ঢাকা, রবিবার, ৯ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৪ নভেম্বর ২০২৪, ২২ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

মুক্তমত

পাকিস্তান বদলায়নি, বিএনপির প্রতিক্রিয়াহীনতা লজ্জাজনক

আশরাফ সিদ্দিকী বিটু | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৩০০ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ১৯, ২০১৩
পাকিস্তান বদলায়নি, বিএনপির প্রতিক্রিয়াহীনতা লজ্জাজনক

দীর্ঘ ৪২ বছরেও পাকিস্তান বদলায়নি। ১৯৭১ সালের হত্যাযজ্ঞ, বর্বরতার জন্য, গণহত্যা, ধর্ষণসহ যুদ্ধাপরাধের জন্য কোনোদিন ক্ষমা চায়নি কিংবা ভুল স্বীকার করেনি তারা।



সভ্য জাতি মাত্রই এসব বিষয়ে অনুশোচনা প্রকাশ করে, নতুবা সমবেদনা জানায়। পাকিস্তান কোনোদিন তা দেখায়নি। ১৯৭১ সালে তাদের পরাজয় বিশ্ববাসী দেখেছে।

আমরা রক্তের বিনিময়ে স্বাধীনতা অর্জন করেছি। বাংলাদেশ রাষ্ট্র সবসময়ই উদারতার প্রমাণ দিয়েছে। সার্কভুক্ত দেশগুলোর ঐক্যের বিষয়ে বাংলাদেশ সবসময় সোচ্চার ছিল এবং আছে। পাকিস্তানের সাথে আমাদের কূটনৈতিক সম্পর্ক আছে এবং বাণিজ্যিক সম্পর্কও আছে। বাংলাদেশ কোনোদিন তাদের আভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ বা কোনো বিরূপ মন্তব্য করেনি। বরং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সার্ককে শক্তিশালী করা এবং দক্ষিণ এশিয়ায় সন্ত্রাসবাদ দমনে সবাইকে ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করার আহ্বান জানিয়ে আসছেন। আমাদের পররাষ্ট্রনীতি হচ্ছে friendship to all, malice to none. এই আদর্শ নিয়েই বাংলাদেশ ও বর্তমান সরকার বিভিন্ন দেশের সঙ্গে সম্পর্ক বজায় রাখছে ও সহযোগিতা বৃদ্ধি করছে।

আমরা বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে মুক্তিযুদ্ধ করে পাকিস্তানের নির্যাতনের জাল ছিন্ন করে স্বাধীন হয়েছি। বিশ্বের স্বীকৃতি অর্জন করেছি। পরে অবশ্য বাংলাদেশকে পাকিস্তানও স্বীকৃতি দিয়েছে। কিন্তু কখনও হত্যাযজ্ঞ, নৃশংসতার জন্য ক্ষমা চায়নি। তাদের জঘন্য অপরাধের জন্য ভুল স্বীকার করেনি।

৪২ বছর পর আবারও প্রমাণিত হলো পাকিস্তান সেই পুরোনো পরাজয়ের স্মৃতি ভুলতে পারেনি এবং মানসিকতার কোনো পরিবর্তন করেনি নতুবা আজও জামায়াতের জন্য তাদের প্রীতি থাকত না। সেই প্রীতির জন্য তারা আমাদের আভ্যন্তরীণ বিষয় নিয়ে গর্হিতভাবে তাদের সংসদে আলোচনা করেছে। যা সত্যি অনভিপ্রেত এবং কূটনৈতিক শিষ্টাচার বর্হিভূত। এমপি, মন্ত্রী, পাকিস্তান জামায়াতে ইসলামের বক্তব্য খুবই অনাকাঙ্ক্ষিত।

পাকিস্তানের এ আচরণের তীব্র নিন্দা, প্রতিবাদ ও ঘৃণা জানাই। বাংলাদেশ সরকার পাকি রাষ্ট্রদূতকে ডেকে এনে এর কড়া প্রতিবাদ করে ব্যাখ্যা জানতে চেয়েছে। সঠিক ও সময়োচিত কাজ করেছে সরকার। সরকারের মন্ত্রীরাও এর প্রতিবাদ করেছেন, দেশের মানুষ এর প্রতিবাদ করছে, মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসী কারো পক্ষে পাকি সংসদের বা ইমরান খান বা হামিদ মীরের বক্তব্য মেনে নেওয়া সম্ভব নয়, আমরা তা মেনে নিতে পারি না। আমরা প্রতিবাদ করবোই।

যুদ্ধাপরাধী আবদুল কাদের মোল্লার ফাঁসির রায় কার্যকর করায় নিন্দা জানিয়ে পাকিস্তান পার্লামেন্টে প্রস্তাব পাস হওয়াকে অমার্জনীয় ধৃষ্টতা হিসেবে দেখছে বাংলাদেশ সরকার। এটিকে বাংলাদেশের আভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপের নজিরবিহীন দৃষ্টান্ত উল্লেখ করে সরকার আনুষ্ঠানিক কড়া প্রতিবাদ জানিয়েছে।

