আজ থেকে ১৬ বছর পূর্বে ১৯৯৭ সালের ২ ডিসেম্বর তৎকালীন ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন সরকারের পক্ষে পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক জাতীয় কমিটি ও পার্বত্য চট্টগ্রামের ৩ জেলার অধিবাসীদের পক্ষে জনসংহতি সমিতির মধ্যে পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি (শান্তি চুক্তি) স্বাক্ষরিত হয়েছিল।
সংবিধানের অনুচ্ছেদ ১৪ এবং ২৮ (৪) অনুসারে স্বাক্ষরিত এ চুক্তিটির মূল লক্ষ্য ছিল দেশের সংবিধান অনুসারে পার্বত্য চট্টগ্রাম সমস্যার রাজনৈতিক সমাধান এবং সেই সঙ্গে পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলের সকল নাগরিকের রাজনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক, শিক্ষা ও অর্থনৈতিক অধিকার সমুন্নত এবং আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন প্রক্রিয়া ত্বরান্বিত করা।
চুক্তির কিছুদিনের মধ্যে কয়েকটি বিষয় দ্রুত সমাধা হলেও মৌলিক ও গুরুত্বপূর্ণ অনেকগুলো বিষয় এখনো বাস্তবায়িত হয়নি। এটা দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য যে, এই দীর্ঘ ১৬ বছর পরও পাহাড়ি জনগণকে চুক্তি বাস্তবায়নের জন্য আন্দোলন করতে হচ্ছে। বর্তমান সরকার গত সংসদ নিবাচনের পূর্বে তাদের নির্বাচনী ইশতেহারে এবং পরবর্তীতে ক্ষমতাসীন হওয়ার পর চুক্তি বাস্তবায়নে তাদের দৃঢ় অঙ্গীকার ব্যক্ত করেছিল। কিন্তু গত পাঁচ বছর সরকারের বিভিন্ন ধরনের তৎপরতা লক্ষ্য করা গেলেও চুক্তি বাস্তবায়নে কোনো উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি ছিল না।
২০০৪ সালের ১ নভেম্বর সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের একজন বিচারপতিকে চেয়ারম্যান করে তিন বছর মেয়াদি ভূমি কমিশন গঠন করা হলেও উক্ত আইনের জটিলতার কারণে ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তির ক্ষেত্রে এখনো কমিশন কার্যকর ভূমিকা পালন করতে পারেনি। এখন পর্যন্ত ভূমি কমিশনের চেয়ারম্যান হিসেবে চারজন অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতিকে নিয়োগ দেয়া হয়। সর্বশেষ ১৯ জুলাই ২০০৯ অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি খাদেমুল ইসলাম চৌধুরীকে ভূমি কমিশনের চেয়ারম্যান পদে নিয়োগ দেওয়া হয়। গত ১৮ জুলাই ২০১২ তাঁর মেয়াদ শেষ হলেও এখনো পর্যন্ত উক্ত পদে কাউকে নিয়োগ দেয়া হয়নি।
পার্বত্য চট্টগ্রাম ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি কমিশন আইন ২০০১ এর আইনে চুক্তির সাথে বিরোধাত্মক ১৯টি ধারা এখনো নিষ্পত্তি হয়নি। ফলে ভূমি কমিশন তার কার্যকারিতা হারিয়েছে। সর্বশেষ গত ৩০ জুলাই ২০১২ পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয়ে অনুষ্ঠিত আন্তঃমন্ত্রণালয় সভায় গৃহীত সিদ্ধান্ত অনুযায়ী পার্বত্য চট্টগ্রাম ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি কমিশন ১৩ দফা সম্বলিত সংশোধনী প্রস্তাব সর্বসম্মতিক্রমে গৃহীত হয়, যা পরবর্তী বিভিন্ন কমিটিতে যাচাই বাছাই করে সংসদের সর্বশেষ অধিবেশনে পাস হওয়ার কথা থাকলেও তা চুক্তি বিরোধী বিভিন্ন মহলের বাধার মুখে পাস হয়নি, এবং যেহেতু বর্তমান সংসদ অধিবেশন শেষ হয়ে গিয়েছে তাই উক্ত প্রস্তাব পাস হওযার কোনো সম্ভাবনা নেই বললেই চলে। তাই ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি করার বিষয়টি বর্তমানে চরম অনিশ্চয়তার মধ্যে পড়ে গেল।

পার্বত্য চুক্তি সাক্ষরের পর সবাই এই চুক্তিকে শান্তি চুক্তি হিসেবে অবহিত করেছিল এবং দেশ-বিদেশে ব্যাপক প্রশংসিত হয়েছিল। তাই বর্হিবিশ্বে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল করতে হলে এ চুক্তির পরিপূর্ণ বাস্তবায়নের কোনো বিকল্প নেই। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে, অতীতের কোন সরকারই চুক্তি পূর্ণবাস্তবায়নের কোনো উদ্যোগ গ্রহণ করেনি। চুক্তির সময় বিএনপি নেতৃত্বাধীন রাজনৈতিক জোট চুক্তির বিরোধিতা করলেও পরবর্তীতে ২০০১ সালে ক্ষমতায় আসার পর চুক্তি বাতিল কিংবা চুক্তি বাস্তবায়নের কোনো উদ্যোগও নেয়নি।
যেহেতু বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকারের আগের (১৯৯৬-২০০১) আমলে চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছিল, তাই তাদের নিকট প্রত্যাশাটাও ছিল বেশি। কিন্তু তাদের মেয়াদের শেষ পর্যায়ে এসেও চুক্তি বাস্তবায়নে কোনো আশার সঞ্চার করতে পারেনি। চুক্তি বাস্তবায়ন না হওয়ার অন্যতম কারণগুলো হলো সরকারের আমলাতান্ত্রিক জটিলতা ও চুক্তি বাস্তবায়নে নির্দিষ্ট সময়সীমা না থাকা।
এছাড়া, পার্বত্যবাসীর অধিকার ও দাবির প্রতি বৃহত্তর বাঙালি সমাজের মমত্ববোধের অভাব এবং চুক্তির বিষয়ে সরকারি এবং বিরোধী দলের মধ্যে বিপরীতমুখী অবস্থানও অনেকাংশে দায়ী। দেশের একটি অংশকে দূরে সরিয়ে রেখে দেশের সামগ্রিক উন্নয়ন কোনমতেই সম্ভব নয়, তাই চুক্তি বাস্তবায়নের মাধ্যমে পাহাড়ি-বাঙালির সম্মিলিত প্রচেষ্টায় বাংলাদেশেকে অন্যতম সম্ভাবনাময় অর্থনৈতিক অঞ্চল গড়ে তোলা সম্ভব।
যেসব স্বায়ত্ত্বশাসনকামী পাহাড়িগণ একদিন একটি সুন্দর ভবিষ্যতের আশায় আন্দোলন-সংগ্রাম ছেড়ে সরকারের সঙ্গে পার্বত্য চুক্তি করেছিল, তারাই এখন চরম হতাশার মধ্যে দিন অতিবাহিত করছেন, প্রতিক্ষণ তারা চুক্তি বাস্তবায়ন দেখার অপেক্ষায় আছেন। আশা নিরাশার দোলায় ১৬ বছর কেটে গেছে, কিন্তু তাদের অপেক্ষার প্রহর শেষ হচ্ছে না। তাই তাদের অপেক্ষাকে আর দীর্ঘায়িত না করে এবং তাদের মতামতকে আস্থায় এনে পার্বত্য চুক্তির পুর্ণবাস্তবায়ন করা প্রয়োজন।
মোহাম্মদ জাহেদ হাসান: উন্নয়ন ও মানবাধিকার কর্মী
বাংলাদেশ সময়: ১৪৫০ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ০২, ২০১৩