ঢাকা, রবিবার, ৯ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৪ নভেম্বর ২০২৪, ২২ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

মুক্তমত

সেলিম ভাইয়ের কাছে খোলা চিঠি

অজয় দাশগুপ্ত, অতিথি লেখক | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৫৩১ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ১, ২০১৩
সেলিম ভাইয়ের কাছে খোলা চিঠি

মানুষের প্রতি বিশ্বাস হারানো পাপ। রবীন্দ্রনাথের অমোঘ এই বাণী বিশ্বাস করি।

জানি হানাহানির এই দু:সময়ে এ জাতীয় কথা ভালোলাগার নয়। কিন্তু এটাই শেষ নয়। এখানেই শেষ হয়ে যাবে না আমাদের বাংলাদেশ। আমাদের বিশ্বাস করতে হবে মানুষ-ই একমাত্র প্রাণী যে ঘুরে দাঁড়াতে জানে। যার মগজ আছে, যে ভাবতে জানে, এখন পর্যন্ত ভাবনা ও অ্যাকশন এক হচ্ছে না বলে আমরা হয়তো বিশ্বাস হারাচ্ছি, কিন্তু এরাই জবাব দেবে। তবে নেতৃত্ব বলে যে বিষয় তার কারণেই আজ আমাদের এ অবস্হা। আমরা যদি নেতৃত্ব পাই তা হলে কি হতে পারে বাংলাদেশ নিজেই তার জ্বলন্ত উদাহরণ।

সাম্প্রতিক সময়ে বড় নামে পরিচিত দু’দলের কাণ্ড-কারখানা দেখে এটা বিশ্বাস করতেই হয় মাফিয়া চক্র এখন আর ইতালীতে সীমাবদ্ধ কিছু নয়। দেশে দেশে মাফিয়ার নাম ও কাজের কথা শুনে আসা আমাদের চোখের সামনে এখন মাফিয়া ঘুরে বেড়াচ্ছে। তাদের ইশারায় বাংলাদেশের রাজনীতির ওঠ-বস দেখেই বলা যায়- মেরুদণ্ড বিলুপ্তির পথে। মেরুদণ্ডহীন রাজনৈতিক নেতাদের নিয়ে খেলছে সামান্য রাষ্ট্রদূত।

এই সেদিনও আমরা রাষ্ট্রদূতদের বহিষ্কারের কথা জানতাম। অবাঞ্ছিত ঘোষণার খবর পেতাম। যাদের মেরুদণ্ড আছে, যারা সম্মান নিয়ে বাঁচতে জানে, তারা গরীব বা উন্নয়নশীল হলেও সার্বভৌম। তাদের দেশে অন্য দেশের রাজদূত নিজেদের স্বার্থ দেখে পরষ্পরের স্বার্থ বা কমন ইন্টারেস্টের বাইরে পা ফেলে না। আমাদের দেশে এরা নেতা মন্ত্রী, এমন কি প্রধানমন্ত্রী বা বিরোধী দলীয় নেতার চেয়েও শক্তিশালী। দেখে শুনে মনে হয় সর্বরোগের ধন্বন্তরী এরা।

আমাদের জীবন, সাহিত্য, সংস্কৃতি, ধর্ম, অর্থনীতি সব বিষয়ে সম্যক না জানার পরও এদের ফর্মুলাই যেন পাথেয় বা একমাত্র পথ্য। অন্যদিকে এক দল গদীতে থাকার জন্য অন্য দল যাবার জন্য মরিয়া। এই যাঁতাকলে পড়ে মানুষের আজ ত্রাহি ত্রাহি অবস্হা। প্রতিদিন মরছে, জ্বলছে আর জ্বালাচ্ছে। এই বিপন্নতা থেকে মুক্তির উপায় কি? কোথায় এর সমাধান?

