ঢাকা, রবিবার, ৯ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৪ নভেম্বর ২০২৪, ২২ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

মুক্তমত

কাদের মোল্লার ফাঁসি : পাকিস্তানের পুরনো ক্ষত

প্রীতম দাস/সুশান্ত দাস গুপ্ত, অতিথি লেখক | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০২২২ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ১৮, ২০১৩
কাদের মোল্লার ফাঁসি : পাকিস্তানের পুরনো ক্ষত কাদের মোল্লা

১.
একাত্তরের যুদ্ধাপরাধী কাদের মোল্লার ফাঁসি কার্যকর করা হয়েছে ১২ ডিসেম্বর, ২০১৩। নিঃসন্দেহে বাংলাদেশের জন্য একটি অবিস্মরণীয় অর্জন এই ফাঁসি--- ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার অগ্রযাত্রায় একটি গুরুত্বপূর্ণ মাইলফলক।

দীর্ঘ ৪২ বছর পর বিচারহীনতার শেকল থেকে মুক্তির দিকে যাত্রা শুরু করতে পেরে বাংলাদেশের মানুষ গর্বিত। তবে টাকার উল্টো পিঠের মতো, এই ফাঁসিই তীব্র প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করেছে পাকিস্তানে। প্রতিক্রিয়ার তীব্রতা এতোটাই যে, বিভিন্ন মতাদর্শের রাজনৈতিক দলগুলো (বেনজির ভুট্টোর দল পিপিপি ছাড়া) সব বিভেদ ভুলে গিয়ে কাদের মোল্লার ফাঁসির প্রতিবাদ জানিয়ে,  উস্কানিমূলক মন্তব্য করে কার্যত একটি বাংলাদেশবিরোধী অবস্থান নিয়ে ফেলেছে। বাংলাদেশের বিজয় দিবস ১৬ ডিসেম্বরকে ঢাকার পতন দিবস হিসেবে আখ্যায়িত করে পাকিস্তানের সংসদে একটি রেজল্যুশনও গৃহীত হয়েছে, সেখানে কাদের মোল্লার মৃত্যুতে শোক প্রকাশ করা হয়েছে। পরস্পরবিরোধী জামায়াতে ইসলামী, কট্টরপন্থী মুসলিম লীগ, উদারপন্থী বলে পরিচিত পাকিস্তান তেহরিক ই ইনসাফ এক কাতারে চলে এসেছে। বস্তুত, কাদের মোল্লার ফাঁসি পাকিস্তানের আত্মায় রীতিমতো আগুনের ছ্যাঁকা দিয়েছে।

এতে অবশ্য অবাক হওয়ার তেমন কিছু নেই। পাকিস্তানের রাজনৈতিক সংস্কৃতিটাই হলো বিচারহীনতার। পাকিস্তানের বেশিরভাগ রাজনৈতিক দল বেঁচে আছে একাত্তরের যুদ্ধাপরাধীদের সাথে নিয়ে। কাজেই মুসলিম লীগ সরকারের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী যখন বলে বসেন, ‘এই ফাঁসির মাধ্যমে পুরনো ক্ষতকে জাগিয়ে তোলা হয়েছে’, তখন বিস্মিত হই না। পাকিস্তানের জন্য আসলে এই ক্ষতটা পুরনো নয়; একাত্তরে যেমন ছিল ঠিক তেমন দগদগেই রয়ে গেছে এখনও।

২.
প্রথম প্রতিবাদটা করেছে পাকিস্তান জামায়াতে ইসলামী। তারা কাদের মোল্লাকে শহিদ বানিয়েছে, এই ফাঁসিতে শোক প্রকাশ করেছে। পাকিস্তানের সেনাবাহিনীকে উস্কে দিয়ে বাংলাদেশ আক্রমণ করার জন্য প্ররোচনা দিয়েছে। ব্যাপারটা অস্বাভাবিক নয় ; বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর সাবেক আমীর গোলাম আযম তো বলেছেনই, জামাতের হেডকোয়ার্টার পাকিস্তানে।   অতএব দলীয় একজন ব্যক্তির ফাঁসি হয়েছে সেটা মেনে নেয়া দলের জন্য কষ্টের।