মঙ্গলবার ঢাকায় নিযুক্ত পাকিস্তানের হাইকমিশনার আফরাসিয়াব মেহেদি হাশমি কুরেশিকে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে তলব করে এ প্রতিবাদ জানানো হয়।  

পাকিস্তানের হাইকমিশনারকে তলবের পর পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় একটি বিবৃতি দিয়েছে। বিবৃতিতে বলা হয়, পাকিস্তানের জাতীয় পরিষদ, পাঞ্জাবের প্রাদেশিক পরিষদ ও পাকিস্তানের একজন জ্যেষ্ঠ মন্ত্রী বাংলাদেশে যুদ্ধাপরাধের রায়ের বিরুদ্ধে যে প্রস্তাব পাস ও বক্তব্য দিয়েছেন তার কড়া প্রতিবাদ জানিয়েছে বাংলাদেশ। এই প্রতিবাদ জানাতে পাকিস্তানের হাইকমিশনার আফরাসিয়াব মেহেদি হাশমিকে মন্ত্রণালয়ে তলব করা হয়।

বিবৃতিতে কাদের মোল্লাসহ পাকিস্তানি সেনাবাহিনী ও তার দোসরদের ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চে শান্তিপূর্ণ ও নিরীহ মানুষের ওপর গণহত্যা চালানোর কথা উল্লেখ করা হয়।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২০০৮ সালে নির্বাচনী ইশতেহারে নয় মাসের মুক্তিযুদ্ধের সময় চলা গণহত্যার বিচারের অঙ্গীকার করেন। কোনো উদ্দেশ্য নিয়ে যুদ্ধাপরাধের বিচার করা হয়নি। ভিকটিমদের পরিবার এবং সামগ্রিকভাবে বাঙালি জাতির বেদনার একটি আইনি পরিসমাপ্তি ঘটানোই এ বিচারের লক্ষ্য। বাংলাদেশের জনগণের দীর্ঘদিনের দাবি ও প্রত্যাশার প্রতিফলন এটি।

তথ্য ও সংস্কৃতিমন্ত্রী হাসানুল হক ইনু বলেন, জামায়াত নেতা কাদের মোল্লার ফাঁসি নিয়ে পাকিস্তানের পার্লামেন্টের প্রস্তাব এবং দেশটির স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর বক্তব্য কূটনৈতিক শিষ্টাচারবহির্ভূত। এটি বাংলাদেশের আভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপের শামিল।

ইনু বলেন, যতই দেশি-বিদেশি ষড়যন্ত্র হোক না কেন, যুদ্ধাপরাধীদের বিচার চালিয়ে নেওয়া হবে।

আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদ সদস্য সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত বলেন, সার্বভৌম বাংলাদেশের শক্তিশালী স্বাধীন বিচার ব্যবস্থা এ রায় দিয়েছে। এ বিষয়ে অন্য কোনো দেশের পার্লামেন্টের সিদ্ধান্ত নেওয়ার অধিকার নেই। দেশের বিশিষ্ট নাগরিকবৃন্দ প্রতিবাদ করেছে। সোস্যাল মিডিয়াগুলোতে দেশের মানুষ এর প্রতিবাদ করছে এবং প্রতিবাদ কর্মসূচি পালন করছে- খুবই স্বাভাবিক এই প্রতিবাদ। আমাদের আভ্যন্তরীণ বিষয়ে আমরা কারো হস্তক্ষেপ বা অনাকাঙ্ক্ষিত বাড়াবাড়ি মেনে নিতে পারি না।

আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক বলেছেন, জামায়াতে ইসলামীর নেতা আবদুল কাদের মোল্লাকে সাহসী সৈনিক আখ্যা দিয়ে পাকিস্তানের সংসদে যে ‘নিন্দা প্রস্তাব’ করা হয়েছে তা বাতিল করা না হলে আন্তর্জাতিকভাবে দেশটির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার আহ্বান জানাবে আওয়ামী লীগ। এই বক্তব্য এবং সরকারের কঠোর অবস্থানকে সাধুবাদ জানাই। এতে আস্থা রাখা যায় যে সরকার প্রয়োজনীয় সব পদক্ষেপ নেবে, কারণ আমরা মনে করি যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের মাধ্যমে জাতি কলঙ্কমুক্ত হবে, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বাস্তবায়ন হবে এবং আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা পাবে।

বাংলাদেশে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার হচ্ছে এবং বিচারের রায়ও কার্যকর হচ্ছে। আওয়ামী লীগ সরকার যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল, প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী আওয়ামী লীগ সরকার এই বিচার করছে।