রাজনীতির ওপর বীতশ্রদ্ধ হলেও রাজনীতি-ই এর সমাধান।   তাই দু’দলের বাইরে আর কারো সদিচ্ছা বা ভূমিকার জন্য মরিয়া মানুষ না পারছে গিলতে, না পারছে হজম করতে। ব্যক্তিগতভাবে আমি কোন দলের অন্ধ সমর্থক ন-ই।   বিএনপির প্রতি আকর্ষণহীনতার মূল কারণ তাদের মুক্তিযুদ্ধ তথা অস্তিত্ব বিরোধী ইতিহাস আর জামায়াত প্রীতি। আওয়ামী লীগের বর্তমান নেতৃত্ব বা নীতির প্রতি আস্হা রাখাও অযৌক্তিক।

এমন কঠিন সময়ে যৌবনে মন কেড়ে নেয়া বাম রাজনীতির প্রতিই মুখ ফেরাতে চেয়েছিলাম আবার। বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি আমার প্রিয় দল। মনি-সিংহ, ফরহাদ ভাই আর অযূত প্রিয় নেতা-কর্মীর এই দলটিকে আমি এখনো পচে যাওয়া মনে করি না। সারা বিশ্বে আমেরিকার চক্রান্ত আর পুঁজিবাদের প্ররোচনায় নিস্তেজ হয়ে থাকলেও বাম রাজনীতি বা আদর্শ মরে যায় নি। একদিন না একদিন এরা আবারো রঙ্গমঞ্চে উদ্ভাসিত হবে। সে বিশ্বাসে আমি তাদের প্রতি আস্হা রেখে-ই চলতে চাই- এবার দেশে গেলে সেলিম ভাইয়ের সঙ্গে দেখা হবে এমনই কথা আছে। ভেবেছিলাম এবার দলের সঙ্গে গাঁটছড়া বেঁধে আসব অথবা সমর্থনের বিষয়টা পাকাপাকি করে আসব। কিন্তু সেটাও বোধহয় হবার নয়।

কথায় আছে বিপদে বন্ধুর পরিচয়। দেশের সামনে আজ ঘোর বিপদ। ঘোর অমানিশা। দু’দলের বাড়াবাড়িতে মানুষের জীবন অতিষ্ঠ। এমন কঠিন সময়ে বাম দলের পঁচাগলা নীতিহীন নেতারা লেজুড় হয়ে কেউ মন্ত্রী, কেউ অতি আওয়ামী লীগ আর কেউ বিএনপির দালালিতে ব্যস্ত।

মেনন, ইনু, কাজী জাফর সবাই এখন এক পাল্লায়। বাইরে থাকা বামদের ভেতর কমিউনিস্ট পার্টিই সচল ও প্রগতির রাজনীতি চালু রেখেছে। কিন্তু হঠাৎ করে তারা বিএনপি’র প্রতি সদয় হয়ে ইলেকশনে না যাবার যে ঘোষণা দিলেন তা একদিকে যেমন অদূরদর্শিতার পরিচায়ক, অন্যদিকে মতিভ্রম বা মত বদলানোর ইঙ্গিতবাহী।

সর্বজন গ্রাহ্য না হলে নির্বাচনে না যাবার যুক্তি অকাট্য। তা ছাড়া কমিউনিস্ট পার্টি গেলে বা না গেলেও কি খুব একটা কোন পার্থক্য সূচিত হবে? তারপরও বর্তমান পরিস্হিতিতে তাদের শক্ত অবস্হান আর সাফ কথার গুরুত্ব আছে। সে জায়গাটাতে তাঁরা বিএনপি না গেলে যাবো না- এ কথা বলতে পারেন না। আরো একশ’ একটি কারণ দেখিয়ে না যাওয়া জায়েজ করা যেতো।