১৯৭১ সালে জামায়াতের যে ভূমিকা বাংলাদেশে ছিল, এর পরে ৪২ বছরে সেই চরিত্র থেকে সরে আসে নি তারা। একইভাবে সন্ত্রাসী কার্যক্রম চালিয়ে গেছে, রাজনীতির লেবাসে হত্যার সংস্কৃতি চালিয়ে গেছে। পাকিস্তান জামায়াতের ভূমিকাও এর চেয়ে ভিন্নতর কিছু নয়। তার প্রমাণ মেলে জামায়াতে ইসলামের প্রতিষ্ঠাতা আবুল আলা মওদুদির ছেলে হায়দার ফারুক মওদুদির কথাতেই। একাধিক সাক্ষাৎকারে হায়দার ফারুক স্বীকার করেছেন, জামায়াতে ইসলামী একটি সন্ত্রাসী দল। সর্বশেষ বাংলাদেশ সফরে তিনি বাংলাদেশে জামায়াতেরর রাজনীতি নিষিদ্ধ করার পক্ষে মত দিয়ে গেছেন [১]।

একথা তো কারো অজানা নেই, ১৯৭১ সালে জামায়াতে ইসলামী দলীয়ভাবেই যুদ্ধাপরাধ সংঘটনের জন্য দায়ী। সেই জামাতে ইসলাম, যেটা এখনও একই রকম সন্ত্রাসবাদী একটি দল, কোনো যুদ্ধাপরাধীর বিচার ও শাস্তিতে অন্তর্জ্বালায় জ্বলবে--- এটাই তো স্বাভাবিক।

৩.
এর পরপরই বেশ কড়াভাবেই একটি বক্তব্য দিয়েছেন পাকিস্তানের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী চৌধুরি নিসার আলি খান। এক বিবৃতিতে কাদের মোল্লার ফাঁসিতে নিসার আলি গভীর শোক ও উদ্বেগ জানিয়েছেন। এই পর্যন্ত এসে থেমে গেলে হয়তো বেশি কিছু বলার থাকতো না। তবে নিসার আলি এইখানে থামেন নি। তিনি মনে করেন, বাংলাদেশ সরকার দয়া ও মহানুভবতা দেখাতে পারেনি। এই ফাঁসির মাধ্যমে পুরনো ক্ষতকে জাগিয়ে তোলা হয়েছে। এবং পাকিস্তানিদের সেই পুরনো গান - অতীত ভুলে সামনে এগিয়ে যেতে বলেছেন [২]।

তো কে এই নিসার আলি? একটু তলিয়ে দেখা যাক। নিসার আলির অতীত বেশ চমকপ্রদ। দলীয়ভাবে মুসলিম লীগের নেতা। বিভিন্ন সময় কঠোর যুক্তরাষ্ট্রবিরোধী বক্তব্যের জন্য নাম কিনেছিলেন। পাকিস্তানের যাবতীয় অস্থিতিশীলতার জন্য যুক্তরাষ্ট্রকে দায়ী করা ছিল নিসার আলির জনপ্রিয়তার পেছনে একটা ভালো প্রভাবক। তবে থলের বেড়াল বেরিয়েছে ২০১১ সালে, উইকিলিকস এর মাধ্যমে। একটি তারবার্তায় দেখা গেছে, নিসার আলি মার্কিন রাষ্ট্রদূতের কাছে স্বীকার করেছেন যে তিনি মূলত প্রো-যুক্তরাষ্ট্র ধ্যান ধারণাই পোষণ করেন। তার স্ত্রী এবং মেয়ে মার্কিন নাগরিক। যুক্তরাষ্ট্রের প্রতি তার আনুগত্য নিয়েও কোনো সন্দেহ নেই। তবে যুক্তরাষ্ট্রবিরোধী কথাবার্তা তিনি বলে থাকেন, এর একমাত্র কারণ জনগণের মধ্যে আস্থা ও ইমেজ ধরে রাখা [৩]।

