আয়ের এক-চতুর্থাংশও আয় হয় এই চট্টগ্রাম থেকে।

ফলে দেশের ৬৪ জেলার মধ্যে চট্টগ্রাম একটি জেলা হলেও গুরুত্ব বিবেচনায় এটি আসলে অন্যতম প্রভাবশালী এক অঞ্চল। একটি জেলার এতগুলো গুরুত্বের কথা এই লেখায় তুলে ধরার একটি কারণ রয়েছে। অনেক কষ্ট ও বেদনা নিয়ে এ লেখা লিখতে হচ্ছে। গত বুধবার সন্ধ্যার পর নগরীর জিইসি মোড়ে সরকারি দলের ছাত্র সংগঠনের অর্থাৎ ছাত্রলীগের পদবঞ্চিত নেতা-কর্মীরা রাস্তায় নেমে সাধারণ মানুষের অন্তত ৩০টি গাড়ি ভাঙচুর করেছে, ৪টি মোটরসাইকেল জ্বালিয়ে দিয়েছে।

গত ৬০ ঘণ্টার হরতালেও প্রচুর গাড়ি ভাঙচুর ও জ্বালা-পোড়াও দেখেছি আমরা। প্রধান বিরোধী দল বিএনপি ও ১৮ দলের শরিক জামায়াত-শিবির কর্মীরা দাবি আদায়ের অযুহাতে সমানে বিভিন্ন এলাকায় প্রচুর গাড়ি ভাঙচুর করেছে।

এই সন্ত্রাসী তাণ্ডবে দু’টি বিষয় খুবই গুরুত্বপূর্ণ। একটি হল যারা ভেঙ্গেছে তারা হলো বিভিন্ন দলের রাজনৈতিক কর্মী। রাজনীতির দীক্ষা নিয়ে আগামীতে দেশ চালানোর স্বপ্ন দেখছেন। ভবিষ্যতে তাদের জীবনে থাকবে জেল-জুলুম-হুলিয়া, দমন-পীড়ন। কিন্তু এতো কিছুর পরে এই রাজনৈতিক কর্মীদের জীবনের লক্ষ্য হলো একটাই ‘মানবসেবা ও দেশকে এগিয়ে নেয়া’। আরেকটি পক্ষ হলো ক্ষতিগ্রস্ত গাড়ির মালিকরা। এই গাড়ি মালিকদেরকেও কেউ চাকরিজীবী, কেউ ব্যবসায়ী, কেউ পেশাজীবী। তাদের অনেক কষ্ট আর আরাধনার বস্তু হল এই ভেঙ্গে দেওয়া গাড়িটি। দেশের একজন সাধারণ নাগরিক হিসেবে অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে দায়-দেনা করে কিংবা জমানো টাকা ভেঙ্গে একটি গাড়ি কেনে। গরীব এই রাষ্ট্রের এসব সাধারণ নাগরিকের কাছে সারা জীবনের দু’টি স্বপ্ন থাকে। এর একটি হলো গাড়ি, অপরটি বাড়ি। গাড়ি-বাড়ির স্বপ্ন দেখা এসব মানুষের গড় আয়ু ৭০ বছর (সূত্র: জাতিসংঘ)।

৭০ বছরের জীবনে একটি গাড়ির মালিক হতে একজনকে অপেক্ষা করতে হয় ৩০ থেকে ৪০ বছর। শিক্ষা জীবন শেষে কেউ করেন চাকরি, কেউ করেন ব্যবসা। তারপর স্বপ্ন বুনতে থাকে গাড়ি-বাড়ির। একটি গাড়ি কিনতে জীবনের অর্ধেক সময় পার করে দিতে হয় তাকে।

রাজনৈতিক কর্মীরা কিংবা রাজনীতিবিদরা সাধারণ মানুষের ও দেশের কল্যাণের কথা বলে মানুষকে নিজের দলে ভেড়াবার ও আকৃষ্ট করবার প্রাণান্তকর চেষ্টা চালায়। সে প্রাণান্তকর চেষ্টার মধ্যে এরকম গাড়ি ভাঙারও উৎসব থাকে। গাড়ি ভাঙার এ ঘটনাকে তাদের চোখে এক ধরনের উৎসবের মতই। একবারও ভাবে না যে মানুষের স্বপ্ন ভেঙ্গে খান খান করে দিচ্ছে তারা।

আমাদের রাজনীতিতে এসব কর্মীর সম্পদ-চেতনা কিংবা সম্পদ-ভাবনা নিয়ে কোন ধরনের শিক্ষা দেয়া হয় না। নেই কোনো দিক-নির্দেশনাও। এখন থেকে ২৫ বছর আগে ৯০ সালে স্বৈরাচারী এরশাদবিরোধী আন্দোলনে এ ধরনের গাড়ি ভাংচুর, জ্বালা-পোড়াও শুরু হয়েছিল। ২৫ বছর আগের সে-ই রাজনৈতিক কৌশল এখনও অনুসরণ করছে রাজনৈতিক কর্মীরা। তাদেরকে এই প্রশ্নটি করা যেতে পারে, ২৫ বছর তো অনেক সময়। এই দীর্ঘ সময়ে রাজনীতিতে কী ধরনের গুণগত পরিবর্তন আনতে পেরেছে রাজনীতিবিদরা? ছাত্রলীগের কমিটিতে কে থাকবে আর কে থাকবে না এ ধরনের সাধারণ এক বিষয়ে সাধারণ নাগরিকের ভাববারও সময় নেই, ভাবার কোন যুক্তিও নেই।