আওয়ামী লীগ যে কারণে নির্বাচনমুখী আর বিএনপি যে কারণে যেতে চায় না সেটাইতো ডেড লগ। এই বন্দিদশা থেকে মুক্তির উপায় চাওয়া জাতিকে নতুন কোন সমাধান বা পথ বাতলে দেয়ার পরিবর্তে এক দলের ফেভারে কথা বলে সিপিবি নিজেকে কলংকিত করলো। শোনা যায় খান ব্রাদার্সের নেপথ্য হাত আছে এতে। খান ব্রাদার্সের এক ভাই তো খালেদা জিয়ার দপ্তর সম্পাদক ছিলেন। এখনো বহাল তবিয়তে বিরাজমান। সে কারণেই কি এই ডিগবাজী? নিন্দুকেরা বলে অর্থও নাকি ফ্যাক্টর। দেশের বাতাসে এখন জামায়াতের টাকে সরকারের টাকা, বিএনপির টাকা উড়ছে। যে যেটা পারছে সেটা ধরে নেয়ার তালে ব্যস্ত। আমি যদিও তা বিশ্বাস করতে রাজী ন-ই, তবু সিপিবি’র এই বিএনপি প্রীতি সে অভিযোগকেও মাঠে নিয়ে এসেছে।

ধারাবাহিকতায় আরো মজার ব্যাপার ড. কামাল হোসেনের মত ঘোর ডানপন্থিও এসে মিছিলে এককার হয়ে গেছেন। বক্তৃতা-বিবৃতি আর টকশো নির্ভর মান্নারাও বাদ পড়েন নি। এই মেরুকরণ সিপিবিকে দুর্বল বৈ সবল করবে না। সিপিবির সমর্থন বা সমর্থকগোষ্ঠী এদের পছন্দ করে না। এরা আওয়ামী লীগ বা বিএনপি বিরোধী হলেও মান্না বা ড. কামালের মত হিপোক্রেটদের সঙ্গে নেই। এ জায়গাটায় সিপিবি ফাউল খেলে ফেলেছে। নিজের পায়ে দাঁড়াবার পরিবর্তে এই সেদিন পার্টি অফিসে আগুন লাগিয়ে দেয়া বর্বরদের সঙ্গে যাবার সিদ্বান্ত বা তারা না এলে নির্বাচনে না যাবার সিদ্বান্ত সিপিবিকে আবারো লঘু দলের পরিণামের দিকেই ঠেলে দিলো।

চারিদিকে নাগিনীরা ফেলিতেছে বিষাক্ত নি:শ্বাস- এও কবিগুরুর বাণী। এই বাণীর নেত্রী বা দল নির্বাচনে না এলে বাম রা যাবে না এটা কেমন কথা? বলা যেতো আওয়ামী নির্বাচনে যাবো না। সেটা না বলে এমন কথার ভেতর অর্থ-কড়ি বা অন্য কোন সংযোগের ব্যাপার চলে আসাটা একেবার অযৌক্তিক কিছু মনে হচ্ছে না। তা ছাড়া সঙ্গে সঙ্গে মান্না, ড. কামাল, সৈয়দ মকসুদের মত মানুষদের আগমন কি এই বার্তা দিচ্ছে যে আগামী মিছিলে কাদের সিদ্দিকী আর বি চৌধুরীও এসে জুটবেন। যদি তাই হয় আমরা তবে কি করব?

আমাদের আপনি আরো একবার বড় দু’দলের একদিকে ঠেলে দিলেন আপনারা। সেলিম ভাই আমরা তো আর মুক্তিযুদ্ধ জয় বাংলা ও প্রগতিশীলতার সঙ্গে বেঈমানি করতে পারি না। আমরা নেতা নই, আমাদের হাত-পা আপনার মত বাঁধা নয়। আমরা আপনাকে যে কারণে চিনি, সম্মান করি- সে মুক্তিযুদ্ধের দেশ জ্বালিয়ে সমঝোতা হতে পারে না। বিজয়ের মাসে আপনার মুক্তিযোদ্ধা ইমেজ আর চেতনাও কি তাই বলে না?

সিপিবি এখনো আমার আস্হার দল। সেকি তার অভিমত পুনর্বিবেচনায় রাজী হবে? আমরা একটি সত্যিকার সেক্যুলার ও প্রগতিশীল দলের জন্য পথ চেয়ে আছি।

অজয় দাশগুপ্ত: অস্ট্রেলিয়া প্রবাসী বাংলাদেশি সাংবাদিক

বাংলাদেশ সময়: ১৪৫৬ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ১, ২০১৩

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।