বাংলাদেশে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের প্রশ্নে যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান তো কারো অজানা নেই। কাজেই যুক্তরাষ্ট্রের একজন দালালের অবস্থান তার থেকে ভিন্ন হবে এটা আশা করাই ভুল।

নিসার আলি মুসলিম লীগের রাজনীতি করেন, এই বিষয়টিও খেয়াল করে রাখার মতো। একাত্তরের যুদ্ধাপরাধী, হত্যাকারী, ধর্ষক রাজা নাদের পারভেজকে তারাই সংসদ সদস্য বানিয়েছেন চার বার, তিন বার মন্ত্রী বানিয়েছেন। অর্থাৎ মুসলিম লীগের রাজনীতিতেও যুদ্ধাপরাধীদের পৃষ্ঠপোষকতাই করা হয়। রাজা নাদের পারভেজ সেই ১৯৫ পাকিস্তানি যুদ্ধাপরাধীর একজন, যাদের দেশে ফিরিয়ে নিয়ে বিচার করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল পাকিস্তান [৪]। তার যুদ্ধাপরাধের প্রমাণ, নৃশংসতার বিবরণ মিলবে মুক্তিযুদ্ধের বিভিন্ন স্মৃতিচারণে। বিচার কেমন হয়েছে সে তো দেখাই যাচ্ছে, বরং তাকে সামাজিকভাবে প্রতিষ্ঠিতে করেছে এই মুসলিম লীগ। যুদ্ধাপরাধীদের পৃষ্ঠপোষক রাজনৈতিক দল তো যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের বিরোধিতা করবেই।

তবে সবচেয়ে ঔদ্ধত্যপূর্ণ বক্তব্যটি দিয়েছেন পাকিস্তান তেহরিক ই ইনসাফের চেয়ারম্যান সাবেক ক্রিকেটার ইমরান খান। তিনি বলেছেন, কাদের মোল্লা নির্দোষ [৫]। এই লোকের প্রতিক্রিয়ায় অনেকেই অবাক হয়েছেন, কারণ পাকিস্তানের রাজনীতিতে ইমরান খানকে বাংলাদেশের প্রতি সহানুভূতিশীল বলেই ধরে নেয়া হয়। একাত্তরের গণহত্যার জন্য বাংলাদেশের কাছে পাকিস্তানের ক্ষমা চাওয়া উচিৎ, ক্ষমতায় এলে ক্ষমা চাইবেনও --- এই ধরণের বক্তব্য বহুবার দিয়েছেন ইমরান খান। তো সেই ইমরান খানই কাদের মোল্লাকে নির্দোষ বলছেন কেন?

সত্য হলো, শেষ পর্যন্ত ইমরান খানও একজন পাকিস্তানি। একটু আগেই যে যুদ্ধাপরাধীর কথা বলা হয়েছে, পাকিস্তানের সর্বশেষ নির্বাচনে সেই নাদের পারভেজ অংশ নিয়েছেন তেহরিক-ই-ইনসাফের টিকিটেই [৬]। নাদের পারভেজকে দলে টানতে মুসলিম লীগের সাথে লম্বা সময় দড়ি টানাটানি করতে হয়েছে ইমরান খানকে। কাজেই যুদ্ধাপরাধীদের পৃষ্ঠপোষকতা করে, তাদের হাতে পায়ে ধরে রাজনীতি করছেন ইমরান খান নিজেও। উপরন্তু বাংলাদেশে সংঘটিত গণহত্যার অন্যতম ‘পারপিট্রেটর’(হোতা) আমির আব্দুল্লাহ খান নিয়াজির ভাতিজা ইমরান খান। কাদের মোল্লাকে তিনি নির্দোষ বলবেন না তো কে বলবে?

