ঢাকা, রবিবার, ৯ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৪ নভেম্বর ২০২৪, ২২ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

মুক্তমত

আমরা যদি আপনাদের বয়কট করি?

তুষার আবদুল্লাহ, পরিচালক (বার্তা), সময় টেলিভিশন | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৩৩৩ ঘণ্টা, নভেম্বর ২৭, ২০১৩
আমরা যদি আপনাদের বয়কট করি?

মন ভিজে যাচ্ছে। সাংবাদিকতায় এসে চোখের সমুদ্দুর কবেই হয়েছে বালুচর।

দশদিক থেকে যণ্ত্রণায় কাতর সহকর্মীদের কণ্ঠ ভেসে আসছে। একের পর এক হামলার শিকার হচ্ছেন সহকর্মীরা।

১৮ দলীয় জোটের ডাকা অবরোধ কর্মসূচির দ্বিতীয় দিনের সকালে প্রথম খবরটি এলো ঢাকার মিরপুরের কালসী থেকে। সময় সংবাদের রিপোর্টার জাফর সাদিক এবং ভিডিও জার্নালিস্ট পাভেল আক্রান্ত হয়েছেন।

না অবরোধকারীদের হামলায় নয়, অবরোধ বিরোধীদের গণপিটুনির শিকার তারা। আক্রমণকারীদের হাত থেকে লাইভ সরঞ্জাম বাঁচাতে পারলেও রক্ষা করতে পারেননি ক্যামেরাটি। মারাত্মকভাবে আহত দুই সহকর্মী যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছেন হাসপাতালের বিছানায়। তাদের অপরাধ ছিল অবরোধকারীদের উপর ও অবরোধ প্রতিহতকারীদের হামলার ছবি তোলা।

এই দুইজনকে হাসপাতালে পাঠাতে না পাঠাতেই খবর পেলাম বরিশাল ব্যুরোর ক্যামেরাম্যান লাঞ্ছিত হয়েছেন অবরোধকারীদের হাতে। এর কিছুক্ষণ পর চাঁদপুর প্রতিনিধি জানালেন তাকে এবং এস এ টেলিভিশনের রিপোর্টারকে লক্ষ্য করে অবরোধকারীরা বোমা ছুঁড়েছে। অল্পের জন্য তারা প্রাণে রক্ষা পেয়েছেন। নারায়ণগঞ্জে ভাংচুর করা হয়েছে একুশে টেলিভিশনের গাড়ি।

এর আগে সোম ও মঙ্গলবার অবরোধকারীদের ছোঁড়া বোমায় গুরুতর আহত হয়েছেন বাংলানিউজের জাহিদ সায়মন এবং সাজেদা সুইটি। এগুলো চলমান কর্মসূচি’র তথ্য। কিন্তু নিকট অতীতেও দেখেছি বিরোধীদলের আন্দোলনের সহিংসতা যতো তীব্র হয়েছে, বেড়েছে সহিংসতার ভয়াবহতাও ততোই । সাধারণ মানুষের পাশাপাশি সংবাদকর্মীরাও সেই সহিংসতার আগুনে পুড়েছে। গণমাধ্যমকর্মীদের পরিচয়পত্র, স্টিকার আঁটা গাড়ি এবং মাইক্রোফোন, ক্যামেরা দেখেও তারা ঝাঁপিয়ে পড়ছে কখনো গাড়ির, ক্যামেরার বা কখনো সংবাদকর্মীদের উপর।

এই প্রবণতা কেবল রাজধানীতেই নয়। সারাদেশেই গণমাধ্যমকর্মীরা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে কাজ করছেন। যখন বিরোধী দলের পক্ষ থেকে কর্মসূচি ঘোষণা করা হয়, তখন বলা হয় গণমাধ্যমকর্মী এবং তাদের গাড়ি থাকবে হরতালের আওতামুক্ত। সেটা তাদের অন্যান্য প্রতিশ্রুতি বা আশ্বাসের মতোই লোক দেখানো। একের পর এক গণমাধ্যমকর্মীর উপর হামলা তারই প্রমাণ। তাদের অনুসারীদের হামলার শিকার হয়েছেন গণমাধ্যমকর্মী, সেই খবরে দু:খ প্রকাশ করেই তারা দায় সারছেন। জনগণের প্রতি অন্য দায়গুলো যেমনভাবে তারা এড়িয়ে যান, ঠিক সেভাবেই।