আমরা দেখেছি নানাবিধ ষড়যন্ত্র, অপপ্রচার, লবিস্টদের অপতৎপরতা, আন্তর্জাতিক মহলের চাপ উপেক্ষা করে সরকার সঠিকভাবে বিচারের কাজ করছে এবং রায়ও কার্যকর করেছে, ভবিষ্যতে আরো রায় হবে এবং রায় কার্যকরও করা হবে বলে জানিয়েছে ট্রাইব্যুনাল ও সরকার। আমরা জনগণ এই প্রত্যাশা রাখি যুদ্ধাপরাধীদের বিচার হবে এবং রায়ও কার্যকর করা হবে।

মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসী সবাই যুদ্ধাপরাধীদের বিচার চায়। আর কারা চায় না বা এর বিরোধিতা করছে তা আজ সবাই জানে। যুদ্ধাপরাধীদের রক্ষার জন্য তারা দেশে সহিংসতা করছে, মানুষ হত্যা করছে, বাসে আগুন দিচ্ছে, নিরীহ শিশু, বাস ড্রাইভারকে পুড়িয়ে মারছে যেন দেশের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেছে।

৭১’র পরাজিত শক্তির দোসর যারা এখনও বাংলাদেশ মেনে নিতে পারেনি, তারাই এই কাজ করছে। জামায়াত-শিবির মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতাই শুধু করেনি মুক্তিযুদ্ধের সময় মানুষ মেরেছে, গণহত্যা করেছে, ধর্ষণ, মানুষকে জোর করে ধর্মান্তরিত করেছে, প্রতিটি যুদ্ধাপরাধে জামায়াতের লোক জড়িত ছিল এবং বর্তমানে সেই যুদ্ধাপরাধীরা এবং তাদের উত্তরসূরীরা ৭১’র মতোই বাংলাদেশে তাণ্ডব চালাচ্ছে।

পাকি সংসদে গৃহীত প্রস্তাবের প্রতিবাদ সরকার, আওয়ামী লীগ ও দেশের প্রগতিশীল মানুষ করেছে এবং সরকার ব্যবস্থাও নিয়েছে। কিন্তু আশ্চর্যজনক হলেও সত্য আমরা দেখলাম বিএনপি বা বিএনপি নেত্রী কোনো আনুষ্ঠানিক প্রতিক্রিয়া জানাননি। অথচ বিএনপি এখন সাংবিধানিকভাবে বিরোধী দল এবং খালেদা জিয়া এখনও বিরোধী দলের নেতা।

আমরা সবার মতো বিএনপির কাছ থেকেও এ বিষয়ে প্রতিবাদ আশা করেছি। কিন্তু তারা তা করেনি বরং শুধু  সরকারের সমালোচনাই করেছে। এতে কি প্রমাণিত হয় না বিএনপি দেশের স্বার্থে সচেতন নয় এবং মুক্তিযুদ্ধের অপমানে তাদের নিশ্চুপ থাকা রাজনৈতিক ছলচাতুরির অংশ।

বিএনপি নেত্রী প্রকাশ্যে বিভিন্ন জনসভায় যুদ্ধাপরাধীদের মুক্তি চেয়েছেন। বিএনপির আইনজীবীরা জামায়াতের পক্ষ নিয়ে ট্রাইব্যুনালে গেছেন এবং ট্রাইব্যুনাল ভেঙে দিতে বলেছিলেন।

তারা আসলে প্রমাণ করেছেন, তারা যুদ্ধাপরাধীদের বিচার চান না। প্রতিটি রায়ের পর বিএনপি প্রতিক্রিয়া না দিয়ে চুপ থেকেছে এবং রায় কার্যকর হবার পরও তারা প্রতিক্রিয়া দেওয়া থেকে বিরত থেকেছেন। মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে ভূলুণ্ঠিত করতে এহেন কাজ নেই যা বিএনপি করছে না। বিএনপি সরাসরি যুদ্ধাপরাধীদের পক্ষ নিয়েছে যা সুনির্দিষ্টভাবে প্রমাণিত। পাকি সংসদের সমালোচনা না করে বিএনপি আবারো তার প্রমাণ দিল।

এই প্রতিক্রিয়াহীনতা বা মন্তব্য প্রদান থেকে বিরত থাকা বা প্রতিবাদ না করা তাদের প্রতিক্রিয়াশীল উগ্র রাজনৈতিক মনোভাবের প্রকাশ ঘটিয়েছে। বিএনপি’র এই অবস্থানকে আমরা এখন স্বাভাবিকই মনে করি- তাদের পাকিস্তান প্রীতি বিএনপির জন্ম থেকেই ছিল এবং তা অচ্ছেদ্য বলেই মনে হচ্ছে।
 
আশরাফ সিদ্দিকী বিটু
রাজনৈতিক কর্মী

বাংলাদেশ সময়: ১৪১১ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ১৯, ২০১৩

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।