৪.
বাংলাদেশের যেকোন সচেতন নাগরিক স্মরণ করতে পারবেন, ২০০৯ সালে যখন যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের আনুষ্ঠানিকভাবে শুরু করার প্রস্তুতি চলছে, তখন ঢাকায় পাকিস্তানের রাষ্ট্রপতির বিশেষ দূত জিয়া ইস্পাহানি এসে বলে গিয়েছিলেন, যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করার জন্য এখন উপযুক্ত সময় নয়। তারও আগে ২০০৮ সালে ঢাকায় পাকিস্তান হাইকমিশনের সামনের রাস্তার নাম মুক্তিযোদ্ধাদের নামে রাখায় তীব্র আপত্তি জানিয়েছিল পাকিস্তান। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ এবং এর চেতনা সবসময়ই পাকিস্তানের জন্য যন্ত্রণাকর।

যুদ্ধাপরাধীদের বিচার রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশের আদি প্রতিশ্রুতি। এর উদ্যোগ বাংলাদেশ শত্রুমুক্ত হবার পরপরই গ্রহণ করা হয়। সেসময় নানা রকম আন্তর্জাতিক চাপে ১৯৫ জন পাকিস্তানি যুদ্ধাপরাধীকে বাংলাদেশ পাকিস্তানের কাছে ফিরিয়ে দিতে বাধ্য হয়; তবে শর্ত ছিল, দেশে ফিরিয়ে নিয়ে এদের বিচার করবে পাকিস্তান। পাকিস্তান সেই প্রতিশ্রুতি রাখে নি। বরং বিভিন্নভাবে তাদের প্রতিষ্ঠিত করেছে, মন্ত্রী বানিয়েছে, সামরিক খেতাব দিয়েছে। হামুদুর রহমান কমিশন যে রিপোর্ট তৈরি করেছিল সেটাও প্রকাশ করেনি পাকিস্তান। বাংলাদেশ, মুক্তিযুদ্ধ, একাত্তর, যুদ্ধাপরাধ--- এই শব্দগুলো পাকিস্তানের আত্মায় জ্বালা ধরায়। যে পরাজয়ের ক্ষত বুকে নিয়ে ১৯৭১ সালে মাথা নিচু করে বাংলাদেশ ছেড়েছিল পাকিস্তান, সে ক্ষত শুকায়নি এখনও। অথচ এই গ্লানি থেকে তারা মুক্ত হতে পারতো সহজেই। গণহত্যার জন্য ক্ষমা চেয়ে, বাংলাদেশের প্রাপ্য ক্ষতিপূরণ দিয়ে, যুদ্ধাপরাধীদের বিচার সম্পন্ন করে পাপমুক্ত হতেই পারতো পাকিস্তান। সেটা না করে বরং বাংলাদেশের জন্ম সম্পর্কে ভুল ইতিহাস শিখিয়ে দেয়া হচ্ছে পাকিস্তানের শিশুদের, পাকিস্তানের বেশীরভাগ মানুষই এখনও বাংলাদেশ সম্পর্কে ঘৃণা নিয়ে বেঁচে আছে।

যা বলছিলাম, ক্ষতটা পুরনো নয়। এখনও একদম আনকোরা-নতুনই আছে। যতদিন না পাকিস্তান নিজে এই বিচারহীনতা এবং যুদ্ধাপরাধীদের পৃষ্ঠপোষকতার সংস্কৃতি থেকে বেরিয়ে আসবে, ততদিন এই ক্ষত শুকাবার কোনো সুযোগ নেই। সেই জন্যই পাকিস্তানের সংসদে যখন কাদের মোল্লার ফাঁসির প্রতিবাদ জানিয়ে রেজুল্যুশন গৃহীত হয় তখন বিস্মিত হওয়ার কারণ থাকে না। কাদের মোল্লার ফাঁসি তাদের পুরনো ঘায়ে নুনের ছিটে দিয়েছে, এটা প্রত্যাশিতই ছিল।

লেখক: প্রীতম দাস/সুশান্ত দাস গুপ্ত; ব্লগার, আমারব্লগডটকম।

বাংলাদেশ সময়: ০২০৯ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ১৮, ২০১৩

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।