অন্যদিকে যারা হরতাল –অবরোধের বিরোধী পক্ষ, তাদের কাছে কি গণমাধ্যম নিরাপদ? মোটেও তা নয়। আসলে কোনো রাজনৈতিক দলের কর্মী’র কাছেই এখন আর কোন গণমাধ্যম নিরাপদ বোধ করছে না। যখন কাভারেজ দরকার তখন পোষা বিড়ালের মতো গণমাধ্যমের কাছে এসে মুখ ঘষতে থাকেন তারা। আর যখন তাদের অপকর্মের কথা গণমাধ্যম তুলে ধরে তখন খামচি দিতে এক মূহুর্ত দেরি করেন না তারা।

হরতাল- অবরোধকারীদের বিরোধী পক্ষ যখন, এসবের সমর্থকদের উপর হামলে পড়ে, সেই ছবি নিতে গেলেই তারা ক্ষেপে ওঠেন গণমাধ্যমকর্মীদের উপর। কারণ তারা এর সচিত্র প্রমাণ থাকুক চান না। কিন্তু গণমাধ্যমকর্মীদের কাছেতো, বিশেষ করে যারা মাঠে থাকেন, সবাই  সমান। তারা তো ছবি নেবেনই। এই ছবি নেয়াটাই পছন্দ নয় নেতা বা কর্মীদের। কিন্তু যখন নিজেদের কর্মসূচি থাকে তখন, ঠিকই নিমন্ত্রণ জানিয়ে, জামাই আদর করে নিয়ে যেতেও পিছিয়ে থাকেন না তারা। কারণ তারা জানেন গণমাধ্যম ছাড়া তাদের সকল কর্মসূচিই বৃথা।

আর এখন তো এই বিষয়টি আরো স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। বিরোধীদল-সরকারি দল সবার রাজনৈতিক কর্মসূচি বন্দি হয়ে পড়ছে চতুর্ভূজ ক্যামেরার লেন্সের মধ্যে। ক্যামেরা নিশ্চিত করেই আজকাল কর্মসূচি শুরু হয়। ক্যামেরা না যাওয়া পর্যন্ত নেতা-কর্মীরাও মাঠে নামেন না। গণমাধ্যম, বিশেষ করে, টেলিভিশনের কল্যাণে সমাবেশের কাজ আজ চার দেয়ালের মধ্যে থেকেই সেরে নিতে পারছেন তারা।

তারপরও কৃতজ্ঞতা দেখানোর মতো উদার মানসিকতা তৈরি হয়নি তাদের। বরং উপকারীর অপকার করার ব্রত নিয়েই রাজনীতির ময়দানে আছেন তারা। সেই তাদের অর্থাৎ রাজনীতিকদেরই বলি: আমরা যদি একযোগে আপনাদের বয়কট করি? তাহলে আপনাদের রাজনীতি-ক্ষমতানীতি’র দৌড় কোন শিকেয় উঠবে ধারণা করতে পারেন? ভাবছেন আপনাদের বয়কট করলে আমরা পাঠক, দর্শক হারাবো? মোটেও তাই নয়। আপনাদের ক্ষমতাকেন্দ্রিক রাজনীতি, এবং আপনাদের সহিংস মূর্তিতে, সাধারণ মানুষের চোখে যে ঘৃণার ছায়া পড়েছে, তা আপনারা দেখতে পাচ্ছেন না, কিন্তু আমরা দেখতে পাচ্ছি।

বাংলাদেশ সময় ১৩১৯ ঘণ্টা, নভেম্বর ২৭, ২০১৩

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।