নেতাদের মাঠ গরম করা বক্তৃতা শুনে দলীয় কর্মী ও অনুসারীরা কি এই শিক্ষাই পায়-‘ভাঙচুর কর যখন-তখন’? এই ভাঙচুরের কোনো বিচার নেই, শাস্তিও নেই। তাহলে রাজনীতি মানুষকে এমন অধিকারও দিয়েছে এদেশে! না, দেয়নি। রাজনীতিবিদরাও বলবেন না সে কথা। এ যেন সাধারণ মানুষের সঙ্গে লুকোচুরি খেলা।

আমরা বিনীত অনুরোধ করতে চাই এদেশের রাজনীতিবিদদের কাছে বিশেষভাবে চট্টগ্রামের শীর্ষ পর্যায়ের চার রাজনীতিবিদের কাছে। এরা হলেন : সরকারি দল আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেন এমপি, চট্টগ্রাম মহানগর কমিটির সভাপতি এ বি এম মহিউদ্দিন চৌধুরী, বিরোধী দল বিএনপির কেন্দ্রিয় সহ-সভাপতি আবদুল্লাহ-আল নোমান ও চট্টগ্রাম মহানগর বিএনপির সভাপতি আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী। এদের প্রত্যেকেরই বয়স ৬০ বছরের উপরে। দীর্ঘ রাজনৈতিক জীবন। ক্ষমতায় থেকে দেশ চালানো ও প্রশাসন চালানোর অভিজ্ঞতা যেমন আছে তেমনি মাঠ গরম রাখার দক্ষতা ও কৌশল তাঁরা জানেন।

চট্টগ্রামের রাজনীতিতে ও উন্নয়নে আপনাদের অনেক অবদান, বিশাল ভূমিকা। নিজের দলে আপনাদের প্রভাব অপরিসীম। সাধারণ মানুষের সম্পদ রক্ষায় অর্থাৎ স্বপ্নের একটি গাড়ি বাঁচানোর জন্য আপনারা দলীয় নেতা-কর্মীদের প্রতি বিশেষ দিকনির্দেশনা দিতে পারেন। সমাবেশের বক্তৃতা থেকে অথবা সভা ডেকে আমাদের স্বপ্ন বাঁচানোর নির্দেশ দিয়ে আপনারা বলুন, যারা গাড়ি ভাংচুর করবে, জ্বালাবে ও পোড়াবে তাদেরকে দলে রাখা হবে না। পুলিশের হাতে তুলে দেওয়া হবে। আপনাদের এই নির্দেশ নেতা-কর্মীরা মানবে না এটা জনগণ কখনও বিশ্বাস করে না।

দাবি আদায়ের লড়াই চলবে রাজপথে, মিছিলে-সমাবেশে। প্রতিবাদ ও বিক্ষোভ চলবে মাঠে-ময়দানে। দেশে এত ইলেকট্রনিক মিডিয়া ও সংবাদপত্র। অনায়াসে আপনাদের সেই লড়াই ও বিক্ষোভের সচিত্র খবর দেশব্যাপী প্রচার পাবে। আপনাদের সংবাদ আরো ভালো করে প্রচার করার জন্য প্রয়োজনে সংবাদকর্মীদের সহায়তাও নিতে পারেন। আমার ধারণা এরকম উদ্যোগ নিলে সংবাদকর্মীরাও থাকবেন রাজনীতিবিদদের পাশে।

দেশের নীতি-নির্ধারকদের সুদৃষ্টি প্রাপ্তির দিক থেকে বহুকাল ধরেই চট্টগ্রাম বঞ্চিত। বঞ্চনার ক্ষোভ আমাদের কষ্ট দেয়। আমাদের স্বপ্ন যাতে না ভাঙ্গে সে উদ্যোগ চট্টগ্রামের এই চার নেতা নিতে পারেন। তখন চট্টগ্রামবাসী গর্ব করে জোর দিয়ে অন্যদের বলতে পারবে- দেখ আমাদের চট্টগ্রামের রাজনীতিবিদরা কত পজেটিভ? আমাদের ব্যক্তিগত স্বপ্নের গাড়িগুলো আছে অক্ষত।

রফিকুল বাহার: নির্বাহী সম্পাদক, সুপ্রভাত বাংলাদেশ

বাংলাদেশ সময়: ১১৫১ ঘণ্টা, নভেম্বর ১, ২০১৩
সৌজন্যে: সুপ্রভাত বাংলাদেশ, চট্টগ্রাম/জেডএম/জিসিপি

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।